০২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

ই-বুকের আধিপত্য, কমেনি ছাপা বইয়ের আবেদন

ফারিহা নিশাত রিমি || ০২ নভেম্বর, ২০২৪, ০২:১১ এএম
ই-বুকের আধিপত্য, কমেনি ছাপা বইয়ের আবেদন


বইকে বলা হয়ে থাকে মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বইয়ের রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস; সেইসঙ্গে রয়েছে বইপড়া নিয়ে মনীষীদের কতশত উক্তি। নেপোলিয়ন বলে গেছেন, অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল। 

জানা গেছে, লিখিত শব্দের উৎপত্তি ঘটেছিল প্রায় ৩ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে। সেই সময় প্রাচীন সভ্যতাগুলো যেমন মিশর ও চীন প্যাপিরাসরা বাঁশের রেড়ির ওপর লেখা শুরু করে। 

চীনে প্রথম কাগজের উদ্ভাবন ঘটে অষ্টম শতাব্দীতে। পরবর্তী সময়ে ১৫ শতকে এসে জোহান গুটেনবার্গ প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কার করেন। যা বই লেখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। 

 আর গুটেনবার্গের এই প্রযুক্তিতে বইয়ের অনেক কপি তৈরি করা সম্ভব ছিল। যার ফলে এই প্রযুক্তি বইয়ের প্রচার এবং শিক্ষা বিস্তারে অত্যন্ত কার্যকরী হয়ে ওঠে।

১৬ শতকে রেনেসাঁস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বইয়ের প্রকাশনায় আসে এক নতুন যুগ। এসময় বিদ্যা, শিল্প, এবং সাহিত্য বিকাশ লাভ করে। সুতরাং বইয়ের মাধ্যমে নতুন নতুন ধারণাগুলি মানুষের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি চিন্তাভাবনায় ব্যাপকভাবে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। ফলে প্রকাশকরা প্রিন্ট বইয়ের চাহিদাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের বই প্রকাশ করতে শুরু করেন। 

পরবর্তী সময়ে ১৭ ও ১৮ শতকে বইয়ের প্রকাশনা শিল্পে পরিবর্তন আসতে শুরু করে।  এসময় বিভিন্ন ধরনের বই যেমন উপন্যাস, কবিতা এবং বিজ্ঞানের বই প্রকাশিত হয় ।

১৯ শতকের শুরুতে স্টেরিওটাইপিং ও মেকানিক্যাল প্রেসের মাধ্যমে বইয়ের জগতে প্রযুক্তির বিস্তার ঘটে। এর ফলে বইয়ের উৎপাদন আরও দ্রুত ও সাশ্রয়ী হয়ে উঠে।  এসময় প্রথমবারের মতো জনপ্রিয় সাহিত্য ও পেপারব্যাক বইয়ের উত্থান ঘটে।

২০ শতকে টেলিভিশন, সিনেমা এবং অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমগুলোর উত্থান শুরু হলে বই বিক্রিতে প্রভাব পড়তে শুরু করে। তবে, এই সময়ে একাধিক বিখ্যাত লেখক ও সাহিত্যিকদের লেখা বইয়ের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। 

কালের বিবর্তনে ২১ শতকের শুরুতে ই-বুক ও অনলাইন প্রকাশনার মাধ্যমে বইয়ের প্রচার- বিতরণে ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটে।  ডিজিটাল বইয়ের সুবিধা হচ্ছে দ্রুত বিতরণ  ও সহজলভ্যতা যা পাঠকদের জন্য নিয়ে আসে নতুন অভিজ্ঞতা।

ই-বুকের যুগে প্রবেশ করার পর থেকেই প্রিন্ট বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দেয় নানান শঙ্কা। পাঠকদের হাতে নিয়ে বই পড়ার অভ্যাসকে পাল্টে দিচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি যা প্রিন্ট বইয়ের চাহিদাকে কিছুটা প্রভাবিত করছে।

ই-বুক দ্রুত, সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হওয়ার ফলে যেকোনো জায়গা থেকেই ই-বুক ডাউনলোড করে পড়তে পারেন পাঠকরা। যা তাদের পড়ার অভিজ্ঞতাকে আরও সহজ করে তোলে। এছাড়া, ডিজিটাল বইয়ের মধ্যে অডিও, ভিডিও ও ইন্টারঅ্যাকটিভ উপাদান অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে নতুন ধরনের পাঠ অভিজ্ঞতা তৈরি হচ্ছে। এই সুবিধাগুলো ই-বুকের প্রতি মানুষের আগ্রহকে দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তবে ই-বুক দ্রুত বিস্তার করলেও প্রিন্ট বইয়ের প্রতি পাঠকদের ভালবাসা কমছে না। অনেক পাঠক এখনও প্রিন্ট বইয়ের প্রতি তাদের মানসিক এবং আবেগীয় সংযোগ অনুভব করেন। 

বইয়ের গন্ধ, পৃষ্ঠার স্পর্শ ও সংগ্রহের আনন্দ তাদের জন্য এখনও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, বইয়ের নতুন নতুন সংস্করণ  সংগ্রহ  করা পাঠকের কাছে এখনও জনপ্রিয় হয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বইয়ের শারীরিক উপস্থিতি একটি অনুভূতি সৃষ্টি করে যা ডিজিটাল বই দিতে পারে না।

বর্তমানে প্রকাশকরা প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয় ধরনের বই বাজারে নিয়ে আসছে। এই ব্যবস্থা পাঠকদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করে। একটি বই যদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভালো করে তাহলে সেই বইটির প্রিন্ট সংস্করণও বাজারে আসে। এটি প্রমাণ করে যে, দুই ধরনের বইয়ের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক বিদ্যমান এবং উভয়েরই চাহিদা রয়েছে।

বইয়ের সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিবেশ। ই-বুকের মাধ্যমে কাগজের ব্যবহার কমানোর ফলে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। তবে, প্রিন্ট বইয়ের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে কাগজ উৎপাদনকে আরও টেকসই করা সম্ভব। যেমন, ইকো-ফ্রেন্ডলি পেপার এবং সাসটেইনেবল প্রিন্টিং পদ্ধতির ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়া ডিজিটাল যুগে লেখক ও প্রকাশকদের জন্য নতুন সুযোগ, চ্যালেঞ্জ উভয়ই তৈরি হয়েছে। যেমন স্ব-প্রকাশনার (Self-publishing) মাধ্যমে অনেক লেখক ই-বুক প্রকাশের মাধ্যমে তাদের কাজ প্রচার করতে পারছেন। তবে, এই বিষয়টি প্রচার ও বিপণনের জন্য প্রয়োজন নতুন কৌশলের । যদিও ডিজিটাল মাধ্যম লেখকদের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে কিন্তু প্রিন্ট বইয়ের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট পাঠক গোষ্ঠী তৈরি করা সম্ভব।

এদিকে দেখা যাচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রেও বেড়েছে ই-বুকের প্রচলন । ছাত্রদের জন্য তথ্য সংগ্রহ ও নোট করার ক্ষেত্রে ডিজিটাল বইয়ের ব্যবহার সবকিছু সহজ করে দিচ্ছে। তবে, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রিন্ট বইয়ের ব্যবহার এখনো অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং শিক্ষার ক্ষেত্রে দুই ধরনের বইয়েরই একটি সুষম মিশ্রণ প্রয়োজন।

যদিও এটি সত্য যে ই-বুকের উত্থান প্রিন্ট বইয়ের চাহিদাতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে তবে এটি সম্পূর্ণরূপে প্রিন্ট বইয়ের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না। 



আরো পড়ুন