আমরা যারা কর্মজীবী, কাজ করি সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, তাদের জীবন সাধারণত দুই শিফটেই বাঁধা। এক শিফট পরিবারের দায়িত্ব পালন, অন্য শিফট কর্মস্থলের কার্যসম্পাদন। বাসা টু কর্মস্থল, এর বাইরে আমাদের অনেকেরই কোনো জগৎ নেই। এই কঠিন রুটিনবাঁধা জীবনযাপনে অনেকেই হাঁপিয়ে উঠলেও মুক্তির উপায় কী? সেই উপায় বের করলো বাইসাইকেল চালকদের সংগঠনগুলো। তেমনই একটি বহুল জনপ্রিয় সংগঠন ‘হেমন্ত রাইডার্স’। সংগঠনের ফেসবুক গ্রুপ থেকে অ্যাডমিন একদিন ঘোষণা দিলেন, ‘২৪ মে, শুক্রবার পান্তা রাইড’ হবে। শুক্রবার সকাল ৬ টা ২০ মিনিট রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউস্থ রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়ে সামনে থেকে রাইডিং শুরু হবে। গন্তব্যস্থল ‘ধলেশ্বরী ক্যাম্পিং ও কায়াকিং’। বিষয়টি গত ১৪ মে আমাকে জানালেন সাইক্লিস্ট কায়সার আহমেদ ভাই। এরপর একটি ফরমের লিংক দিলেন। ফরমটি পূরণ করলাম। এরপর অপেক্ষার পালা। দিন যায়, রাত যায়, ২৪ মে যেন আর আসতে চায় না। ভেতরে ভেতরে প্রথম প্রেমে পড়ার মতো উত্তেজনা কাজ করছে। কিন্তু কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি না। এর কারণও আছে।
আমার চারপাশে বিষয়টি নিয়ে শেয়ার করার মতো কেউ ছিলেন না। যারা আমার মতো সাংবাদিকতায় রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই অফিসের প্রাইভেটকারে চলাফেরা করেন। বাইসাইকেল চালান না। যদিও নিজের প্রাইভেটকার নেই, তবু অনেকেরই আবার বাইসাইকেলের প্রতি নাকসিঁটকানো স্বভাবও রয়েছে। আর প্রাইভেটকারের প্রতি রয়েছে অসনীয় মোহ। এর বাইরে পরিচিতজনদের মধ্যে কেবল কায়সার ভাই-ই বাইসাইকেলে চলাফেরা করেন। যদিও তাঁর নিজেরই প্রাইভেটকার রয়েছে। তিনি আবার এসব রাইডে অভিজ্ঞ ও পুরনো মানুষ। ফলে তাঁর সঙ্গে নিজের ভেতরের উত্তেজনার বিষয়টি শেয়ার করতে বিব্রতবোধ করছিলাম।
সে যাই হোক, কায়সার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ঘুমুতে গেলাম। মোবাইলফোনে অ্যালার্ম দিলাম ভোর সোয়া চারটা। কিন্তু আমার ঘুম ভেঙে গেলো পৌনে চারটায়। কী আর করা, প্রত্যাশার আগেই ফল পেলে সাধক যেমন কৃতজ্ঞতায় ফলদাতার প্রতি নুয়ে আসেন, আমিও তেমনি আবেগে থরোথরো। উঠে বসলাম। আমার রকরাইডার বাইসাইকেলটির চেইন পরিষ্কার করলাম। এরপর লুব করলাম। যেন সাইকেল স্মুথলি চলে, আর গতিতেও সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি।
এবার ধলেশ্বরী নদী পারের অপেক্ষায়। উপায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা। তিন পর্বে আমরা সবাই নদী পার হয়ে পৌঁছালাম পূর্বনির্ধারিত ভেনু ‘ধলেশ্বরী ক্যাম্পিং ও কায়াকিংয়ে।’ ভেনুতে পৌঁছেই তৃষ্ণার্তদের জন্য পাওয়া গেলো গুড়ের শরবত। এরপর কেউ ধলেশ্বরী ক্যাম্পিংয়ে শুয়ে, কেউ বসে গান ধরলো। কেউবা ঘুরে ঘুরে দেখলো নদীপাড়া, পাড়ের মানুষ, ফসলের ক্ষেত। আমগাছ, সবজির বাগান। কেউ বা ব্যস্ত হয়ে পড়লো পান্তা ব্যবস্থায়। এরপর এলো পান্তা খাওয়ার কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। সবার লাইন ধরে একে একে চলেছি বিতরণকারীর দিকে। বিতরণকারী আমাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন চমৎকার মাটির বাসনে পান্তা। সঙ্গে ডিম ভাজি, আলুভর্তা, শুকনো মরিচ, ডাল ভর্তা। এরপর আরেক বিতরণকারী আমাদের হাতে হাতে তুলে দিলেন চমচম।
কোনো তাড়াহুড়ো নেই, সবাই যেন পুরাণের ঋষি। সবার মুখাবয়বে একটি শান্ত-সৌম্য কান্তি ভেসে উঠলো। তাঁরা ধীরে, খুব ধীরে পরম তৃপ্তির সঙ্গে পান্তা আহার সারলেন। এরপর চমচম। চমচম নিয়ে একটি ঘটনা আছে এখানে। চমচম পান্তা রাইডের মেনুতে ছিল না। চমচম পেলাম বাইকশপ বিডির মালিক সাইক্লিস্ট শাকিল ভাইয়ের সৌজন্যে। তিনি সদ্য কন্যাসন্তানের জনক হয়েছেন। সেই মিষ্টি। তবে, ভাবি হাসপাতাল থাকায় তিনি পান্তা রাইডে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। সব শেষে ছিল চা। চা-পর্ব শেষে ছবি তোলা।
পান্তা রাইডের পান্তা খাওয়া শেষ। এবার ভাঙলো মিলনমেলা। কেউ কেউ নিজের মতো করে ফিরতি পথ ধরলেন। তবে, যে পথে গন্তব্যে পৌঁছালাম, ফেরার সময় সেই পথ ধরলেন না কেউ। ধরলেন বিকল্প পথ। ফেরার পথে ঢালিকান্দি বাজার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে কলাতিয়া বাজার। এরপর জয়নগর তিন রাস্তার মোড় থেকে বামে মোড় নিয়ে ঘাটারচর। ঘাটারচর হয়ে বছিলা ব্রিজ থেকে নেমে বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা হয়ে মোহাম্মদপূর বাস স্ট্যান্ড দিয়ে আসাদগেট। দীর্ঘ বহরের একসঙ্গে রাইডের আপাত শেষ স্টেশন এই আসাদ গেট। সেখান থেকে আমি চলে এলাম গুলশান-১ নম্বরে পুলিশ প্লাজার কাছে আমার কর্মস্থল ঢাকা বিজনেস কার্যালয়ে। সঙ্গে নিয়ে নিয়ে এলাম ৬৪ কিলোমিটার সাইকেল ভ্রমণের এক অপূর্ব অনুভূতিমাখা অভিজ্ঞতা। বহুদিন মনে থাকবে এই হেমন্ত রাইডার্সের পান্তাবেলা ‘পান্তা রাইড’।