দর্শকের পছন্দের তালিকায় সবসময় অ্যাকশন সিনেমা সবার উপরে স্থান পায়। সময়ের সঙ্গে সেটা যেন বেড়েই চলেছে। সিনেমার পাশাপাশি অ্যাকশন সিনেমা গেমের প্রতিও আগ্রহ বেড়েছে, বিশেষ করে তরুণরা এই ধরনের সিনেমা এবং গেম পছন্দ করেন। তবে আমরা অনেকেই জানিনা অ্যাকশন ধাঁচের সিনেমা এবং গেম আমাদের আনন্দ দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায় তৈরি করে। এমনকি মানসিক বিকাশকে বাধা দেয়।
মানুষের সহিংস হয়ে ওঠের কারণ জানতে মনোবিজ্ঞানে অনেক গবেষণা হয়েছে। অহিংস যোগাযোগের প্রবক্তা মার্কিন মনোবিজ্ঞানী মার্শাল রোজেনবার্গের মতে, মানুষ জন্মগতভাবে সহিংস নয়। মানুষ মূলত চারপাশের পরিবেশ থেকে দেখে সহিংসতা শেখে।
সোশ্যাল লার্নিং থিওরির প্রবক্তা কানাডিয়ান-আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট বান্দুরা ষাটের দশকে শিশুদের আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন। গবেষণাটি ‘বোবো ডল এক্সপেরিমেন্ট’ নামে পরিচিত। সেই গবেষণায় মোট ৭২ শিশুকে তিনটি দলে ভাগ করা হয়। প্রথম দলের শিশুদের সামনে একজন তরুণ মডেল একটা বোবো ডলকে (মানুষ আকৃতির পুতুল) সহিংসভাবে শারীরিক আঘাত করে এবং মৌখিকভাবেও তিরস্কার করে। দ্বিতীয় দলের শিশুদের সামনে প্রাপ্তবয়স্ক মডেল বোবো ডলের সঙ্গে এই ধরনের কোনো আচরণ না করে স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের সঙ্গে বিভিন্ন খেলনা দিয়ে খেলে। সবশেষ দলটির সামনে প্রাপ্তবয়স্ক কোনো মডেল উপস্থাপন করা হয় না। তিনটি দলেরই শিশুদেরকে ছেলে এবং মেয়ে উপদলে ভাগ করা হয়। ছেলেদের সামনে ছেলে মডেল এবং মেয়েদের সামনে মেয়ে মডেলকে উপস্থাপন করা হয়। পরে দেখা যায়, যে দলের শিশুরা তরুণ মডেলের মাধ্যমে বোবো ডলকে সহিংসভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেখেছে, তাদের মধ্যে অন্য দলগুলোর তুলনায় আক্রমণাত্মক আচরণ বেশি দেখা গেছে। এই পরীক্ষায় মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুদের মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণের প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।
খুন ও মারামারি আছে, এই ধরনের অ্যাকশন বা থ্রিলার সিনেমা কিংবা ভিডিও গেমে সহিংসতা দেখার যে ক্ষতিকর প্রভাব, তার সঙ্গে এই পরীক্ষণের ফলাফল সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। সাধারণত এ ধরনের সিনেমা বা ভিডিও গেমের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে সহিংস আচরণ, যেমন মারপিট, গোলাগুলি, হামলা ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ্য পূরণ বা দাবি আদায় করতে দেখা যায়। এ ধরনের সিনেমা বা ভিডিও গেম যারা পছন্দ করে ও নিয়মিত দেখে, তাদের মধ্যে অবচেতনভাবেই সহিংস আচরণ অনুকরণের প্রবণতা তৈরি হতে পারে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাইলে সিনেমা বা ভিডিও গেমে সহিংস আচরণ দেখার ক্ষতিকর দিকগুলো হলো—
সংবেদনশীলতা হ্রাস: ভার্চ্যুয়াল জগতে সহিংসতা দেখা শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে নিষ্ঠুরতা বিষয়ে নির্লিপ্ততা চলে আসতে পারে। বাস্তব জীবনে ঘটা সহিংস আচরণ তাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হতে পারে, অন্যের দুঃখকষ্টে সমব্যথী হওয়ার পরিবর্তে তাদের মধ্যে দেখা দিতে পারে নির্বিকারত্ব। সুস্থ–স্বাভাবিক একজন মানুষকে অন্যের দুঃখকষ্ট আবেগপ্রবণভাবে তাড়িত করে। অন্যের বিপদে সুরক্ষা দেয়ার ইচ্ছা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। কিন্তু সহিংস ভিডিও দেখতে থাকা ব্যক্তির মধ্যে এই মানবিক গুণের বিকাশ নাও ঘটতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি: গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত সহিংস ভিডিও বা চলচ্চিত্র দেখলে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ বাড়ে। সহিংসতার ভিডিও বা গ্রাফিক চিত্র তরুণদের মস্তিষ্কে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, তাতে তাদের অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে এবং দেখা দিতে পারে ঘুমের সমস্যা। দীর্ঘদিন এমনটা চলতে থাকলে মানসিক রোগের দিকে যেতে পারে।
সম্পর্কের ওপর প্রভাব: সিনেমা বা সিরিজে শেখা সহিংস আচরণ আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মমত্ববোধের অভাব ও আক্রমণাত্মক আচরণ তরুণদের সুস্থ সামাজিক সম্পর্কগুলো তৈরি করতে এবং বজায় রাখতে বাধা তৈরি করে। ধীরে ধীরে তারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে।
সহিংস আচরণ: সহিংস ভিডিও বা বিষয়বস্তুর সংস্পর্শ শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে আক্রমণাত্মক চিন্তা, মনোভাব এবং আচরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিভিন্ন সিনেমা বা ভিডিও গেমে সহিংস আচরণকে পুরস্কৃত হতে দেখলে বা সহিংস আচরণের মাধ্যমে কোনো উদ্দেশ্য সফল হতে দেখলে তাদের মধ্যে সেই আচরণ অনুকরণের প্রবণতা দেখা দেয়।
মিন ওয়ার্ল্ড সিনড্রোম: অনবরত সহিংসতার সংস্পর্শ তরুণদের মধ্যে পৃথিবী সম্পর্কে একটি বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে, মানুষ মাত্রই সহিংস এবং পৃথিবীটা একটি খারাপ জায়গা। ফলে ভয়, সন্দেহ ও অন্যদের প্রতি অনাস্থা বেড়ে যেতে পারে।
গবেষণা থেকে এটাও জানা গেছে যে সহিংস সিনেমা বা ভিডিও গেম সবার ক্ষেত্রে সমান প্রভাব ফেলে না। ব্যক্তি ভেদে এটা আলাদা। ব্যক্তির মেজাজ,পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক অবস্থা ইত্যাদির ভিত্তিতে এর প্রভাব নির্ভর করে। যারা সহিংস সিনেমা বা ভিডিও গেমে আসক্ত হয়েছেন তারা নিজের মধ্যে পরিবর্তন দেখলে সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করতে পারেন যাতে। হয়তো সমস্যা হচ্ছে না ভেবে এড়িয়ে যাচ্ছেন কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই অভ্যাস ব্যক্তি জীবনে প্রভাব ফেলতেপারে তাই এখনই সাবধান হতে পারেন।