২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

একলা বৈশাখে সাংস্কৃতিক দোটানা

শফিক হাসান || ০৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১২:০০ এএম
একলা বৈশাখে সাংস্কৃতিক দোটানা


পক্ষের লোকজন যখন বক্তব্য দেয়, মনে হয়—হাছাই তো! আবার বিপক্ষ মতের মানুষজন গোছানো কথা বললে সেটাকেও সমর্থন না দিয়ে পারে না বাতেন উদ্দিন। এটা কেমন অবস্থান—যখন যা শোনে মনে হয় এরচেয়ে সুন্দর কথা আর হয় না! কম দামের একটি দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত চোখ বোলায় সে। আগে নাটক-সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের রঙিন খোলামেলা ছবি দেখার জন্যই পেপারে চোখ রাখত। ধীরে ধীরে অন্য পাতাগুলোতেও মজা পেয়ে গেছে বাতেন। পরিচিত যারা পেপার কেনে, তাদের কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে ইদানীং সে উপসম্পাদকীয় পাতাও পড়ছে। হালকা থেকে ভারি, রোমহর্ষক ও চটকদার খবরগুলো তো আছেই। গতকাল একটি কলাম পড়েছে। শিরোনাম—ইলিশের অগ্নিমূল্য, তবু কেন বিকল্প খুঁজি না!

ইলিশের উপরে ভোক্তাদের মাত্রাতিরক্তি চাপ কমানোর দিকে জোর দিয়েছেন লেখক খবীর মঞ্জুর। তরমুজের মতো কিছুদিন ক্রেতারা ইলিশও বয়কট করলে সুড়সুড় করে দাম কমে আসত। ইলিশ হতো লইট্টা মাছের মতো অনাদরণীয়! এখানটায় এসে কলামিস্টের সঙ্গে একমত হতে পারল না বাতেন। ইলিশ এমন মাছ সিজন বা আনসিজনে কোনো রিজন ছাড়াই চড়ামূল্য ধরে রাখে। অবশ্য ভারতবিদ্বেষীরা দাবি করে দেশটিতে রপ্তানি করার কারণেই স্বদেশের বাজারে দাম কখনো কমে না। তেলওয়ালা, ভালো মানের ইলিশগুলো এই কারণেই পাওয়া যায় না বাজারে। অবশ্য দাম যত বেশিই হোক, ইলিশের ক্রেতার কখনো অভাব হয় না। স্বচক্ষে কতই দেখেছে বাতেন—পাঁচ হাজার টাকা কেজি হোক কিংবা বিশ হাজার—যে দামই হাঁকুক মেছো, ক্রেতা অরাজি বা অখুশি কিছুই হয় না। অন্য ক্রেতা হাত দেওয়ার আগেই সটাসট কিনে ফেলে ব্যাগে পোরে! এত টাকা মানুষের, কোত্থেকে আসে কাঁড়ি কাঁড়ি জোগান! কলামে সেসবের বিন্দুমাত্র উল্লেখ কিংবা প্রশ্ন নেই। বরং উপসংহারে লেখক বলছেন—‘বেড়াল যদি বাঘের মাসি হতে পারে, তাহলে ইলিশের বিকল্প হিসেবে আমরা কেন পুঁটি মাছ খেতে পারব না? ইলিশকে এখনো জাতীয় মাছের মর্যাদায় অভিষিক্ত রাখা উচিত হবে কিনা, ভাবার সময় এসেছে!’ 

বিশেষ করে ‘বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায়রে, মেলায় যাইরে’ গানটি যে একই সঙ্গে বসন্ত, কনের গায়ে হলুদ, হলুদ রঙ ও মশলা-জাতীয় হলুদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সেদিকে সবিস্তার আলোকপাত করেছেন লেখক।

ফের হাসল বাতেন। অভিন্ন রকম চকচকে আঁশ হলে, রোদে নতুন টিনের মতো ঝিলিক দিলেই কি পুঁটি মাছ ইলিশ হয়ে যায়? তাছাড়া নোয়াখালীর লোকছড়ায় আছে—

ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁডা 
বোয়াল মাছের দাড়ি
সকিনারে নিতো আইছে 
বজরার গাড়ি।

ইলিশ ও বোয়াল এমনই খান্দানি মাছ, সকিনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে বজরা থেকে গাড়ি আসে। মাছের সঙ্গে মিলিয়ে এর ভোক্তার আভিজাত্যও কম নয়!

খবীর মঞ্জুর প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলো উত্থাপন না করলেও চর্বিতচর্বণে পিছিয়ে থাকলেন না—‘একলা তথা পহেলা বৈশাখ আমাদের সর্বজনীন প্রাণোৎসব। এই উৎসব-আয়োজনকে রঞ্জিত করতে ইলিশের আবির্ভাব ঘটল কবে থেকে? হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিতে পান্তা-ভাত বরাবরই ছিল। কিন্তু ইলিশের এমনতর ব্যবহার, শুঁটকির ভর্তার অনুপ্রবেশ গভীর কোনো ষড়যন্ত্র নয় তো? বিদেশি কোনো চাল, নিদেনপক্ষে সংস্কৃতিবিমুখদের আঁতাত নেই তো নেপথ্যে!’

এমন যুক্তিতেও বাতেনের না হেসে উপায় থাকে না। ইতোমধ্যে সে নিজেও ছোটখাটো গড়নের একজন বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়েছে। দিব্যজ্ঞানে জানে—খানাপিনার জন্য কোনো একটা উছিলা বের করে এই জাতি শুধু খায় আর খায়! আর সুযোগ বুঝে গীত গায়। অবশ্য উৎসব-আমেজে খাদ্য-মাস্তির সামর্থ্য থাকলে বাতেন নিজেও যে কব্জি ডোবানোর পাঁয়তারা কষত না—হলফ করে বলতে পারে না। নিজে পিছিয়ে থাকলেই কেবল তুচ্ছ কারণে শক্তিধরদের গালমন্দ করা যায়। অকারণে অন্যের ভুল ধরা যায়!

দুই.
পুঁটি মাছ কীভাবে ইলিশের যমজ ভাই হতে পারে—এমন চিন্তাশীল ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই চলে আসে পহেলা বৈশাখ। যে কোনো উৎসব মানেই যে একগাদা টাকা জলে ফেলার বাহানা, সেটা সংসারের উপার্জনক্ষম একমাত্র পুরুষের চেয়ে ভালো আর কে জানে!

সাতসকালেই বাতেনের বউ মরিয়ম নেসা সেজেগুজে প্রস্তুত। খোঁপায় সুগন্ধি ফুলের মালাও জড়িয়েছে। ঘুমন্ত বাতেনের পা ধরে ঝাঁকুনি দেয়—‘আর কত ঘুমাইবা? চল এইবার। দেরি অইলে ব্যান্ডের গান শুনবার পারমু না!’

ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বাতেন বলে, ‘কই যামু, কেন যামু, গিয়া কী করমু?’
‘ভুইলা গেছ সব? বৈশাখী মেলায় যামু না আইজ?’
‘আরও পরে যামু। এখন ঘুমাইতে দাও।’
‘না। পরে রইদ চইড়া যাইব। আর আমারও বহুত কিছু কিননের আছে আইজ। হাঁটতে হাঁটতে পছন্দ কইরা কিনমু। তোমার রিকশা ভাড়া বাঁচাইয়া দিমু।’ 

কেনাকাটার কথা শুনে ঘুম টুঁটে গেল বাতেনের। আবার কী, গত মাসেই তো কত অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনল মরিয়ম। তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল সে। বলল, ‘নতুন কইরা আর কী কিনবার চাও? দেখবা শুধু রঙ-তামাশা। কিননের চাইতে রঙঢঙ দেখনে মজা বেশি!’

‘বৈশাখ মাইস্যা মেলায় খাজা-গজা ছাড়া আরও বহুত কিছু পাওন যায়। রুটি বানানির তাওয়া কিনমু, আলতা-পাউডার, লেইস-ফিতাসহ আরও কিছু জরুরি জিনিস আছে। তুমি তাড়াতাড়ি মুখ ধুইতে যাও। তারপর খাইলে খাও, না খাইলে হাঁটা ধর।’

নাস্তা খেতে খেতে, এই মুহূর্তে শ্যালিকা মর্জিনার অভাব তীব্রভাবে অনুভব করল বাতেন। গত বছরের বৈশাখী মেলায় তিনজন গিয়েছিল একসঙ্গে। মর্জিনা যখনই বেড়াতে আসে, বাতেনের খুশি আর ধরে না। সব পুরুষই কি ওর মতো—বউয়ের চেয়ে শ্যালিকাকে বেশি ভালোবাসে! বউয়ের সঙ্গে বিয়ে না হয়ে শ্যালিকার সঙ্গে হলে কতই না ভালো হতো। নিজ দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে একটা দীর্ঘশ্বাস আলগোছে বাইরে পাচার করে সে।

রাস্তায় নেমেই খানিক আগের অপ্রাপ্তিজনিত দুঃখ ভুলে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে বাতেন। কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে, জমিনে। রাস্তায় সুবেশ-সুবেশী নারী-পুরুষের ঢল। রঙচঙে সব পোশাক পরে প্রজাপতির মতো পাখা মেলে উড়ছে যেন সবাই। এমন চমৎকার দৃশ্য দেখলে কার না মন ভালো হয়। বাতেনের খুশিকে আরও বাড়াতে (অথবা কমাতে!) চলন্ত রিকশার হুড পেরিয়ে উঁকি দিল সুন্দর একটি নারীমুখ—‘ও বাতেন ভাই, মেলায় যান বুঝি?’

তিনা ভাবিকে দেখে দ্বিগুণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল বাতেন—‘হ, ভাবি। মেলায় যাই। আপনে যান, দেখা অইব।’

বিষয়টা ভালো লাগল না মরিয়মের। গম্ভীর হয়ে উঠল—‘এই মাতারি কি তোমার সেকেন্ড ওয়াইফ?’

কীসের সঙ্গে কী! মরিয়ম এত ছোট মনের মানুষ। অথচ এখানে মর্জিনা থাকলে কোনোভাবেই এমন না-ঢক বেমক্কা প্রশ্ন করত না। তিনা ভাবি কত ভালো মানুষ। অনেকের বাসাতেই তো এলপি গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করে বাতেন। অন্যরা যেখানে গ্যাসের দামের সঙ্গে ওর পারিশ্রমিক বাড়তি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বিদায় করে, সেখানে তিনা ভাবি বরাবরই বাতেনকে চা-বিস্কুট ও ফ্রিজের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করান। কী সুন্দর আচার-ব্যবহার। নিশ্চয়ই ভাবি বড় বংশের মেয়ে। সব মিলিয়ে বাতেন চায়, ভাবির গ্যাস যেন মাসে তিনবার শেষ হয়। কিন্তু সেটা কখনোই হয়নি এখন পর্যন্ত!

মেঘকালো গম্ভীর মুখে বউকে জবাব দেয় বাতেন—‘যা মনে আসে, কইয়া বইসো না তো, মরিয়ম। এই ভাবি আমাগো দোকানের ভালা কাস্টমার। কোনোদিন টাকা বাকি রাখে না। বাকি চায়ও নাই।’
‘তাইলে একলা কই যাইতাছে? মাতারির জামাই কই?’
‘কার জামাই কোন কামে ব্যস্ত আছে, হেই খবর কি আমারে দিব তারা?’
‘আমি লগে না থাকলে এই মাতারি তোমারে ঠিকই রিকশায় তুইলা নিত। তুমিও বেশরমের মতো উইঠা যাইতা!’

সম্ভাবনাটা কল্পনা করে ফের খুশি হয়ে ওঠে বাতেন। সত্যিই, তিনা ভাবির সঙ্গে এক রিকশায় চড়া গেলে কী দারুণ ব্যাপারই না হতো! ভাবি কি ওর কাঁধে হাত রাখতেন? কিংবা হাতে হাত! চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসতেন না প্রেমিকার মতো করে?’

তিন.
বৈশাখের প্রখর রোদ চান্দি ভেদ করে যেন মগজে ঠোকর মারছে! এর মধ্যেই মরিয়মের জন্য বেশকিছু কেনাকাটা সেরেছে বাতেন। বানরকে দিয়ে ভাগ্য গণনা কিরয়েছে দুজনেরই। বানর ইশারা-ইঙ্গিতে যা বলেছে, বানর-মালিক সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছে। 

স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ভাগ্য ভালো, তবে বানরের জন্য বেশি করে দুধ-কলা কেনার টাকা দিলে ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন হয়ে যেতে পারে। বাতেন বলতে চেয়েছিল—‘আপনার বানর দুধ খাওয়া শিখল কবে থেকে?’ জ্যোতিষীর অভিশাপ লাগতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে বলেনি আর। মুখ বন্ধ রাখলে শত্রুতা এড়ানো যায়, বিপদও কম হয়।

একটু দূরে ছেলে-মেয়েরা কোরাস গাইছিল—‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...।’

খাড়া কান নিচু করে ব্যঙ্গোক্তি করল জ্যোতিষী—‘হ। তোগো এই গান হুইনাই বৈশাখ আইব, নইলে আইত না। বৈশাখ রাগ কইরা ইন্ডিয়া চইলা যাইব!’

তখন বাতেনের মনে পড়ল গত পরশু কাগজে পড়া হেমলক আহসানের কলাম-শিরোনাম—‘একলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ও হলুদ শাড়ির কথকতা’। সেখানে তিনি বৈশাখ-চেতনায় গান ও বন্দনাগীতির মর্মস্পর্শী গভীরতা বিশ্লেষণ করেছেন। বলেছেন, গানই পারে মুক্তি দিতে। বিশেষ করে ‘বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায়রে, মেলায় যাইরে’ গানটি যে একই সঙ্গে বসন্ত, কনের গায়ে হলুদ, হলুদ রঙ ও মশলা-জাতীয় হলুদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সেদিকে সবিস্তার আলোকপাত করেছেন লেখক।

মরিয়ম বেশ কিছুক্ষণ যাবত হাত ধরে রেখেছে বাতেনের। এবার মুঠোবন্দি হাতে একটু চাপ দিয়ে বলল, ‘চল, এবার চুড়ি কিনি।’

‘এত সুন্দর হাতডারে খাঁচায় বাইন্ধা রাখবার চাও? চাইলে কী আর করা! চল।’

পশরা সাজিয়ে বসে থাকা একজন চুড়িওয়ালির সামনে দাঁড়াল দুজন। মরিয়ম কাচের চুড়িতে হাত দিলে একটির সঙ্গে অন্যটি লেগে রিনিঝিনি বেজে উঠল। আচানক বাতেনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল—‘খুব সুন্দর।’

বাতেন মাঞ্জা মেরে একাই এসেছিল মেলায়। পান্তা-ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল সাতশ’ টাকা প্লেটে, এই একই খাবার নিজ হাতে খাইয়ে দেবে একজন সুন্দরী তরুণী। সেক্ষেত্রে গুনতে হবে এক হাজার টাকা!

শুনে মিষ্টি করে হাসল চুড়িওয়ালি। তার দাঁতগুলো পরিপাটি সুন্দর—এখানটাতে অন্তত দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। বলল, ‘হ ভাই, আইজ আপনের মতো আরেকজনও আমার রূপের প্রশংসা করছে। আমি আগে আরও সুন্দরী আছিলাম। রইদে পুইড়া পুইড়া ব্যবসা করি, কিরিম বেচি কিন্তু মুখে মাখবার পারি না; বোঝেনই তো সমস্যাডা কত বড়!’

লাভা উদগীরণের আশঙ্কা থেকে বিব্রত হলো বাতেন। বলল, ‘আমি চুড়ির কতা কইছিলাম।’

‘কী কন ভাই, সুন্দর মানুষের জিনিসপাতিও সুন্দর অইব না! আমার দোকানের সবকিছুই ভালা, সুন্দর। এমনকি আমার কাস্টমারগুলাও খুব ভালা, লক্ষ্মী!’

এবার রাগ না ঝেড়ে উপায় থাকে না মরিয়মের। হাতে থাকা চুড়িগুলো ছুড়ে মারে সজোরে—‘সুন্দর নাকি অসুন্দর, তোমারে জিগাইছিলাম, বাতেন মিয়া?’

বউ-জামাইয়ের ঝগাড়াঝাটির মধ্যেই সুন্দরী চুড়িওয়ালি হিসাবে মত্ত হলো, কত টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। খদ্দের নষ্ট করেও রূপগর্বে গরবিনী সে; বোঝা যাচ্ছে উদ্ধত আচরণে।

বাতেনকে নিরুত্তর দেখে ফের মুখরা হলো মরিয়ম—‘আমার তো একটা চুড়িও পছন্দ অয় না, তোমার কেমনে পছন্দ অইল? কী বুঝাইতে চাইতেছ! মাতারিরা সব সুন্দরী আর ঘরের বউ পেতনি-ডাইনি? বাসায় চল আইজ, হিসাব চুকামু। আর কারে কারে তোমার ভালা লাগে, জিগামু।’

একদিকে বৈশাখের রুদ্ররূপ, অন্যদিকে বউয়ের রণমূর্তি। দিশেহারা অবস্থার মধ্যেই বাতেন ছুটল আইসক্রিমের গাড়ির দিকে। আইসক্রিম খেলে যে মাথা ঠাণ্ডা হয়, আজ বড় প্রমাণ পেল সেটার। তরল গলায় মরিয়ম বলল, ‘চল এইবার অন্য দোকানে যাই। এখন বেডা মানুষের কাছে যামু, তুমি য্যান সুন্দর কইবার না পারো!’ 


চার.
লোকে ও বিজ্ঞানীরা ঠিকই বলে, পৃথিবীটা গোল। নইলে তিনা ভাবির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়ে যাবে কেন? বাতেন তো সৌজন্যবশত বলেছি দেখা হবে। সত্যি সত্যিই দেখা হয়ে গেল, এই লাখ লাখ লোকের ভিড়েও!

তিনা ভাবি সহাস্যে এগিয়ে এলেন। অচেনা মরিয়মকে দেখিয়ে বললেন, ‘আপনার বউ বুঝি?’

বাতেন ‘জি’ বলতে যাবে, তার মুখের ভাষা কেড়ে নিল মরিয়ম। নম্র অথচ জোরালো কণ্ঠে বলল—‘আপনের কী ধারণা, এই ব্যাডা অইন্য মানুষের বউ নিয়ে ঘুরতে বাইর অইছে?’ 

তিনা ভাবি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললেন, ‘আমি কথার কথা বলেছি, ভাবি। অন্য কিছু মিন করিনি।’

‘আপনের জামাই কার বউরে নিয়া বেড়াইতে বাইর অইছে? আর আপনে একলা ক্যান, বেডামানুষ কই?!

‘আপনাদের দুলাভাই তো বিদেশে থাকে। ওসব দেশে বৈশাখী উৎসব উদযাপন হয় না। আর অন্যের বউ নিয়ে বেড়ানো দূরে থাকুক—নিজের বউ-জামাই নিয়ে বের হওয়াই কঠিন! দেশের মতো স্বাধীনতা বিদেশে মেলে না, ভাবি।’

তর্কাতর্কি লাগেনি, ভাবি ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন দেখে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বাতেন। উন্মত্ত তেজে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয় বৈশাখী ঝড়, তেমনি বউও। দুটোই আবার ব বর্গীয়। ব দিয়ে আরও অনেক নেতিবাচক শব্দ আছে—বদ, বজ্জাত, বদমাশ, বখিল, বসন্তের কোকিল, বমি, বকবক...।

মরিয়ম সহজ হলো এবার। বলল, ‘না, ভাবি, আমিও কতাডা ওইভাবে কইতে চাই নাই। মিনমিন করার ইচ্ছাও আছিল না। এখন আহেন, হগলতে মিইলা পান্তা-ইলিশ খাই। এইদিনে নাকি ওইসব খাইতে অয়।’

তিনা ভাবি হেসে বললেন, ‘এমন গলাকাটা দামের পান্তা-ইলিশ এখানে না খাওয়াই ভালো। বাসায় রান্না করে আপনাদের দুজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াব একদিন। একত্রে খাব।’

পরিকল্পনার মোড় ঘুরে যাওয়ায় যুগপৎ আনন্দ-বেদনার দোলায় ভাসল বাতেন। ভদ্রতা করে হরেও নিজে বিল দেওয়ার কথা বলতে হতো। তখন বিপদে পড়তে হতো হয়তো। এত টাকা তো পকেটে, বাসায় বা ব্যাংকে—কোথাও নেই।

ভাবি মরিয়মকে বৈশাখী শাড়ি আর বাতেনকে পাঞ্জাবি কিনে উপহার দিলেন। চটপটি-ফুচকা, মাঠা খাওয়ালেন দুই দফায়। এবার স্বীকার করতে বাধ্য হলো মরিয়ম, ভাবি আদতেই দিলখোলা উদার মানুষ। এমন মানুষের জামাই কেন যে কাছের মানুষ দূরে থুইয়া বিদেশে পড়ে থাকে! সরাসরিই দুঃখ প্রকাশ করল সে।

তিনা ভাবি সহজাত ভঙ্গিতে হাসলেন আবার—‘চলে আসবে সে একেবারেই, কয়েক বছরের মধ্যে। দেশে থেকেইবা কী করত এতদিন—চাকরি করে শান্তি নেই, ব্যবসা করে স্বস্তি নেই। পকেটে বারো মাসই চৈত্রের খরা, আর তাই মাথায় থাকে বৈশাখের তাপ!’

আহা, ভাবির মতো সুন্দর মানুষও এতটা দুঃখ পুষে রাখেন বুকে। বাতেন ফিরে গেল পুরোনো ভাবনায়। বছর তিনেক আগে একলা বৈশাখের দিনে মরিয়ম ছিল বাপের বাড়িতে। বাতেন মাঞ্জা মেরে একাই এসেছিল মেলায়। পান্তা-ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল সাতশ’ টাকা প্লেটে, এই একই খাবার নিজ হাতে খাইয়ে দেবে একজন সুন্দরী তরুণী। সেক্ষেত্রে গুনতে হবে এক হাজার টাকা!

অর্ধেক খাবার ম্যাডামের হাতে পাঁচশ’ টাকায় খাওয়া যাবে কিনা এমন প্রস্তাব দিয়ে ঝাড়ি শুনতে হয়েছিল বাতেনকে। পান্তা দোকানি বিদ্রƒপ করেই বলেছিল, ‘অর্ধেক পিস ইলিশ পার্কে খাইতে অইব না। বাজার থিকা পুঁটি মাছের ভাগা কিইনা রান্না কইরা খান গা। বউ থাকলে ভালা, না থাকলে প্রেমিকা খুঁইজা লন। তারা খাইয়াইয়া দিতে পারব।’

ঘরে-বাইরে জ্বালাতন। সস্তা পত্রিকার কলামগুলোও এখন আর নিতে পারছে না বাতেন উদ্দিন।

তরুণী খাওয়ানেওয়ালিও কেমন মিটমিটিয়ে হেসেছিল বাতেনের অপমানজনক দশায়। সেদিন মনে রোখ চেপে গিয়েছিল; কোনোভাবে যদি সম্ভব হয়, এই মেয়েকেই বিয়ে করে বউ বানাবে বাতেন। তারপর বাসর শয্যা থেকে নামিয়ে বউকে হুকুম দেবে—‘যাও, পান্তা-ইলিশ রান্না করে নিয়ে এসো। রান্নাঘর দেখিয়ে দিচ্ছি। মাছ ভাজা যেন মচমচে হয়। আর ভাত হতে হবে মাড়মুক্ত, ঝরঝরে দানাদার। সঙ্গে পেঁয়াজ কুচি ও শুকনো মরিচ ভেজে দেবে।’

পাঁচ. 
বৈশাখের একসপ্তাহ কাটল নানারকম পেরেশানিতে। তিনা ভাবির সহায়তায় বাতেনও ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। ভাবির সঙ্গে লাইক, কমেন্ট, লাভ রিঅ্যাক্ট, চ্যাট-ফ্যাট নিয়মিতই হচ্ছে। ভাবিসহ দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, অবুদ্ধিজীবী ও অল্প বুদ্ধিজীবীর বসবাস এখন এখানে। এরা যার যার অবস্থান থেকে বৈশাখবন্দনা বা বৈশাখকুৎসা রটিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বিরূপ পক্ষের সমালোচনার শেষ নেই। স্কুলপড়ুয়া এক বুদ্ধিজীবী মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখল—একটি শোভাযাত্রার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘মঙ্গল’। অন্যগুলো কি তাহলে অমঙ্গল শোভাযাত্রা!

আরেক বুজুর্গ সুচিন্তিত মতামত দিয়েছে দাবি করে লিখল—পশুপাখি কীভাবে মঙ্গল প্রতিষ্ঠা করবে? পেঁচা-কাক-বাঘ-ভাল্লুক এসব তো অমঙ্গল ও দুর্ভোগের প্রতীক! 

বৈশাখের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু বিষয়ও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, নবাব সলিমুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য জমি দেননি—এমন উটকো বিতর্ক ও কুতর্কে ভেসে যেতে থাকে ফেসবুকের উঠোন। নতুন নতুন ইস্যু আসতে যেমন সময় লাগে না, তেমনি থামতেও দিনক্ষণের প্রয়োজন হয় না! তবে বিতর্কচর্চার ক্লাস থাকে প্রায় প্রতিদিনই।

বাতেন যে শেষপর্যন্ত কোন পক্ষ নেবে, ভেবে কূল পায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে—আহা, শৈশবই তো ভালো ছিল। বৈশাখ মাস এলে সচ্ছল গৃহস্থদের আম গাছে ঢিল ছুড়ত, গাছ মালিক টের পেলে শাপশাপান্ত করত, সেখানে কিঞ্চিত অপমান থাকলেও এমন গোলকধাঁধা ছিল না। কোন পক্ষ যে সঠিক আর কারা বেঠিক—সহজ সিদ্ধান্তে আসা যায় না। মনে হয়, দুই পক্ষই সঠিক কথা বলছে। 

ব্যক্তিজীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানাবিধ দোলাচলের মধ্যেই একদিন মরিয়ম বায়না ধরে—‘আমারেও ইসমাট ফোন কিইনা দিতে অইব। মার্কেটে কোন দিন যাইবা? সেলফি ভালা উডে, এমন ফোন কিনমু কিন্তু।’

বাতেন অবাক। বলে, ‘তুমি তো নিজেই ইসমার্ট মানুষ। তাইলে ওই ফোন দিয়া কী করবা?’ 

‘অনেক কিছুই করবার পারমু। তয় আগে ফেসবুকে আইডি খুইলা দিবা আমারে। চ্যাট করমু, কতা কমু।’

‘কতা কওনের লাইগা ইসমাট ফোন লাগে নাকি? আর চ্যাট কারে কয়?’
‘তুমি সুন্দর সুন্দর বেডিগো ছবি দেখবার পারতেছ, আমার কি ইচ্ছা অয় না সুন্দর বেডাগো ছবি দেখি?’

এবার আকাশ থেকে খেজুর গাছে পড়ার দশা হলো বাতেনের। মরিয়ম এসব বুঝল কীভাবে! গোপনীয়তা রেখেই তো চালিয়ে আসছিল এতদিন। 
সম্ভাব্য বিপদে শঙ্কিত হওয়ার বদলে বাতেনের চোখে ভেসে উঠল তিনা ভাবি ও পান্তা খাওয়ানো সেই রূপসীর মুখ। এই দুজনের কেউ কখনোই স্মার্টফোন কেনার কথা বলে চাপে ফেলত না তাকে। বউকে স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার বদলে যদি বৈশাখী ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায় বাতেনকে—মন্দ হয় না।

ঘরে-বাইরে জ্বালাতন। সস্তা পত্রিকার কলামগুলোও এখন আর নিতে পারছে না বাতেন উদ্দিন। মনে হয়, কোথাও বুঝি তার কেটে গেছে, উড়ে গেছে ট্রান্সফর্মার, বিকল হয়ে গেছে ট্রান্সমিটার! যতসব লক্ষ্মীছাড়া কথাবার্তা আর আচরণ চতুর্দিকে।



আরো পড়ুন