২৯ জুন ২০২৪, শনিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

ঈদ সংখ্যা: অহেতুক সমালোচনা এবং সাহিত্যের বাজার

অলোক আচার্য || ০৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১২:০০ এএম
ঈদ সংখ্যা: অহেতুক সমালোচনা এবং সাহিত্যের বাজার


বাংলায় পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দের ঢেউ আর সব জায়গার মতো সাহিত্যের বাজারেও লাগে। সেটি হলো ঈদ সংখ্যার আনন্দ। সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে, মানে লেখক ও পাঠকদের কাছে এটি একটি বিশেষ সময় বা অপেক্ষার ক্ষণ। 

বইমেলা শেষ হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। তারপর আবার এই ঈদ সংখ্যার আয়োজন। সবমিলিয়ে সাহিত্য একটি গতি লাভ করে। প্রাণ ফিরে পায়। তবে কিছু প্রশ্ন কিছু দ্বিধা রয়েছে। সেটি হলো এই যে এত এত ঈদ সংখ্যা বেরুচ্ছে, বাজারে আসছে বলে পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকে ঘোষণা দিচ্ছেন, সেগুলো লেখকের বাইরে পাঠক কতজন কিনছে, খোঁজ নিচ্ছে বা পড়ছে? অথচ প্রায় পরিচিত জাতীয় দৈনিক, স্থানীয় দৈনিক, অনলাইন পত্রিকা, ই-পেপার রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ঈদ সংখ্যা বাজারে আনছে। লেখকরা খোঁজ নিচ্ছেন তার লেখা ঈদ সংখ্যায় থাকছে কি না। এছাড়া পাঠকরা খোঁজ নিচ্ছেন কমই। কারণ আজকাল তো পাঠক প্রায় মরেই গেছে। 

যদিও তরুণ লেখকদের সুযোগ কমই থাকে ঈদ সংখ্যাগুলোতে লেখার। সেটাও ওই ব্যবসায়িক কারণেই। কিন্তু সুযোগ দেওয়া উচিত। 

গত কয়েক বছর ধরেই লক্ষ করছি ঈদ সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো বাগ্‌যুদ্ধ চলে। অর্থাৎ ঈদ সংখ্যা প্রকাশের আগে লেখকরা দুটি দলে ভাগ হন। একদল হলো যারা ঈদ সংখ্যায় লিখছেন এবং আরেক দল হলো যাদের লেখা ঈদ সংখ্যায় থাকে না বা লেখেন না। তবে ঈদ সংখ্যায় লিখতে চান না এমন লেখক পাওয়া যাবে খুব কমই। এই দুই শ্রেণীতে ভাগ হয়ে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম গরম হয়ে ওঠে। তা উঠুক। এটাও তো এক ধরনের আলোচনা। আবার কে ঈদ সংখ্যা ভালো করছে আবার কে মানসম্পন্ন করতে পারছে না, সেটিও আলোচনা হচ্ছে। এই ঈদ সংখ্যার লেখকদের মধ্যেও রয়েছে দুই শ্রেণী। প্রথম শ্রেণী হলো সাহিত্য সম্পাদকরা যাদের কাছ থেকে লেখা চেয়ে নেন আর অন্যরা হলো যারা নিজ উদ্যোগে লেখা সাহিত্য সম্পাদকের কাছে পাঠান এবং কাকের মতো প্রহর গুনতে থাকেন তার নামটি ঈদ সংখ্যার সূচিতে আছে না নেই তা দেখার জন্য। না থাকলে হতাশ হন একথা বলাই বাহুল্য। তবে থাকলে আবার গর্ব সূচক বক্তব্য দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন! 

এই অবস্থাই চলছে। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে যে, সত্যি কি এত এত ঈদ সংখ্যার দরকার রয়েছে? সাহিত্যের মান কি সকলে বজায় রাখতে পারছে? একই লেখক বা কবি বহু পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় লিখছেন। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, তার সব লেখা মানসম্পন্ন হয়নি। কেউ কেউ চাপে পড়েও লেখা দেন। অর্থাৎ একটা লেখা দিতেই হবে এমন অবস্থা! 

এবার আসা যাক ঈদ সংখ্যার বাজারের কথা। বাস্তবিক অর্থে ঈদ সংখ্যার বাজার ভালো না। মানে যারা লিখছেন তার বাইরে ঈদ সংখ্যা কিনছেন খুব কমই। তাহলে ঈদ সংখ্যা তৈরির উদ্দেশ্য যদিও পাঠককুলকে বিশেষ লেখা পাঠ করানো কিন্তু তা আদতে হচ্ছে না। কিন্তু বাংলা সাহিত্য বিস্তারে বা শক্তিশালী সাহিত্য ক্রমধারায় ঈদ উপলক্ষে প্রকাশ করা বিশেষ সংখ্যাগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ঈদ উপলক্ষে করা এই বিশেষ সংখ্যাগুলো বাংলা ভাষার একটি ঐতিহ্য। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও এত বিপুল আয়োজনে ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হতো না। তখন পত্রপত্রিকার সংখ্যাও ছিল হাতে গোণা। অনলাইন তো ছিলই না। আবার ই-পেপারের অস্তিত্বও ছিল না। কিছু জাতীয় দৈনিক আয়োজন করে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করতো। তখন আবার এসব ঈদ সংখ্যার একটি পাঠক শ্রেণীও ছিল। তারা অপেক্ষাই করতো ঈদে বিশেষ সংখ্যা কিনে পড়ার। 

যেমনটা একসময় ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা নিয়ে দর্শকদের ভিতর ব্যাপক আগ্রহ ছিল তেমন। কিন্তু এখন ঈদের অনুষ্ঠানের দর্শককুলও যেমন উধাও তেমনিভাবে ঈদ সংখ্যার পাঠককুলও উধাও। তাছাড়া কয়েকদিন আগেই তো বইমেলা থেকে বই কেনা হয়েছে। কিছু পাঠক এখনও আছে। যারা আছে তারা সারাজীবনই থাকবে। কিন্তু নতুন পাঠক খুব কমই তৈরি হয়েছে। তবে ঈদ সংখ্যার লেখক কিন্তু বেড়েছে। আয়োজনের কলেবর দেখলেই তা বোঝা যায়। এসব লেখকরাই টিকিয়ে রেখেছেন ঈদ সংখ্যা। ইদানিংকালে এই বিভক্তি অর্থাৎ ঈদ সংখ্যার লেখক এবং না লেখা লেখক বেশিই প্রকাশ্যে এসেছেন। এটা হওয়া উচিত নয়। কারণ লেখা তো লেখাই। যে লিখছে ঈদ সংখ্যায় লিখতে থাকুক। ক্ষতি তো নেই! চাইলে আপনিও লিখুন।

কিন্তু এভাবে একতরফা ঈদ সংখ্যা নিয়ে সমালোচনা করা উচিত নয়। কারণ সম্পাদকরা যথেষ্ট পরিশ্রম করেই একটি ঈদ সংখ্যা তৈরি করে থাকেন। তিনিই ভালো বুঝবেন কার লেখা থাকা উচিত আর কার লেখা থাকা উচিত না। কারণ বাজারেরও তো একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে। কিছু পাঠকের কাছে তো বিক্রি করতে হবে। তা না হলে আর সেটা ঈদ সংখ্যা কেন। ঈদ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত থাকে ছোটগল্প,বড় গল্প, অণুগল্প, উপন্যাস, উপন্যাসিকা, কবিতা, ভ্রমণ, প্রবন্ধসহ আরও কিছু বিষয়। এবার বলি ঈদ সংখ্যায় লাভ হয় কোথায়? আমি যদি একটি বই কিনি তাহলে সেখানে একটা উপন্যাস অথবা কয়েকটা গল্প অথবা কিছু কবিতা এসব পাওয়া যাবে। তাও আমাকে আলাদা আলাদা কিনতে হবে। কিন্তু একটি ঈদ সংখ্যার ভেতর থাকে কয়েকটি উপন্যাস, বেশ কিছু ছোটগল্প, বড় গল্প, অনেক কবিতা এবং আরও অনেক আয়োজন। এক মলাটে ঈদ সংখ্যা ছাড়া আর এত আয়োজন কোথায় পাবেন! তাই ঈদ সংখ্যার গুরুত্বটা আলাদা। এরসঙ্গে কিছুই মেলানো যায় না। 

মোটকথা লেখায় বৈচিত্র্যের অভাব থাকে না ঈদ সংখ্যার আয়োজনে। কে লিখতে পারছেন আর কে পারছেন না, সেটা নিয়ে আসলে সমালোচনার কিছু নেই। বা আমি লিখতে না পারলেই ঈদ সংখ্যার মান থাকছে না সেটা বলারও সুযোগ নেই। যারা লিখতে পারছেন তাদের জন্য শুভকামনা। এরসঙ্গে যোগ করা যায় যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেধাবী সাহিত্যিকদের যদি এখানে লেখার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে অনেক ভালো লেখক-কবি উঠে আসবে নিশ্চিত। যদিও তরুণ লেখকদের সুযোগ কমই থাকে ঈদ সংখ্যাগুলোতে লেখার। সেটাও ওই ব্যবসায়িক কারণেই। কিন্তু সুযোগ দেওয়া উচিত। 

ঈদ সংখ্যা নিয়ে এসব অহেতুক সমালোচনা বন্ধ হোক এবং সাহিত্যের অবারিত দ্বার প্রসারিত হোক এটাই কামনা। 

একজন ভালো লেখক তুলে আনার দায় সাহিত্য সম্পাদকদের থাকে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি খ্যাতনামা পত্রিকার ঈদ সংখ্যাতেই সাহিত্য জগতের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখাই বেশি প্রাধান্য পায়। 

ঈদ সংখ্যার প্রচারে সেই লেখাগুলোর হাইলাটইস থাকে। তবে সারা বছর যারা লিখছেন তাদের খুব কম সংখ্যক লেখকদেরই এসব আয়োজনে দেখা যায়। যদিও এখন পত্রপত্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং এর ধরনে বদ্ধির কারণে অনেক লেখক সুযোগ পাচ্ছে তবুও ঈদ সংখ্যার বাইরে থাকছেন প্রতিবানসম্পন্ন লেখকদের অনেকেই। ঈদ সংখ্যা একটি বিশেষ আয়োজন এবং এখানে সকলকে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না এটা সত্যি। বিশেষ লেখা মানেই বিশেষ কিছু। ফলে যারা পাঠক তারা এই সংখ্যাগুলোর প্রতি একটু বেশিই মনোযোগী হয়। বলা যায়, বইমেলার পর এই আয়োজন বা সংখ্যাগুলো পাঠককে নতুন করে বইয়ে ফিরিয়ে আনে। যারা সত্যিকার অর্থেই পাঠক তারা এই সময়ের জন্যই অপেক্ষা করে।  যার লেখা এই বিশেষ সংখ্যায় আসছে তাদের কেউ কেউ তার লেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করছেন। এর ফলে অনেকেই সেখান থেকে তার প্রিয় লেখকের লেখা পড়ছে। 

বিশেষত কবিতার কথাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গল্প বা উপন্যাস এখানে আসে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এটা পড়ে পাঠকের পড়ার তৃপ্তি মেটার কথা নয়, মিটেও না। কারণ পাঠক তৃপ্ত হন পুরো বই পাঠে। কিন্তু পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আবার অনেক পাঠক তার পছন্দমতো কয়েকটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যা কিনছে। তারপর ধীরে সুস্থে তা পাঠে মনোযোগী হচ্ছে। ঈদ সংখ্যার জন্য প্রচুর লেখা জমা হয় এবং সেখান থেকে সেরা লেখাটি বাছাই করা সাহিত্য সম্পাদকের জন্য একটি কঠিন কাজ। আবার যে লেখাটি আমার কাছে মানসম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে তা তার কাছে মনে না হতেও পারে। ফলে কারও লেখা বাদ পরে যায়। আবার এমনও দেখা যায় যে লেখাটি একজন সাহিত্য সম্পাদকের কাছে প্রত্যাখত হয়েছে তা অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ফলে ঈদ সংখ্যায় লেখা প্রকাশিত হলেই যে সেই লেখক যার লেখা প্রকাশিত হয়নি তার চেয়ে কম দক্,ষ সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা উচিত নয়। 

ঈদ সংখ্যা একটি বিশেষ সংখ্যা। তাই এই সংখ্যায় লেখা প্রকাশিত হলে তা ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়। তবে এই নিয়ে অতি তৃপ্তিতে ভুগলে তা তার সাহিত্যের ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। যারা নিয়মিত লিখছেন অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন তারা সকলেই ভালো লেখক। আর ঈদ সংখ্যা কিনে পড়ছেন সেই পাঠকের সংখ্যা এখন কম। তারচেয়ে বরং নিয়মিত সাহিত্য পাতায় চোখ বুলানো পাঠকের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে ঈদ সংখ্যায় যারা প্রতিষ্ঠিত লেখকের লেখা যত বেশি প্রকাশ হচ্ছে সেই ঈদ সংখ্যা পাঠক সমাদৃত হচ্ছেও বেশি। ঈদ সংখ্যা নিয়ে এসব অহেতুক সমালোচনা বন্ধ হোক এবং সাহিত্যের অবারিত দ্বার প্রসারিত হোক এটাই কামনা। 



আরো পড়ুন