১৮ মে ২০২৪, শনিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

আদ্যনাথ ঘোষের কবিতা: জীবনবোধের নিঃসঙ্গ বয়ান

এমরান হাসান || ০২ জানুয়ারী, ২০২৪, ০৫:০১ পিএম
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতা: জীবনবোধের নিঃসঙ্গ বয়ান


কবিতার পথ পরিবর্তন হচ্ছে,বাঁক বদল করছে আধুনিক কবিতা, এ মন্তব্য সত্য হলেও একটি প্রশ্ন থেকেই যায় আর তা হচ্ছে 'ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে বাংলা কবিতা, বাংলাদেশের কবিতা? এ প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে? সহজ ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশের কবিতার বাঁক বদলে যাচ্ছে নিখাদ উত্তরণের দিকে,অনন্ত ভবিষ্যতের দিকে।এই উত্তরণের পথে যাদের কবিতা অগ্রগামী তাদের একজন আদ্যনাথ ঘোষ। কবিতার ভেতরে তিনি আপ্লুত জীবন আর নিজস্ব বোধ যাপনের রোজনামাচা লিপিবদ্ধের পাশাপাশি জীবনের নানামুখী উপাচার ব্যখ্যা করেছেন স্বতন্ত্র ভঙিমায়।অনেক ক্ষেত্রেই গতানুগতিকতার বাইরের মানচিত্র কিংবা তার চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে জীবনের একছত্র কথোপকথন, একেবারেই নিজের মতো করে-

কবিতার প্রয়োজনে তিনি চিন্তার গভীরে গিয়ে হঠাৎ ফিরে আসেন নিজের ভেতরে। যেখানে নিজের সাথেই নিজের বিরোধিতা,নিজের ভেতরেই সব বিদ্বেষ। আলাপচারীতায় তিনি নিশ্চুপ হয়ে আসেন শব্দের ভিতরে। যে কারণেই তার কবিতা সাবলীলতায় বদলেছে ধীর লয়ে,একা । কবিতার জন্য আত্মমগ্নতা সত্যিই জরুরি, তার চেয়েও জরুরি নিজের পরিবেশ আর প্রতিবেশ সম্পর্কে অবগত থাকা।এ দু'টি বিষয়ের একটি অপরটির সাথে ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িত। অপ্রিয় সত্য এই যে, বর্তমান সময়ের অধিকাংশ কবিরাই উপর্যুক্ত দু'টি বিষয় সম্পর্কে সচেতন নন। আদ্যনাথ তার কবিতা দিয়ে তার সচেতনা প্রমাণ দিয়েছেন।তার অধিকাংশ কবিতাই এ মন্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। একজন কবি কখনোই লেখার আগ মূহুর্তেও জানতে পারেন না যে ঠি কোন বোধে বা কোন ঘোরে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন। কেবল স্বার্থক কবিতা সৃষ্টির জন্যেই কবি নির্লিপ্ত হয়ে ওঠেন,মগ্ন হয়ে ওঠেন নিজস্ব সৃষ্টিতে ।আদ্যনাথ ঘোষ তেমনই এক মগ্ন কাব্যঋষি ।

জীবনের প্রয়োজনে একজন কবিকেও বদলে যেতে হয হয়তো,তার সাথে বদলে যায় তার কবিতাযাপনের নানা উপাচার। মানুষের মাঝে অনন্য সাধারণ হয়ে কবি বেঁচে থাকতে চান, সাধারণ কিছু বোধ বদলের পাশাপাশি কবিও বদলে দেন তার কবিতা। আদ্যনাথ ঘোষ এসবের গভীর থেকেই তুলে এনেছেন কাব্যশস্য। কবিতার গতি-প্রকৃতি অনেকাই নিত্য পরিচিত ঘরানা থেকে ভিন্নতর ।আদ্যনাথ তার কবিতায় নিজেকে বিশ্লেষণ করেছেন আভিজ্ঞাণিক প্রক্রিয়ায়। কবি তার কবিতাকে নিজ্বস্ব মনন আর চিন্তার রেশে মিশ্রণ করে বারংবার হেঁটে যান অনির্বচনীয় এক ভালোলাগার দিকে ।

একজন সত্যিকারের কবির ক্ষেত্রে এটিই সত্য যে, কবির চেতনা,বাস্তবিক যাপিত জীবনাচার, যুগযন্ত্রণা,রাজনীতি,অর্থনীতি, সমাজনীতি, সামাজিক বৈষম্যতা,জৈবিক বিষয়াদিসহ পারিপার্শ্বিক জগতের নানামুখী চেতনালব্ধ বিষয় কবিকে কাগজের বুকে লিখে যেতে বাধ্য করে। মগজের রীতিমতো ভাবনার স্ফুলিঙ্গ একটি নিপাট, নির্বিবাদ পরিকাঠামো মেনে নিয়ে লেখায় রূপান্তরিত হয়।কবিতার নির্মাণশৈলী আরো ভয়াবহ রকমের লৌকিক ক্রিয়া। আপন মননের সঙ্গে কেবল ভাবনার মিশেলই শুধু নয়, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় সময়প্রবাহের মন্ত্রণা,এই বিষয়টিই আদ্যনাথ ঘোষকে একদিকে যেমন ধাবিত করেছে পরিশীলিত রচনা সৃষ্টির দিকে, অন্যদিকে ধাবিত করেছে নিরুত্তাপ,অনুত্তেজক কবিতাযাপনের দিকে।সত্যিকারের ভাবনার প্রকাশ কখনই সাহিত্য আর সৃজনশীল কর্ম ছাড়া ভিন্ন কিছু হতে পারে না। এই কবির চিন্তার সূচিকে ক্রমাগত পাঠ করলে এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয়ে ওঠে, যার প্রমাণ তার প্রতিটি কবিতাগ্রন্থেই ফুটে উঠেছে।আধুনিককালের শিল্পীত কবিতাভাবনা এবং কথিত (!!) উত্তরাধুনিককালের কবিতায় ছায়া প্রকট হয়েছে এই কবির অধিকাংশ কবিতায়।

কবিতাকে অনেকেই ব্যক্তিক যন্ত্রণার নথিরূপে চিহ্নিত করতে চান। তাদের যৌক্তিকতায় তারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন বার বার যে, কবি কেবলই তার ব্যক্তিক যন্ত্রণা নিরসনের তাগিদেই কবিতা সৃষ্টি করেন আর কোনো দায় কবিতার কাছে কবির নেই।এ মন্তব্য অনেকাংশেই ভিত্তিহীন বরং কবি তার সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ভৌগোলিক অবকাঠামো এবং উপযুক্ত সময় আর অতলান্তিক চিন্তার ভিত্তিতেই তার কবিতা সৃষ্টি করার কাজে ব্রতী হন।পরবর্তীতে সেই চেষ্টাই কবির মৌন জগৎ আর বহিরাঙ্গিক পার্থিব জগৎকে সাহিত্য সৃষ্টির রসদরূপে গ্রহণ করতে শেখায়।এই বিষয়টি প্রকাশ্যেই হোক কিংবা অগোচরেই হোক, কবি তার সমগ্র সৃষ্টিতে কখনই বিবৃত করেন না।একটি কবিতা সৃষ্টির প্রাক্কালে যাবতীয় (ইহজাগতিক কর্ম) দর্শনকে কবি আশ্রয় করেন কেবলই কি তার লেখার প্রয়োজনে? কিংবা তার নিজস্ব চিন্তন-প্রক্রিয়ার সফল প্রকাশ ঘটানোর স্বার্থে? এরকম প্রশ্নের উত্তর 'না'। কবি তার কবিতা ও দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞের সবটাতেই তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ দর্শনকে প্রয়োগ করেন। এ কাজটি করেন বলেই কবি সমাজের অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি পরিপূর্ণ মনোজাগতিক বিষয়াদিতে।কবি তার ব্যক্তিক,মনোজাগতিক তন্দ্রাচ্ছন্নতা আর নিজস্ব ভাবনার শিল্পরূপ মিলিয়েই পৌঁছে যান অলৌকিক সাম্রাজ্যে, যেখানে অযুত প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়াদি ধরা পড়ে তার দিব্যজ্ঞানে। কবি তার মননশীলতার মাধ্যমে ওই বিশাল সাম্রাজ্যের যৎসামান্যই লিপিবদ্ধ করতে সমর্থ হন কবিতার আদলে।এই বিষয়ের ব্যতিক্রম ঘটেনি আদ্যনাথ ঘোষের কবিতার ক্ষেত্রেও।

এই শতাব্দীর প্রথমদিকেই বাংলাদেশের কবিতা বাঁক নিতে শুরু করেছিলো নতুন এক সম্ভাবনার দিকে। সার্থক কবিতা কখনো একাডেমিক নয় বরং একাডেমিক চিন্তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে চিরসুন্দর এক ভাস্কর্য হয়ে ওঠা আশ্চর্য চেতনার প্রকাশ। সে পথেই হেঁটেছেন আদ্যনাথ ঘোষ। তার বেশকিছু কবিতায় আত্মপরিচয় বয়ানের পাশাপাশি রয়েছে আত্মবোধের বয়ান। আত্মজৈবনিকতা একজন কবিকে তার নিজের বোধকে নিজের মতো করে সাজাতে শেখায়।তিনি তার কবিতায় এরকমই বেশকিছু বোধকে উপস্থাপন করেছেন যেগুলো একজন কাব্যবোদ্ধা পাঠককে সহজেই টেনে নেবে শিল্পের এক আশ্চর্য পরম আনন্দের দিকে—

পরকীয়া রাত তোলে গোপনজলের স্তনে ঢেউ। মাঝিও তরাসে ডাকে মোহনীয় শরীরের বাঁকে ঘোরে ডোবে রাত্রিরসে বুক ফাটা দীর্ঘশ্বাসে, দমে যমুনা অমরাবতী হয় অন্তরে বাহিরে বৃন্দাবনে। তবুও হারিয়ে ফেলা রাসলীলা প্রেমের বাজারে চারিদিকে বাজে ধ্বনি সর্বনাশা নগ্ন চণ্ডীধামে। (রসলীলা /তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে)

কবিতা লেখার প্রয়োজনে কোন জাতকবি সাদা কাগজের সামনে ঠায় বসে থাকেন না; বিষয়টি সাংঘাতিক হাস্যকর এবং করুণাদায়কও বটে। বরং এটিই সত্য যে,কবির চেতনা, বাস্তবিক যাপিত জীবনাচার,যুগযন্ত্রণা,রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সামাজিকবৈষম্যতা,জৈবিক বিষয়াদিসহ পার্শ্বিক জগতের নানামুখী চেতনালব্ধ বিষয় কবিকে কাগজের বুকে লিখে যেতে বাধ্য করে। এই আঁকাবাঁকা এবং মগজের রীতিমতো ভাবনার স্ফুলিঙ্গ একটি নিপাট,নির্বিবাদ পরিকাঠামো মেনে নিয়ে লেখায় রূপান্তরিত হয়। কবিতার নির্মাণশৈলী আরো ভয়াবহ রকমের লৌকিকক্রিয়া ।আপন মননের সঙ্গে কেবল ভাবনার মিশেলই শুধু নয়,সেইসঙ্গে যুক্ত হয় সময় প্রবাহের মন্ত্রণা, যে বিষয়টি একজন কবিকে একদিকে যেমন ধাবিত করে পরিশীলিত রচনা সৃষ্টির দিকে,অন্যদিকে ধাবিত করে নিরুত্তাপ, অনুত্তেজক জীবনযাত্রার দিকে। আদ্যনাথ তার কবিতায় দুঃসাহসিক প্রবহমানতা নির্মাণে সচেষ্ট রয়েছেন তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ থেকেই। আদ্যনাথ তার কবিতায় মোহজাগতিক মূর্ছনা প্রকাশের নির্ভার আয়োজন করেছেন। তিনি বলে যেতে পেরেছেন একক আলোর বেদনার দ্যূতি আর চিরায়ত সত্যের আলোকিত ব্যান। আদ্যনাথ ঘোষ তার কবিতার ভেতরে অনন্য সাদারণ এক আবহ আবিষ্কার করেছেন প্রথম থেকেই। তিনি বস্তুত অপরূপ প্রানের মুদ্রিত মূর্ছনাকে আলোকিত করার প্রত্যয়ে কবিতার আঙ্গিকে নির্মাণ করে চলেছেন চিরায়ত সত্য এক আহবান ।কবি তার নিজের মোহ এবং চিন্তাধারার মাধ্যমে কবিতা এবং ভাষার দ্যোতনাকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন খুব সহজেই। চারপাশে ঘটে যাওয়া নানাবিধ ঘটনাক্রমের সূত্র ধরেই সচেতন মানুষ হিসেবে কবিতার কবিতা সৃষ্টি করেন' এমন মন্তব্য বিশ্বের নানা ভাষার কবিতার স্বার্থে সুপ্রাচীন এবং সর্বজনবিদিত। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে কবিতার ক্ষেত্রে একজন কবি যতটুকু নির্মম হতে পারেন তার ভাবনা বিনির্মাণের তাগিদ থেকে এই নির্মমতা সাহিত্যের অন্য কোন ক্ষেত্রে এতোটা কেউ হতে পারেন না। কবি তার বোধ এবং ঘোরের সমন্বয়ে যে বিষয়টি এখন লিখছেন পরবর্তী পর্যায়ে সেই বিষয়টি স্বাভাবিক অবস্থায় তার ভালো নাও লাগতে পারে। এই ভাবনা আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় প্রবল-

তবুও রক্তজবার যজ্ঞে রুদ্রাক্ষের মালায় বেধেছি প্রাণের উল্লাস

এতোটা প্রগাঢ় অনলে, যৌবনের মুখরতার দ্রোহে

আর নবীন শস্যের শরীরে দাউ দাউ জ্বলে ওঠে রক্তরাঙা সকাল।

তবুও বিস্ময়-

তবুও বেধেছি স্বপ্নের বুনোট বিহঙ্গের উড্ডীন ডানায় ।

(প্রশ্ন/একমুঠো স্বপ্নের রোদ্দুর)

জীবনানন্দ যুগের এতোকাল পর তার প্রকৃত রেশ ধারণের চেষ্টা করেছেন অনেকেই।এই হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেন কবি আদ্যনাথ ঘোষ। আমাদের কবিতার জগতকে আরেকটু সমৃদ্ধ করেছে এই কবির অপরূপ ভাবনা সার্থক কবি মাত্রই সমাজ, সংসার, বিশ্বপরিক্রমার কাছে দায়বদ্ধ। আদ্যনাথ ঘোষ এর ব্যতিক্রম নন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, তার দূর জংলার গান কবিতাবইয়ের প্রতিটি কবিতাই আত্মতন্দ্রায়  ভরপুর।এই শতাব্দীর  দ্বিতীয় দশকের প্রথমার্ধের এই কবি তার কবিতার রাজ্যে নিবেদন করে গিয়েছেন নান্দনিক কিছু উপমার ছায়াচিত্র। যেগুলো আমাদের টেনে নিয়ে যায় নিরুত্তাপ জীবনের বিপরীতে।আদ্যনাথ ঘোষ কবিতার জন্য নিজেকে সরিয়ে নেন নি। তার অন্তর্জগত আর বহির্জগতের মধ্যকার পার্থক্যটি তাকে তীব্রমাত্রায় ভাবিয়ে তুলেছিল। এসবের ছায়া তার কবিতায় স্পষ্ট-

বরং ধানের হাওয়া এসে সুর তোলে কৃষানীর সোঁদা শাড়ি

আর তার ঘাম ধোয়া শরীর ছুঁয়ে শষ্যের শিশুরা খেলা করে শুকনো খড়ের আখড়ায়।তাই অনায়াসে কৃষকের বুকের জমিন ফুলে ওঠে

ভোরের আলোর সাথে ঝুরঝুরে মাটি নিয়ে ক্ষেতের আড়াল।

( ধানের হাওয়া / দূর জংলার গান)

আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের পাশাপাশি বিবর্ণ ভাষাশৈলীর তির্যক ব্যবহার আর দারুণ রঙিন চিত্রকল্প প্রত্যক্ষরূপে প্রতিষ্ঠিত। কবিতার জন্য অর্ন্তদৃষ্টিকে তিনি সার্থকরূপে ব্যবহার করেছেন যার প্রমাণ বহন করে তার কবিতা। অসম্ভব গতিময় আর মূর্ছনাবহ শব্দ-দ্যোতনায় ঋদ্ধ এ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা। প্রচলিত কাব্যবোদ্ধাগণের‘ হাঁড়ে কাঁপন ধরাতে সক্ষম আদ্যনাথ ঘোষের কবিতা। এ গ্রন্থের সম্পাদ্য,অহম,জাতিস্মর,তৃষ্ণা,পোড়া ফাগুন,প্লেকার্ড, স্বপ্নভ্রূণ, যতি শীর্ষক কবিতাগুলো মনস্তত্ত্বের গভীর তলদেশে টেনে নিয়ে যাবে সত্যিকারের কবিতাবোদ্ধাদের।কেবল কবিতা সৃষ্টিই মুখ্য নয়। আদ্যনাথ ঘোষ কবিতার অন্তর্লোকে নির্মাণ করেছেন দুর্ভেদ্য স্বপ্নচেতনা।

বাংলাদেশের কবিতার শিল্পোত্তীর্ণ ছায়া আর সহজাত দৃষ্টির আড়ালে বিলুপ্ত প্রায় বোধের সুরম্য দালান স্বাধীনতা পরবর্তী কবিতায় কতটা সার্থকরূপে উঠে এসেছে? এ বিষয়টিতে প্রশ্নের শেষ নেই। কবিতার নামে তৈরি হওয়া কাগজ- কলমের সঙ্গমে যে স্ববিরোধী প্রশ্বাসচিত্র সেটি গত শতকের শেষদিকের কবিতায় দারূণভাবে উঠে এসেছে। এটি অবিশ্বাস্যরূপে প্রামাণ্য সত্য যে বর্তমান সময়ের কবিতায় বোধ আর উন্নত চিন্তাশক্তির মারাÍক প্রকাশটা ভীষণভাবে জরুরি। যার ব্যবধান সৃষ্টি হলে একসময়ে এই বাঙলা 

কবিতা শিল্পচ্যুত ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হতে পারে। এরকম শঙ্কার জায়গায় সৃষ্টির সম্ভাবনা যখন একদিকে বেগবান ঠিক তার উল্টোপাশে মানসম্মত, পরিমিতি বোধ সম্বলিত কবিতা নির্মাণের নজিরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।আদ্যনাদ ঘোষের এই কবিতাগুলো নির্বিকার চিত্তে সরলরেখার আদলে চেতনার সরল অথচ স্বরূপ প্রকোষ্ঠে আঘাত হানতে সক্ষম। তার কবিতার পক্সিক্ত আর গীতলতার নতুন নির্মাণশৈলী সত্যিকারার্থেই প্রশ্নাতীত। সমকালীন রাজনীতি, সাম্রাজবাদের অনুজ্জ্বল আলোর ফসিল আর ব্যক্তিক টানাপড়েনের হিসেবনিকেশ এক নির্ভুল আঁচড়ে চিত্রিত করেছেন আদ্যনাথ তার ‘দূর জংলার গান’ গ্রন্থে।কবিতার শরীর নির্মাণের বিষয়ে তিনি যেমন সচেতন অপরদিকে নিজস্ব দৃষ্টির অনুবাদ তিনি করেছেন সার্থকভাবে। কবিতায় কলাকৌশল মুখ্য না হলেও তিনি জনান্তিক দ্রোহের বুননে সাজিয়েছেন নির্বিকার সত্যবচন!আবার তার কবিতার ভাষাশৈলী সরল যার ফলে অবলীলায় তার কবিতায় উঠে আসে মৌখিক বিশ্বাস আর গ্রহণের প্রতিকৃতিমাখা ভাষাগরিমায় ব্যাপক সরলার্থ। কবিতার নতুন এই উঠোনের কারুকার্য তাকে পৃথক করে সহজেই। তিনি গতানুগতিক নয় বরং প্রাত্যহিক জীবনাচারের আড়ালের অনুভূতি তর্জমা করেছেন নিজস্ব কৌশলে। কবিতার জন্য এ এক বৃহৎ পুরস্কার। কবিতা তৈরি করার কোনো সঠিক কৌশল নেই বরং কবিতা অবলীলায় সৃষ্টি হয়ে ওঠে কবির হাতে।

বাংলা কবিতার চিরায়ত বিস্ময় হলো তার নিজস্ব বোধ আর চেতনার মরমস্পর্শী ঘোর যা নান্দনিকতার পাশাপাশি সাবলীলতার বিষয়টিকেও চরমভাবে আকৃষ্ট করে কাব্যবোদ্ধাদের। আদ্যনাথ ঘোষ'র কবিতা সেই ভাবধারার পরিশুদ্ধ বহিঃপ্রকাশ।এই শতাব্দীর বাংলাদেশের কবিতায় যারা স্বতন্ত্রস্বর তৈরি করে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থানকে একটি সুদৃঢ় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, তাদের অনেকের কবিতায়ই পশ্চিমা সাহিত্যের জাদুবাস্তবতা আর পরাবাস্তব ঘরানার চিন্তা তৈরির ব্যর্থ চেষ্টাকেই প্রধান রূপে ধরা পড়ে।অস্বীকারের পথ নেই যে,এই দশকের কবিরা তাদের কবিতাকে বৈচিত্রমুখী করে তৈরি করার চেষ্টা করেছেন এবং এই কারণেই হয়তো কেউ নিয়েছেন অনুবাদ সাহিত্যের আশ্রয় আবার কেউ নিয়েছেন বিদেশি সাহিত্যের সরাসরি অনুকরণের মতো নিন্দিত সুযোগ। যারা এইদুটোর কোনটির পথেই হাঁটেননি তারা গিয়েছেন লোকজ ব্রাত্য-মরমী চিন্তার পথে। আবার একদল রয়েছেন যারা তাদের কবিতাকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের অংশ হিসেবে নিয়ে স্বাপ্নিক দ্যোতনা তৈরীর কাজেই ব্রত রয়েছেন। আদ্যনাথ তাদেরই অন্যতম। তার কবিতাগ্রন্থগুলোর নিবিড় পর্যালোচনা করলে সেখানে পাওয়া যাবে যাপিক জীবনযন্ত্রণা, হতাশার আলিঙ্গনে উঠে আসা একাকী একক নৈঃশব্দ-চক্র। এই চক্র অবিরত ঘুর্ণায়মান আমাদের যাপিত জীবনের সমস্ত হাহাকারে। আদ্যনাথ চুপ করে দেখেছেন এইসব যাতনার কফিনে শুয়ে থাকা ভালো থাকা আর না থাকা চিন্তাগুলো।তার কবিতায় উঠে এসেছে অন্যন্য সব উপমা যা বাংলাকবিতায় নতুন না হলেও পাঠকের মগজকে স্থির এক বোধকে চিরবিসর্জনের পথেই নিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।এখানেই সার্থক কবি আদ্যনাথ ঘোষ। কবি হিসেবে তিনি নিজস্ব আয়োজনকে তার অজান্তেই পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন মহাজাগতিক বিস্ময়ের গন্তব্যে।



আরো পড়ুন