২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার



স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির লাগাম টানা জরুরি

কামরুজ্জামান শাহীন || ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৮:৪২ এএম
স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির লাগাম টানা জরুরি


বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির ইতিহাস অনেক পুরনো বললেও ভুল হবে না। অথচ এই ‘ব্যধি’ গোড়া থেকে নির্মূলে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। ওপরে ওপরে ফিটফাট থাকলেও ভেতরে ভেতরে দুর্নীতির চর্চা চলে আসছে। 

সম্প্রতি এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আর সামগ্রিক এই রুগ্ণ পরিস্থিতির সবচেয়ে নির্মম শিকার অতি সাধারণ মানুষ। যাদের আয় সীমিত। নগরের নামিদামি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই। টাকা দিয়ে বেসরকারি চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসাপরামর্শ কেনা, পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যয় বহন করা এবং ওষুধ কিনে সেবন করা তো দূরের কথা, অনেকটা নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা তাদের। ফলে মৌলিক এই চাহিদা নিয়ে তাদের ভাবনায় শুধু হতাশা আর অসহায়ত্ব।

এই দুর্নীতি যে বেড়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে লাগামহীন, তা পরিমাপের জন্য কিছু প্যারামিটার দিয়ে সহজে অনুমান করা যায়। 

এক. সরকারি হাসপাতালগুলোয় সাধারণ রোগীদের হয়রানি, রোগীদের কাছ থেকে উৎকোচ নেওয়া।
দুই: সরকারি হাসপাতালের ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী নিয়মিত পাচার হওয়া। 
তিন: পরীক্ষা-নিরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি অকেজো থাকা।
চার: চিকিৎসার ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ বা বেসরকারিকরণ। 
পাঁচ: চিকিৎসাসামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকা।

রোগীদের হয়রানি
চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য সরকারি হাসপাতাল মানেই হয়রানি। এটা এখন পরিচিত প্রপঞ্চ। ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো ভিজিট করলে যে কারও চোখে পড়বে এই চিত্র। গত কয়েকদিন আগে আমার একজন নিকটাত্মীয় চিকিৎসা নিতে আসেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতালে)। এই ক’দিনে হাসপাতালটিতে রোগীদের হয়রানি, ‘রক্ষকদের’ করা অনিয়ম আমার চোখে পড়েছে। মূলত সেই পরিস্থিতি আমাকে লিখতে তাড়িত করে। আমি দেখেছি একজন রোগী কিভাবে শুরু থেকেই হয়রানির শিকার হন। রক্ষক কিভাবে ভক্ষকের ভূমিকায় নামে। অনেকে হয়তো এটা বলতে চাইবেন যে, এই একটি হাসপাতালে সারাদেশ থেকে আসা রোগীর চাপ অনেক বেশি। তাহলে বলবো, যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে, সেই টুকুনের উত্তম ব্যবহার তো করা যেতেই পারে। সেই ব্যবস্থাপনায় আমি ত্রুটি দেখেছি। আমি মনে করি এই অব্যবস্থাপনা শত শত মাইল দূর থেকে আসা সাধারণ রোগীদের আশাহত করে। 

দেখা গেছে, সারারাত বাসে ভ্রমণ করে ভোরে এসে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েও একজন সাধারণ রোগী বা তার অভিভাবক আগে টিকিট পেলেন না। অনেকটা প্রকাশ্যেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্য নগদ টাকা পকেটে ভরে নিয়ে কাউন্টারের ভেতরে ঢুকে টিকিট করে দিচ্ছেন অনেককে। এক্ষেত্রে ১০ টাকার টিকিটের জন্য ১০০ টাকাও গুণতে হয়। এই অনিয়মের কারণে যারা সকাল থেকে এসে ১০ টাকায় টিকিট কিনতে লাইনে দাঁড়ালেন, তাদের কিন্তু অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। ১০ টাকার টিকিটে আবার শুভঙ্করের ফাঁকি! টিকিট কেনার পর বেশি অসুস্থ রোগীরা ট্রলি বা হুইল চেয়ার সংগ্রহ করে থাকেন হাসপাতাল থেকে। ট্রলি বা হুইল চেয়ারের গায়ে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য লেখা থাকলেও বিতরণকারীরা রোগীর লোকদের নিকট থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘মূল্য’ নিচ্ছেন। এই ‘মূল্যযোগের’ কারণে এখানেও সিরিয়াল ভঙ্গ হচ্ছিল। টিকিট কেটে চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে যখন রোগীরা আরেকবার সিরিয়াল ধরছেন সেখানেও তদবির। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ‘ভিজিট’। বিভিন্ন রেফারেন্সে সিরিয়াল ভঙ্গ হচ্ছিল। আমার রোগীর অপেক্ষা এতটাই বিলম্বিত হচ্ছিল যে, আমি দ্বিতীয় তলার বহিঃবিভাগ ইউনিটে ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। অপারেশনের জন্য যারা ভর্তি হন তাদের ওটির সিরিয়ালেও অনেক তদবির, ঘাপলার খবর বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি। আমি নিশ্চত নই যে, কর্তৃপক্ষ এই পরিস্থিতিকে অনিয়ম এবং হয়রানি বলবেন কি না। তাদের কাছে প্রশ্ন রাখলাম। হাসপাতালটিতে স্থাপন করা সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে আমার এই পর্যবেক্ষণ মিলে যাবে আশা করি। এই চিত্র বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সরকারি অন্যান্য হাসপাতালের অবস্থাও রোগীবান্ধব নয়।

ওষুধ-চিকিৎসাসামগ্রী পাচার
খুব দামি ওষুধ সরকারি হাসপাতাল থেকে বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছে। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে চেতনানাশক ওষুধ হ্যালোসিন পাচার হচ্ছে। লেভেল পরিবর্তন করে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব চড়ামূল্যে বেসরকারি হাসপাতালে বিক্রি করে দিচ্ছে। অথচ এই ওষুধ ছিল সরকারি হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের জন্য বরাদ্দ। শুধু হ্যালোসিন নয়, হিউম্যান অ্যালবোমিনের মতো দামিদামি ইনজেকশন সরকারি হাসপাতাল থেকে পাচার হচ্ছে। এমনও তথ্য রয়েছে যে, ঠিকাদার একদিকে টেন্ডারের সামগ্রী সরবরাহ দিচ্ছেনত সেগুলোই আবার অন্য দরজা দিয়ে ইনট্যাক্ট অবস্থায় বাইরে পাচার হয়ে আসছে। আর ওষুধ পাচারে রোগীরা যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি অকেজো
এই চিত্র কিন্তু সারাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর। হরহামেশা খবরের কাগজের শিরোনাম হতে দেখা যায়। বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা সেবার সব ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে সিটি স্ক্যান, এমআরআই, এক্স-রেসহ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে থাকছে। কোথাও আবার প্রয়োজনীয় জনবল নেই। ফলে চলে না পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সেগুলো প্রায়ই নষ্ট থাকে। কথিত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অজুহাতে সচল করা হয় না। সাধারণ মানুষও এখন বোঝেন যে, অচলাবস্থার পেছনেও দুর্নীতির কালো থাবা রয়েছে। যন্ত্রপাতি অচল থাকা মানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ‘ব্যবসা’। নয়তো নতুন করে কেনাকাটার সুযোগ তৈরি করা। আর এই ব্যবসার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে হাসপাতালের চিকিৎসক, হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরা জড়িত থাকেন। ফলে অকেজো যন্ত্রপাতি মেরামতে আগ্রহ কমে যায়। 

চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ:
মূলত সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার ওপর ভর করেই চিকিৎসার ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে আমাদের দেশে। চিকিৎসাটা সেবার পরিবর্তে এখন এমন লাভের ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ব্যাপকহারে যত্রতত্র বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠছে। এই বানিজ্যিকীরণের ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোয় সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসুবিধা ক্রমাগত তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাণিজ্যিকীকরণের ধরন উল্লেখ করা যেতে পারে। আমাদের দেশের অধিকাংশ চিকিৎসকের দেওয়া রোগীদের জন্য ব্যবস্থাপত্রে ‘নির্দিষ্ট’ কোম্পানির ওষুধের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়। ওষুদের জেনেটিক নাম তারা উল্লেখ করতে চান না। এতে সাধারণ রোগী হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত হন। অথচ পাশের দেশ ভারতেও এমনটা হয় না। সেখানে ওষুধের জেনেটিক নাম লেখা হয় ব্যবস্থাপত্রে। ওষুধ কোম্পানির লোভনীয় ‘অফার’ চিকিৎসকদের  মধ্যে এই প্রবণতা তৈরি করেছে। 

চিকিৎসা সামগ্রীর নিয়ন্ত্রণহীন দাম: আমরা লক্ষ করছি যে, করোনা মহামারী পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রণহীন চিকিৎসাসামগ্রীর বাজার। যা নিয়ন্ত্রণ করছে একটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের নেপথ্যে রাঘববোয়ালরা রয়েছেন। আর এ কারণেই দফায় দফায় চিকিৎসাসামগ্রীর দাম বাড়ানো হলেও তা রোধ করার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। ডলারের দাম বদ্ধির কথা বলে এই সিন্ডিকেট হাজার হাজার কোটি টাকা মার্কেট থেকে তুলে নিচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই সিন্ডিকেট এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পণ্যে কৃত্রিমসংকট তৈরি করে সেগুলোর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় যে, অতি সম্প্রতি এই সিন্ডিকেটের প্রভাবে আইভি ক্যানোলা, ফলিস ক্যাথেটার, ডায়ালাইসিস ক্যাথেটার, ইউরিন ব্যগ, ব্লাড ব্যাগ, এক্স-রে ফিল্ম, হিউম্যান অ্যালবোমিন সহ বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রী, যন্ত্রপাতির দাম হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। দাম বৃদ্ধির মাত্রাটা কেমন তা বোঝাতে একটি চিত্র তুলে ধরছি। বারডিয়া কোম্পানির ফলিস ক্যাথেটারের দাম গত ২ বছরের বেড়েছে কয়েক দফা। ১৪ ও ১৬ এফআর প্রতি পিছ বারডিয়া ক্যাথেটার ১০০-১১০ টাকা বিক্রি হতো। কোনো রকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই এখন ২৪০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এভাবে চিকিৎসাসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি স্বাস্থ্যসেবার রুগ্‌ণ চিত্র কিংবা অরাজক চিত্রই নির্দেশ করে। যা সাধারণের চিকিৎসাসেবাকে কঠিনতর করে তুলছে।  

মোটকথা স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ছড়িয়ে আছে তৃণমূল পর্যন্ত। এটা স্পষ্ট যে, এর নেপথ্যে রাঘববেয়ালরা। তাদের লাগাম কেউ  টেনে ধরতে পারছে না অথবা ধরা যাচ্ছে না। অথচ টেনে না ধরতে পারলে দেশের স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা কোনোদিন দূর হবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি যে, একটি সরকার চাইলেই স্বাস্থ্যখাতের ব্যাপক উন্নতির মাধ্যমে তার জনগণের নিকট দীর্ঘসময় আস্থাভাজন হয়ে থাকতে পারে। প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ। জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে শহরভিত্তিক বড় বড় হাসপাতালগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে নিয়মিত শুদ্ধিঅভিযান পরিচালনা করা। স্বাস্থ্যখাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে এ খাতের ওপর মানুষের আস্থা ফেরাতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা করি। 

লেখক: সংবাদকর্মী



আরো পড়ুন