কয়েকদিনের টানা ভারী বৃষ্টিতে বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট, সোনাতলা, শেরপুর ও নন্দীগ্রাম উপজেলায় ৫ হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বসতবাড়িতে হাটুপানি থাকায় কয়েকটি ঘর ভেঙে গেছে। ভারী বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ডুবে গেছে মরিচ ক্ষেত ও ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। নন্দীগ্রামের ওমরপুর এলাকার মাঠে মাছ ধরতে গিয়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, হঠাৎ করে বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে এসব ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে উপজেলার কৈগাড়ী, রিধইল, সিংড়া খালাস, কামুল্যা, পারশুন, পারঘাটা, গুলিয়া কৃষ্ণপুর, জামালপুর, জোঁকা বনগ্রাম, গোপালপুর, তৈয়বপুর, কমলাগাড়ি, নাগরকান্দি, দমদমা, রুস্তমপুর, পৌরসভার পূর্বপাড়া, দক্ষিণপাড়া, কলেজপাড়া, নামুইট, বৈলগ্রাম, দামগাড়া, ওমরপুর, কালিকাপুরসহ বেশকয়েকটি গ্রামের বসতবাড়িতে হাঁটুপানি দেখা গেছে। পানিবন্দি থাকায় কেউ কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। বাড়ির আঙিনা, ঘরে মেঝেসহ ডুবেছে চুলা। ফসলি জমিগুলোও হাবুডুবু অবস্থা। শিমলা কচুগাড়ী হিন্দুপাড়ায় বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতায় থাকা মাটির ঘর-বাড়ি ও দেয়াল ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ওই গ্রামের দুলাল চন্দ্র, নলি বালা, পরেশ চন্দ্র এবং নিরেন চন্দ্র।
আরও জানা যায়, কল্যাণনগর গ্রামে পৌরসভার সাবেক মেয়র কামরুল হাসান সিদ্দিকী জুয়েলের খামারের ৭০০ মুরগি মারা গেছে। উপজেলা ও পৌর এলাকার বিভিন্ন গ্রামের অর্ধশতাধিক পুকুর ডুবে মাছ ভেসে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা। থালতা-মাঝগ্রাম ইউপি সদস্য মুকুল হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার ভোরে ওমরপুর মাঠে মাছ ধরতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বৃদ্ধ একাব্বর আলী বেপত্তা (৭০) নামের বৃদ্ধ মারা গেছেন। স্থানীয়রা মাঠ থেকে ওই বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার করেন। তিনি বিষ্ণপুরের মৃত ময়েজ উদ্দিনের ছেলে।
ইউপি সদস্য মুকুল হোসেন আরও জানান, টানা বৃষ্টিতে বেশকয়েকটি গ্রামের বসতবাড়িতে পানি ঢুকেছে। ইউনিয়নের প্রায় ৫০ বিঘা মরিচ ক্ষেত ডুবে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে মাটির ঘর-বাড়িগুলো ভেঙে পড়তে পারে। নাগর নদীর পানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গুলিয়া হাইস্কুল সংলগ্ন নদীর বাঁধ যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে। স্কুল ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
এ ব্যাপারে বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) নন্দীগ্রাম শাখা কর্মকর্তা উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ সরকার বলেন, ‘পানির ঢেউয়ের কারণে বাঁধের মাটি কিছুটা সরে গেছে। বিষয়টি নজরদারিতে রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক সংস্কারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে জেলার শেরপুরে বিগত চারদিনের প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঙালি ও করতোয়া নদীর পানির অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। এমনকি পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় পৌরশহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডসহ উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অনেক বাসা-বাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে ২ হাজার পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত এক সপ্তাহে স্মরণকালের রেকর্ড বৃষ্টি হওয়ায় বাঙালি ও করতোয়া নদীতে পানি বাড়ছে। পানি ঢুকে পড়েছে পৌর শহরের পূর্ব ঘোষপাড়া, পূর্বদত্তপাড়া, নামা ঘোষপাড়া ও উত্তর সাহাপাড়ার শতাধিক বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। এসব বাসা-বাড়ির মধ্যে এখন হাটু পানি। পাশাপাশি উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ১০ গ্রামের ৪০০ পরিবার, খামারকান্দি ইউনিয়নের ৫ থেকে ৬টি গ্রামের ৩০০ পরিবার, গাড়ীদহ ইউনিয়নের ৪০০ পরিবার, খানপুর ইউনিয়নের ৪০০ পরিবার, সুঘাট ও সীমাবাড়ী ইউনিয়নের অন্তত ৯০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
কথা হয় পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিমাই ঘোষের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘করতোয়া নদীর পানি বাড়তে থাকায় তার ওয়ার্ডের ৩ মহল্লায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এসব এলাকার শতাধিক বাসা-বাড়িতে পানি উঠেছে। ডুবে গেছে রাস্তা-ঘাট। অনেকের শোবার ঘরে বুকসমান পানি। এরমধ্যে ৫টি পানিবন্দি পরিবার বাসা-বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে শহরের শেরপুর ডিজে মডেল হাইস্কুলের ৪টি শ্রেণিকক্ষে।
বন্যার পানি ঘরে ঢুকে পড়ায় ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়া সোলায়মান আলী বলেন, ‘আমি পেশায় একজন দিনমজুর। টানা বৃষ্টির কারণে দিনমজুরি করতে পারছি না। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন আর সংসার চলছে না।’
একই প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেওয়া মিন্টু মিয়া ও মলি বেগম বেগম বলেন, ‘সরকারিভাবে এখনো কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম মানবেতর জীবনযাপন করছি।’
এদিকে টানা বৃষ্টিতে শত শত বিঘা জমির আমন ধান ও সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে অনেক জলাশয় ডুবে যাওয়ায় লাখ লাখ মাছ পানিতে ভেসে গেছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, ‘প্রবল বর্ষণে অনেক জলাশয়ের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। সেটি নিরুপণের চেষ্টা চলছে। তাই এই মুহূর্তে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিসংখ্যান বলা সম্ভব নয়।’
একই কথা বলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার। তার দপ্তরের কর্মকর্তারা ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন বলে দাবি করেন।
শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা সুলতানা বলেন, ‘বিগত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে পৌরসভাসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সেসব এলাকাগুলো সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। পানিবন্দি মানুষকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।’
ঢাকা বিজনেস/এইচ