সদ্যবিদায়ী ২০২২ সালের অধিকাংশ সময় দেশের পুঁজিবাজার ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির মতো বিভিন্ন কারণে পুঁজিবারের নেতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। এই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও সুফল খুব একটা অসেনি। তবে নতুন বছরে (২০২৩) পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। অপেক্ষমাণ উদ্যোগগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হলে নতুন বছরে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
পুঁজিবাজারের বিদায়ী বছরের অবস্থা ও নতুন বছরের বেশকিছু পরিকল্পনা নিয়ে ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এম. সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, ‘দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় বছরের শেষভাগে দেশের পুঁজিবাজার একটা বিয়ারিশ ট্রেন্ড পার করে। আশা করি, ২০২৩ সালের শুরুতেই এই সংকট কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’
কারণ হিসেবে সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি তার বৈশিষ্টগত সহনশীলতার কারণে বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া ২০২৩ সালের শুরুতেই ডিএসই’র অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড চালুকরণ, মোবাইল অ্যাপসের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্ড মার্কেটের জন্য স্বতন্ত্র অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠাসহ বাজারের অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গুণগত সম্প্রসারণের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করি, পুঁজিবাজারে এর সুফল মিলবে।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, ইসলামি সুকুক বন্ড তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ৩,১৬৮,০৮০.২৯ মিলিয়ন টাকা বাজার মূলধন নিয়ে ডিএসই’র ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে বহুল প্রতিক্ষিত ২৫০ সরকারি সিকিউরিটিজের লেনদেন শুরু হয়েছে। অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি)-এ লেনদেন শুরুর অপেক্ষায়। এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) চালুর কার্যক্রমও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পুঁজিবাজারে রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (আরইআইট) প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওটিসি প্ল্যাটফর্মে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আটকে আছে। এ কারণে কিছু কোম্পানিকে স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্মে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেশ কিছু কোম্পানিকে এক্সিট প্ল্যানের মাধ্যমে বাজার থেকে বের হওয়ারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ডিএসই ২০২২ সালে দুটো কোম্পানির (যশোর সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং আরবি টেক্সটাইল লিমিটেড) বিনিয়োগকারীদের অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে।
ডিএসই-সূত্রে আরও জানা গেছে, স্টার্টআপ খাতের উন্নয়নে যৌথ গবেষণা পরিচালনা ও পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়, পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনের বিষয়ে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের অবহিতকরণের উদ্দেশ্যে যৌথ প্রচারণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইপিও প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তথ্য, নিয়মনীতি আদান-প্রদানের সুবিধার্থে একটি হেল্প ডেক্স প্রতিষ্ঠা এবং আইপিও সম্ভাব্য প্রযুক্তি উন্নয়ন বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতাসহ সভা, সেমিনার, কনফারেন্স আয়োজনের লক্ষ্যে ডিএসই ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
সূত্রমতে, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের আগে থেকেই পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাবের ক্ষেত্রে শেয়ারের ক্রয়মূল্যেকে বাজার মূল্য হিসেবে বিবেচনার দাবি জানিয়ে আসছিল। এক যুগের বেশি সময় ধরে এ দাবি অমীমাংসিত ছিল। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেন। সে অনুযায়ী গত ১৭ জুলাই ২০২২ তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অভিমত চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতিক্রমে ৪ আগস্ট শেয়ারের ক্রয়মূল্যকে ‘বাজারমূল্য’ ধরে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট হিসাব করার নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২ টি ট্রেকহোল্ডার কোম্পানি এপিআই কানেক্টিভিটি স্থাপন করে তাদের নিজস্ব ওএমএস-এর মাধ্যমে লেনদেন শুরু করছে। এছাড়াও, ডিএসই থেকে ১১টি ট্রেকহোল্ডার কোম্পানিকে এপিআই ইউএটি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, অচিরেই এসব কোম্পানি নিজস্ব অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওএমএস)-এর মাধ্যমে সরাসরি লেনদেন করতে পারবে। এরই ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে আগ্রহী সব ট্রেকহোল্ডার কোম্পানিকে এ সুযোগের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে ব্লক মার্কেটে সর্বনিম্ন দামের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার বেচাকেনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বছরের একেবারে শেষভাগে শেয়ারবাজারে লেনদেনের গতি ফেরাতে তালিকাভুক্ত ১৬৯টি কোম্পানি ও মিউচ্যুায়াল ফান্ডের ওপর আরোপিত সর্বনিম্ন মূল্যস্তর তুলে নেওয়া হয়। তবে একদিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না।
সূত্র আরও জানায়, ডিএসই’র বর্তমান বোর্ডের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো এক্সচেঞ্জের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আধুনিক ডেটা সেন্টার তৈরি করা। এই উদ্দেশ্যে ট্রেকহোল্ডারদের ট্রেডিংয়ের সুবিধার্থে ম্যাচিং ইঞ্জিন ও অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওএমএস) হোস্ট করার জন্য ডিএসই টাওয়ার নিকুঞ্জে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ১০৬টি রেকের সুবিধা সংবলিত একটি টায়ার-৩ ডেটা সেন্টারের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ডেটা সেন্টারের হার্ডওয়ার স্থাপনের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় সফট্ওয়্যার সংযোজনের পর শিগগিরই ডাটা সেন্টার চালু করা সম্ভব হবে।
বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ.বি. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাজার পরিস্থিতি যতটা খারাপ বলা হচ্ছে, ততটা খারাপ অবস্থায় নেই। তবে ২০২৩ সালে পুঁজিবাজার বর্তমান সময়ের চেয়ে ভালো যাবে বলে মনে হচ্ছে। ডলারের দাম কিছুটা কমেছে। মূল্যস্ফিতিও সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তবে সর্বোপরি বাজারের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতায় ফান্ডামেন্টাল কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। কমিশনকে নেগোসিয়েশন করে ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, ‘পুঁজিবাজার সম্পর্কে আমি বলতে চাই মার্কেট ডিটারমাইন সলিউশন অর্থাৎ বাজার কী চায়, তা নির্ধারণ করতে হবে। এরপর সে অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে পুঁজিবাজারে যেসব সংকট রয়েছে, সেগুলো যে আগামী বছর চলে যাবে, তা সহজেই বলা যাচ্ছে না। বাজারের উন্নয়নে বর্তমান কমিশনের কোনো গাফিলতি নেই, তাদের সিদ্ধান্তে কিছু ভুল ছিল। যেমন সর্বনিম্ন দাম আরোপ করা তাদের মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বছর শেষে সর্বনিম্ন দাম উঠিয়ে দিয়ে একদিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশের বেশি শেয়ার দর কমতে পারবে না বলে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটিও বাজারের উন্নয়নে খুব একটা কাজে আসবে না। কমপক্ষে আড়াই শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ মূল্যস্তর নামার সুযোগ করে দিতে হবে।’
আবু আহমেদ আরও বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় কমিশনকে মৌল ভিত্তিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে। নতুন বছরসহ আগামীতে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতায় ভালো মানের কোম্পানিগুলোকে বাধ্যতামূলক তালিকাভুক্ত করতে হবে।’
বাংলদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতিতে যে ইন্ডিকেটরগুলো রয়েছে, সেগুলো ভালো হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অনেকটা স্তিমিত হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে বলা যায় ২০২৩ সালে পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি ভালো হবে। মূলত অর্থনীতির ভালো-মন্দের ওপর পুঁজিবাজারের ভালো-মন্দ নির্ভর করে। দেশের অর্থনীতি ভালো রাখতে হলে রাজনীতিও স্থিতিশীল রাখতে হয়। সেদিক দিয়ে বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যথেষ্ট স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।’
শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘পুঁজিবাজারের উন্নয়নে আমরা অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। চলতি বছরে প্রয়োজনে আরও উদ্যোগ নেবে কমিশন। ৪ জানুয়ারি অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) চালু হবে। চলতি বছরে আমরা মিউনিসিপল বন্ড নিয়ে আসবো। আশা করছি, চলতি বছরে ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজিবাজার।’
ঢাকা বিজনেস/এনই/