২১ জুন সম্ভবত
পুতিন তার জীবনের সবচেয়ে জটিল সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহ
তারজন্য জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারতো। তবে পুতিন এক্ষেত্রেও তার 'গুণের' পরিচয় দিয়েছেন।
লৌহমানব হিসেবে পরিচিত পুতিনের অবস্থা যে অনুমানের তুলনায় অনেক নাজুক তা এই বিদ্রোহের
ঘটনাই প্রমাণ করে। কিন্তু একথাও মানতে হবে কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়াই এই বিদ্রোহ দমন
করা গেছে। পুরো বিষয়টিই যে কৌশলগত তাতে কারো সন্দেহ নেই। ওয়াগনার বাহিনীর প্রধানও এক্ষেত্রে
কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন আর পুতিনও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
আমরা যদি ২১ জুনের
ঘটনার দিকে তাকাই তাহলে স্পষ্টতই দেখতে পারব সিপাহী বিপ্লব আস্তে আস্তে ম্রিয়মাণ হয়ে
আন্দোলনের নাম ধারণ করেছে। ওয়াগনার মিলিশিয়া বাহিনী প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের
সঙ্গে পুতিন সমঝোতার পথে হেঁটেছেন। তবে এই সমঝোতা সাময়িক সময়ের জন্য। ধারণা করা হচ্ছিল,
প্রিগোজিন বেলারুশের দিকে যাবেন। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে
তার বন্ধুত্ব অনেক দিনের। সম্ভবত লুকাশেঙ্কোর সহায়তায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো
তিনি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে তিনি আফ্রিকার দিকে এগিয়েছেন।
প্রায় ২৫ হাজার
ওয়াগনার মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মস্কো অভিমুখে মার্চ করে এগোচ্ছিলেন। বিভিন্ন
সূত্র থেকে জানা গেছে, রাশিয়ান এফএসবি প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। তবে তা
খুব কার্যকর হয়নি। যদিও পুতিন মস্কো প্রতিরক্ষার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা
দিয়েছিলেন। পুতিন শীতলকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা
সম্ভবত ১৯১৭ সালের মতোই কোনো ঘটনা ঘটতে দেখছি। তখন রাষ্ট্র একটি ভুল যুদ্ধে নিপতিত
হয়েছিল।' পুতিনের মতে, ওই সময় রাশিয়ানরাই রাশিয়ানদের মারছিল। ২১ জুন ওয়াশিংটনের
গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় একটি প্রশ্নই ভেসে বেড়াচ্ছিল, প্রিগোজিন আদৌ তার 'ন্যায়বিচারের
কুচকাওয়াজ' চালু রাখবেন কি না এবং পুতিন বিদ্রোহ দমনে সামরিক বাহিনীকে গুলি চালনার
নির্দেশ দেবেন কি না। যতটুকু জানা গেছে, ওয়াগনার বাহিনী উত্তরের দিকে এগোয় এবং সামরিক
বাহিনী তাদের কোনো বাধা দেয়নি।
পুতিনের কাছে
কিছু সিদ্ধান্ত ছিল। সেগুলোও প্রীতিকর নয়। রস্তভে ওয়াগনার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
গড়ার ক্ষেত্রে তিনি চেচেন ফোর্সের কমান্ডার রামজান কাদিরভকে ব্যবহার করতে পারবেন।
কিন্তু এর পরিণতি হতো নৃশংস। তাছাড়া সামরিক বাহিনীর ওপর নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েও
পুতিনের সন্দেহ ছিল। তিনি এমন এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে চলছিলেন যেখান থেকে মুক্তি
নেই। সচরাচর পুতিন ভুল চাল চালেন না যদি আমরা ইউক্রেন হামলার বিষয়টি বাদ দেই। কারণ
২১ জুন রাশিয়ার ভেতর সংঘর্ষ বাজে দিকে মোড় নিতে পারতো যেকোনো সময়। কিন্তু দুই পক্ষই
এক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন।
যাহোক, এই বিদ্রোহের
উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুতিন এই বিদ্রোহ দমাতে সক্ষম হয়েছেন। এজন্য
তাকে সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতে হয়নি। কিন্তু
এটুকু মানতেই হবে, প্রিগোজিন তার জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু তা বেশিক্ষণ
স্থায়ী হয়নি।এক্ষেত্রে দুজনেরই কৌশলগত অবস্থান ছিল। পুতিনের একটি গুণ হচ্ছে, যদি আমরা এটিকে গুণ হিসেবে
মেনে নিই, তাহলে একচ্ছত্র শাসক হিসেবে তিনি গুণী। অন্তত তার অভিব্যক্তি কখনও মলিন হয়
না। যেন প্রতিবারই বলতে চান, ‘নিজের দুরবস্থা
কাউকে বুঝতে দিও না।' তার অধস্তন সবার মধ্যে মনোমালিন্য থাকলেও তিনি পাত্তা দেন না।
সম্ভবত ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এত মাথা ঘামান না। কারণ বিগত এক বছর ধরেই প্রিগোজিন রাশিয়ার
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শিগুর সমালোচনা করে আসছেন। পুতিন এসব নিয়ে কখনও মন্তব্য
করেননি। ২৪ জুনের হিসাব অবশ্য আলাদা। ১৯১৭ সালের গৃহযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বিদ্রোহ দমনের
জন্য প্রিগোজিন যে বাণী উচ্চারণ করেছেন সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। তবে প্রিগোজিন কৌশলগতভাবে
দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমা শক্তির ওপর। তিনি বলেছিলেন, 'আমাদের বিরুদ্ধে এখন পশ্চিমা
সামরিক, অর্থনৈতিক এমনকি প্রযুক্তিগত যন্ত্রও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমাদের ভেতরে রাষ্ট্রীয়ভাবে
অনিরাপত্তা এবং জাতীয় গৌরবের ভাবনার বিষক্রিয়ার কারণে পুতিন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে
পারছে।'
বাইডেন প্রশাসনও এই বিদ্রোহের বিষয়ে মতামত দিয়েছে। তবে তারাও রাশিয়ার অস্থিতিশীল পরিবেশের কোনো সুযোগ নিতে চায়নি। তারা চেয়েছে অবস্থা শান্ত হোক। বাইডেন এবং তার দল অন্য দেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। তাদের মূলনীতি একটাই— মিত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও সব সময় প্রস্তুত থাকা। তবে তারা কোয়াড থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৈশ্বিক শক্তিকে একটি বার্তাই দিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে বেশি হাঙ্গামা না করাই ভালো। রাশিয়ার পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে অবস্থা আরও ভয়ংকর মোড় নেবে। তাদের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে লাভ খোঁজার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, বার্তাটি ইউক্রেনের জন্যই বেশি প্রযোজ্য। ইউক্রেন যেন রাশিয়ার বিদ্রোহের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনো বড় সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা না করে। যদি তা করা হয় তাহলে সামরিক বাহিনী অন্তর্ভুক্ত হয়ে পরিস্থিতি আরও বাজে দিকে মোড় নেবে।
এই মুহূর্তে পুতিনের সামনে অনেকগুলো সমস্যা। এই বিদ্রোহের ফল পুতিনের পক্ষে যাওয়া না যাওয়া মুখ্য নয়। বরং এই বিদ্রোহ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট৷ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। রাশিয়াকে দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধ ভীষণ ভোগাবে।
লেখক: সংবাদকর্মী