২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



জানা-অজানা
প্রিন্ট

যে গ্রামে পুরুষ নেই

নুরজাহান নুর || ২৭ নভেম্বর, ২০২২, ১২:৪২ এএম
যে গ্রামে পুরুষ নেই


পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। কেনিয়ার পাহাড়ি সবুজ-শ্যামল সুন্দর পরিবেশে সাম্বুরু এলাকায় গড়ে উঠেছে এক গ্রাম ‘উমোজা’। সোয়াহিলি ভাষায় উমোজা মানে ঐক্য। নারীদের গ্রাম হিসেবেই বিশ্বব্যাপি পরিচিত এই গ্রাম। পুরুষের বসবাস সেখানে নিষিদ্ধ। আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী রূপের মতোই রঙিন বৈচিত্র্যে ভরপুর গ্রামটি। 

২৭ বছর ধরে আশ্চর্য এই গ্রামে শুধু নারীরাই থাকেন। এই গ্রামে কেনো পুরুষ থাকতে পারে না। নারী পরিচালিত গ্রাম বলে। গ্রামটি গঠিত হয় ১৯৯০ সালে। ১৫ জন ধর্ষণ শিকার হওয়া নারী একসঙ্গে এই গ্রামে বসবাস শুরু করেন।পরবর্তীকালে এখানে বাল্যবিবাহ ও পারিবারিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়া নারীরাও এই গ্রামে এসে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। এখন সেখানে প্রায় ৫০ জন নারীর বসবাস। 

বহু অন্তঃসত্ত্বাও এখানে ঠাঁই নেন। যদি তাঁরা পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, তা হলে সন্তানের ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত সেই সন্তান এই গ্রামে থাকার অনুমতি পায়। ১৮ বছর হয়ে গেলে তাকে উমোজা ছাড়তে হয়। শর্ত এমনই।

গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করার কথা যে মহিলা ভেবেছিলেন, তিনি হলেন রেবেকা লোলোসোলি। স্বামী ও বিভিন্ন পুরুষের কাছে নির্যাতিত হয়েছেন বহুদিন। চেষ্টা করেছেন বিচার চাওয়ার। কিন্তু পরে দেখলেন নির্যাতনকারীরাই ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধে। তাই জিদ থেকেই গড়ে তোলেন নারীর এই অভয়ারণ্য উমোজা। যেখানে আবাস হবে নির্যাতিত নারী ও তার সন্তানদের। তবে পুরুষের বসবাস নিষিদ্ধ। তার মানে এই নয় যে, পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। পুরুষ শুধু রাত্রিযাপন করতে পারে না সেখানে। 

এমন একটি চিন্তা ভাবনা করার জন্য তাকে প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কঠিন শাস্তিও পেয়েছিলেন তিনি। প্রথমে ৪ জন নারী নিয়ে তিনি জেদের বশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে এই গ্রামের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি বছর নিয়ম করে এই গ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব বদল হয়। ২ জন প্রতিনিধি প্রতি বছর গ্রাম পরিচালনা দায়িত্ব পান। ৫০ জন নারী ও ২০০ শিশু রয়েছে এখানে। ছোটদের পড়াশুনো থেকে ঘরের কাজ সমস্ত কিছু শেখান গ্রামের মহিলারাই।নিজেদের ভরণপোষণের দায়িত্ব তাদের নিজেদেরই। 

উমোজার ভিন্ন জীবন ব্যবস্থা, নারীর সংগ্রামের গল্প আর অসাধারণ বৈচিত্র্যে ভরা জীবনধারা সম্পর্কে জানতে, নতুন এক পৃথিবী গড়ার অনুপ্রেরণায় অনেক পর্যটক ভিড় জমান উমোজায়। আর সেটি ঘিরেই উমোজার নারীরা গড়ে তুলেছেন ছোট্ট আয়োজন, যাতে এই গ্রামের অভিজ্ঞতা সবসময় মনে গেঁথে থাকে সবার মনে। কেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানে অতিথিদের বরণ করে নেয় উমোজা’র সংগ্রামী নারীরা। তাদের রঙিন ও ঝলমলে পোশাক আর গয়নায় মুগ্ধ হতে হয় প্রথম দেখাতেই। সেই মুগ্ধতাকে পুঁজি করেই চলছে উমোজা’র নারীদের বেঁচে থাকা। 

উমোজার জীবনধারা, সেখানে নারীদের হাতেই তাদের  সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুল, ইউএসএইডের সাহায্যে নির্মিত উমোজা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আর জাদুঘর সবকিছুতেই নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যাবে উমোজা’র আজকের অবস্থানে উঠে আসার।

উমোজায় শিশুদের পড়ালেখার জন্য রয়েছে একটি স্কুল। উমোজার স্কুলের চিত্রটিও বেশ মনোরঞ্জক বলা চলে। সেখানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যাতে তারা ভবিষ্যতে অহিংস আর নারীর প্রতি নির্যাতনবিহীন একটি সমাজ তৈরি করতে পারে। উমোজা’তে পুরুষের বাস নিষিদ্ধ হলেও গ্রাম থেকে কিছু দূরে এই নারীদের উদ্যোগেই নদীর পাশে ক্যাম্পসাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে করে উমোজাতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারে প্রাণ খুলে। 

সামান্য টাকায় উমোজাতে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কেনা গয়না ও নারীদের বানানো বিভিন্ন গহনা কেনার টাকাই উমোজাতে নারীদের জীবনধারনের মূল চাবিকাঠি।

২০১৫ সালে কেনিয়ায় এসেছিলেন বারাক ওবামা। উমোজার এই গ্রামে ঘুরে আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘বিশ্ব জুড়েই মহিলাদের দমিয়ে রাখার একটি রীতি রয়েছে। মহিলাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করা হয়। এ সমস্ত কু-রীতিনীতি বদলানোর প্রয়োজন। অঙ্গহানি, বালিকা বিবাহের মতো প্রথাগুলো অনেক পুরনো। এই শতাব্দীতে এগুলোর কোনও জায়গা থাকা উচিত নয়।’

মূলত ২০০৪ কিংবা ২০০৫ সালের দিকে উমোজার নারীরা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে শুরু করে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য। এরপর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনুপ্রেরণার খোঁজে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। এছাড়া উমোজার নারীদের সঙ্গী হয়েছে ইউনিসেফও। তবে এতকিছুর পরও আফ্রিকার পুরুষসমাজের বিভিন্ন অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করে চলেছে তারা। এখনো পুরুষশাসিত সমাজ সঠিকভাবে নিতে পারেনি নারীদের এই বীরত্বগাথা। তবে সবকিছু ছাপিয়েই উমোজার নারীরা এগিয়ে চলছে। 

সবকিছুর পর পুরুষরাই তাদের সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন উমোজার নারীরা। আর কোনোকিছুকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের সামর্থ্য দিয়েই আয় করে নিচ্ছেন জীবনযাপনের সবকিছু। প্রায় পঞ্চাশ নারী ও ২০০ শিশুর নিরাপদ আবাসস্থল উমোজা এখন ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের দারুণ এক গন্তব্য।

ঢাকা বিজনেস/এনই/



আরো পড়ুন