১৯৬৩ সাল, তুরস্কের নেভশেহির প্রদেশ। এক ভদ্রলোক নিজের বাসা মেরামত করছিলেন। হঠাৎ বাসার একটি দেয়ালে আঘাত করতেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে দেয়াল, ধ্বসে যায় মেঝে। তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন মাটির নিচের অন্ধকার এক কক্ষে। কক্ষের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই তিনি দেখতে পান দরজার ওপারের অন্ধকারে রয়েছে অজানা এক গহ্বর। সে আস্তে আস্তে হেটে প্রবেশ করেন সেই গহ্বরে। এটি ছিল ৬০০টিরও বেশি প্রবেশদ্বারগুলির মধ্যে প্রথম, যা ভূগর্ভস্থ শহর ডেরিংকুয়োর দিকে নিয়ে যায়।
সেইসঙ্গে নিজের অজান্তেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন ‘ডেরিংকুয়ো’। এটি ২ হাজার বছর পুরনো মাটির নিচের এক শহর। ডেরিংকুয়োর আক্ষরিক অর্থ 'গভীর কূপ'। এটি তুরস্কের আনাতোলিয়ার কাপাদোসিয়া এলাকার নেভিশেহির প্রদেশের একটি ভূগর্ভস্থ শহর। এটির প্রাচীন নাম এলেংগুবু। পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ৮৫ মিটারেরও বেশি নীচে রয়েছে এর পরিধি, যেখানে ১৮টি স্তরের টানেল রয়েছে। এর মধ্যে জনসাধারনের জন্য ৮ টি খোলা রাখা হয়েছে। শহরটি হাজার হাজার বছর ধরে প্রায় নিয়মিত ব্যবহৃত হয়েছিল। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ও গভীরতম খননকৃত ভূগর্ভস্থ শহর। এই শহরটা এতটাই বড় যে এখানে রান্নাঘর, শয়নকক্ষ, বাথরুম, খাদ্য সংগ্রহস্থল কক্ষ, তেল ও মদ রাখার কক্ষ,পানির কুপ, স্কুল, গির্জা, রান্নাঘর,পশুর আস্তাবল,সমাধীস্থল সহ একটি সম্পূর্ণ শহর।
মাটির নিচের এই শহরে প্রবেশের প্রতিটি দরজা বন্ধ করা থাকতো প্রায় ৫ ফুট চওড়া ও ৫০০ কেজি ওজনের গোলাকার পাথরের দরজা দিয়ে। গোলাকার পাথরের এই দরজাগুলো শহরকে রক্ষা করতো নানা রকম বিপদের হাত থেকে। বিভিন্ন প্রয়োজনের জন্য বিভিন্ন মাপের কক্ষ ছিল। বড় রুমগুলো এই শহরের লোকজন সভার জন্য ব্যবহার করতো। ৫০টি বায়ুচলাচল শ্যাফট উপরে থেকে বাতাস নিচে নিয়ে আসতো। হাজার হাজার ছোট নলের সাহায্যে পুরো শহরে সেই বাতাস প্রবাহিত করা হতো। প্রায় ২০,০০০ মানুষ এখানে অনায়াসে বসবাস করতে পারবে, সেই ভাবেই এই শহর করে তৈরি করা হয়েছিল। এটি বিস্তৃত একটি ভূগর্ভস্থ আবাসস্থল। চলাচলের জন্য গোপন সুড়ঙ্গ-পথের ব্যবহার করে কয়েকটি শতাব্দী জুড়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এখানে বসবাস করতো।
তবে মনে করা হয় যে, এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত ২০০টিরও বেশি ছোট ও পৃথক ভূগর্ভস্থ শহর এই সুড়ঙ্গগুলির সাথে সংযুক্ত হতে পারে, যা একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক তৈরি করে। তুরস্কের আনাতোলিয়ার কাপাদোসিয়া এলাকাটি ছিল অগ্নুৎপাতের জন্য বিখ্যাত। কয়েক মিলিয়ন বছর আগে, এই এলাকাটিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল তখন সমস্ত এলাকা ডুবে গিয়েছিল ছাই ও লাভার নিচে। পরবর্তীতে এই ছাই ও লাভা পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় নরম শিলায়। প্রাচীন আনাতোলিয়ার অধিবাসীরা বুঝতে পেরেছিল যে তারা এই শিলা খোদাই করে ঘর বাড়ি নির্মাণ করতে পারবে। ফলে তারা সেই নরম শিলা খুঁড়ে তৈরি করা শুরু করে ঘরবাড়ি ও আশ্রয়স্থল,মাটির নিচে তৈরি করে শহর।
কাপাদোসিয়াতে মাটির নিচে এমন বহু স্থাপনা খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বিশাল ও গভীর হলো ডেরিংকুয়ো। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্বাস করেন যে, ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ প্যাসেজ দিয়ে ডেরিংকুয়োর সঙ্গে কায়মাক্লি নামের আরেকটি ভূগর্ভস্থ শহরকে যুক্ত হয়। এর থেকে ধারনা করা যায় যে কাপাদোসিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে কিছুটা সহযোগিতা ছিল। কারা কোন সময়ে এই শহরটি বানিয়েছিলেন তা সঠিক জানা যায়নি। ডেরিংকুয়োর প্রথম লিখিত উল্লেখটি ৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে এই ভূগর্ভস্থ শহরটি আসলে অনেক পুরনো। তবে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১২০০ অব্দে আনাতোলিয়ায় ছিল হিট্টাইট জাতির রাজত্ব। এই সময়ের পর, হিট্টাইট সাম্রাজ্যটি সম্ভবত একাধিক আক্রমণ এবং যুদ্ধের কারণে ছোট গোষ্ঠীতে ভেঙে পড়ে।
কিন্তু ডেরিঙ্কুয়ের সৃষ্টির কৃতিত্ব কার, তা নিয়ে একটি আংশিক রহস্য রয়ে গেছে। ভূমধ্যসাগরীয় গুহাগুলির বিস্তৃত নেটওয়ার্কের ভিত্তিটি প্রায়শই হিট্টাইটদের দায়ী করা হয়, যারা ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফ্রিজিয়ানদের আক্রমণের শিকার হয়ে পাথরের প্রথম কয়েকটি স্তর খনন করতে পারে। পরবর্তীকালে এই এলাকায় বলকান থেকে ফ্রিজিয়ানদের আগমন ঘটে। কারো কারো মতে, ফ্রিজিয়ানদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হিট্টাইটরা এই ডেরিংকুয়ো শহর নির্মাণ করেছিল। আর হিট্টাইটরা যদি এই শহর তৈরি করে থাকে, তবে তা তারা তৈরি করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের আগেই।
আবার আরেকদল বিশেষজ্ঞরা ধারনা করেন, মাটির নিচের এই শহর খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৮০০ অব্দের মধ্যে ফ্রিজিয়ানরাই তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে পার্সিয়ান,ম্যাসেডোনিয়ান (আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট), গ্রীক, আর্মেনিয়ান, সিরিয়ান এবং আরও অনেক গোষ্ঠী কাপাদোসিয়াতে উপস্থিত হয়। কাপাদোসিয়া রাজ্যের ভূগর্ভস্থ শহরগুলির কথা লিখিত পাওয়া যায় গ্রীক সেনা ও ইতিহাসবিদ জেনোফোনের (৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) লেখায়। তিনি বহুকাল ধরে এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এটি প্রাচীনতম লিখিত রচনা যা ডেরিংকুয়োর কথা উল্লেখ করে বলে মনে হয়।
তার লেখা ‘অ্যানাবেসিস’ নামক বইতে তিনি কাপাডোসিয়া অঞ্চলে বা তার কাছাকাছি আনাতোলিয়ান জনগণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, এখানে ঘরগুলি ছিল ভূগর্ভস্থ, ঘরের প্রবেশের মুখগুলো কুয়ার মতো হলেও নিচে ছিল যথেষ্ট প্রশস্ত। মানুষ যাতায়াতের জন্য সিঁড়ি ব্যবহার করতো। ছাগল, ভেড়া, গবাদি পশু সুরঙ্গ পথে চলাচল করতো।
আশ্রয়স্থল কিংবা বাসস্থান থেকেও বেশি কিছু ছিল এই ডেরিংকুয়ো। এটি ছিল একটি দুর্গের মতো। ১৯৮৫ সালে অঞ্চলটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়।
ঢাকা বিজনেস/এন