খেলার
জগতে আদৌ বৈষম্যের কোনো স্থান আছে? সেখানে নিজেকে প্রমাণ করার বিষয় আছে।
সমানে সমানে লড়াই হয়তো সবসময় হয় না। কিন্তু যে মঞ্চটি প্রস্তুত থাকে তার
প্রেক্ষাপটে বৈষম্যের সুযোগ কম। সেজন্যেই ক্রীড়াক্ষেত্রে চমকের দেখা মেলে।
কিন্তু যে মঞ্চে হবে লড়াই, সেখানে পৌঁছানোর পথও মসৃণ হতে হয়। হয়তো কিছু
বেয়াড়া সৈনিক বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে ভয় পায় না, কিন্তু তা সবার ক্ষেত্রে
খাটে না। সারা পৃথিবীতেই আস্তে আস্তে নারী ক্রীড়াবিদদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ
দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রায় সবজায়গায়ই বেতন বৈষম্য থেকেই যায়। আমাদের দেশের
পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আরও সহজভাবে বোঝানো যেতে পারে।
দেশের
ক্রীড়াক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীরাই পিছিয়ে রয়েছে, এটা কোনোভাবেই বলা
যায় না। ক্রিকেটে এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি জয়, ফুটবলে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ এবং
সম্প্রতি প্রমীলা বাহিনীর এশিয়া কাপ জয় সে কথাই বলে। কিন্তু যদি ভালোভাবে
সংবাদমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে একটি ব্যাপার স্পষ্ট, নারী
ক্রীড়াবিদরা পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে অতটাও গুরুত্ব পান না। তারা ভালো লাগে
তাই খেলেন। তাদের নিজের আগ্রহের জায়গায় তারা টিকে আছেন। লড়াই করছেন
প্রতিষ্ঠা পেতে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠা কিসে? তাও বুঝে নেওয়া কঠিন কিছু নয়।
এই প্রতিষ্ঠা মূলত সমাজে তার আগ্রহী খেলোয়াড় হিসেবে চিহ্নায়নে। পেশাদার
হিসেবে এখনো নারী ক্রীড়াবিদদের কেন বিবেচনা করা হয় না, সেটি বড় প্রশ্ন।
কিন্তু এ বিষয়ে আদৌ কোনো কাজ করা হচ্ছে কি না, তা আরও বড় প্রশ্ন।
নানা অজুহাতে দিয়ে অবশ্য এই নারী-পুরুষ বেতন বৈষম্যের বিষয়টি যাচাই করা হয়। নারীদের খেলা দেখতে দর্শক আসে কম, তাদের খেলায় স্পন্সর কম, বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণে নারীদের ক্রীড়া আসরও পুরুষ আসরের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। এসব খোঁড়া যুক্তি যে ধোপে টেকে না, তা তো এখন স্পষ্ট। বিশেষত সাফ নারী চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সারাদেশের উচ্ছ্বাস কিন্তু তা বলে না। এটুকু স্পষ্ট যে নারী ক্রীড়াক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ বাড়তে শুরু করেছে। কিছু কিছু ক্রীড়াক্ষেত্র শুধু নারীদের জন্যই নির্ধারিত। কিন্তু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিকেট এবং সামান্য পরিসরে ফুটবল নিয়েই আমাদের বেশি আগ্রহ।
সবদিক
বিবেচনায় নারী-পুরুষ বেতন বৈষম্য মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি ভারতীয়
ক্রিকেট দলে নারী-পুরুষ বেতন সমান করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। চলমান
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তারপর আমাদের দেশেও
বিষয়টি আবার জোরসোরে আলোচনায় আসে। অবশ্য নারী-পুরুষ বেতন বৈষম্য নিসরণের
প্রাথমিক উদ্যোগ নেয় নিউজিল্যান্ড। তারাই সর্বপ্রথম এমন উদ্যোগ নেয়। আর তা
সারাবিশ্বেই আলোড়ন তোলে।
গত
তিন বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মেয়েদের বেতন বাড়িয়েছে।
সর্বোচ্চ ‘এ’ গ্রেডে বেতন বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। এখন ‘এ’ গ্রেডে থাকা একজন
নারী ক্রিকেটার বেতন পেয়ে থাকেন ৮০ হাজার টাকা। ‘বি’ গ্রেডে বেতন ৬০ হাজার
টাকা। ‘সি’ গ্রেডে বেতন ৪০ আর সবার নিচে থাকা ‘ডি’ গ্রেডে একজন নারী
ক্রিকেটার বেতন পান ৩০ হাজার টাকা। এ বছর বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তিতে আছেন
২৪ জন ক্রিকেটার। পুরুষ আর নারী ক্রিকেটারদের বেতনের পার্থক্যটা ১২গুণ।
কিন্তু ফল যেন উলটো। নারী খেলোয়াড়দের ঐতিহ্যের শুরু পাকিস্তান আমল থেকেই।
পাকিস্তান অলিম্পিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের পুরুষ অ্যাথলেটদের চেয়ে অনেক
বেশি সফল ছিলেন নারী খেলোয়াড়েরা। এখনো সেই ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে।
ক্রীড়াবিদদের
বেতন নির্ধারিত হয় তার সার্বিক পরিশ্রম, অবকাঠামোগত অবস্থা, তার খরচ ও
অন্যান্য বিষয় মাথায় রেখে। নারীদের বেতনের বিষয়টি কী ভেবে করা হয়, তা আজও
স্পষ্ট নয়। ক্লাব পর্যায়েও নারীদের নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়। দেশের
সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক বাস্তবতায় পারিশ্রমিকের এই পার্থক্য দ্রুতই দূর করা
কঠিন। তবে এটি কমিয়ে আনতে তাদের উদ্যোগের কমতি নেই। ইতিবাচক ধারায়
বৈষম্যগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। পুরুষদের ক্রিকেট যে জায়গায়, মেয়েদের
ক্রিকেট কি ওই জায়গায়? পুরুষদের জন্য পৃষ্ঠপোষক আছে। লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে কথা
বলা সহজ। কিন্তু বাস্তবতাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু যা যা উদ্যোগ
নেওয়া হচ্ছে তা এখনো ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি।
দেশে ক্রীড়াক্ষেত্রের বেহাল দৃশ্য রীতিমতো হতাশাজনক। কিন্তু নারীকে পেশাদার জগতের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরিতে ঘাটতি কোথায়, তা বোঝা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে দ্রুত আশু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। উন্নত বিশ্বে ভেবেচিন্তে এগিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন সবাইকেই তাল মেলাতে হয়। তাই পা ফেলতে হয় দ্রুত। প্রায় আট গুণ কম বেতন পেয়েও ক্রিকেট দুনিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছেন নারী ক্রিকেটার। ক্রীড়াঙ্গনে নারী খেলোয়াড়দের সাফল্য এবং অর্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের সার্বিক উন্নয়নের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করে সমতা নিশ্চিত করতে হবে। এসব করতে হবে দ্রুত।
লেখক: সংবাদকর্মী