এখনো গ্রামাঞ্চলে এয়ারগান নিয়ে পাখি শিকারে দেখা যায় শৌখিন শিকারীদের। বন্যপ্রাণী শিকার করে লাঠিতে ঝুলিয়ে এখনো ঘরে ফেরেন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর লোকজন। আগে এই দৃশ্য নিয়মিত চোখে পড়লেও এখনো দেখা যায় কালেভদ্রে।
জানা যায়, এককালে বরেন্দ্র খ্যাত রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে নিবীড় বনাঞ্চল ছিল। এসব বনে বাস করতো বাঘ, হরিণ, বন্য মহিষ, শূকরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। মুঘল ও বৃটিশরা এখানে আসতেন বন্যপ্রাণী শিকারে। উনিশ শতকের শেষের দিকে চাষাবাদ শুরু হলে ক্রমেই উজাড় হতে শুরু করে বনাঞ্চল।
কালের বির্বতনে এখনো ঝোপঝাড় ও কিছু ছোট জঙ্গল এই অঞ্চলে রয়ে গেছে। আবাস সংকটে বাঘ, হরিণ, বন্য মহিষ বিলুপ্ত হলেও টিকে রয়েছে শেয়াল, বেজি, বাগডাসা, বনবিড়ালসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। তবে ভূমিপুত্রদের হাত থেকে রেহায় পাচ্ছে না এসব বন্যপ্রাণী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ বন্যপ্রাণী মারেন শুধু খাওয়ার উদ্দেশ্যে। কেউ কেউ শিকার করেন বিক্রি কিংবা পোষার জন্য। কেউ আবার যুক্ত বন্যপ্রাণী পাচারে। এসব কর্মকাণ্ডই আইনত দণ্ডনীয়। বন্যপ্রাণী দেশের সম্পদ। বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হলে অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে। টান পড়বে পবিবেশতন্ত্রেও।
বন দপ্তর বলছে, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করছে বন অধিদপ্তর। দেরিতে হলেও সচেতন হচ্ছে মানুষ। আইনের কঠোর প্রয়োগে বন্যপ্রাণী হত্যা-পাচার কমলেও একেবারেই নির্মূল করা যাচ্ছে না।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি উত্তরের জেলা দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে একদল সাঁওতাল শিকারি অর্ধশত বন্যপ্রাণী হত্যা করে। আদি পুরুষদের মতো তীর, ধনুক, বল্লম ও লাঠি নিয়ে জঙ্গল ঘেরাও করে বন্যপ্রাণীগুলো মারা হয়।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর চারঘাটে বাবা ও ছেলে মিলে ফাঁদ পেতে ছয় শতাধিক বাবুই পাখি শিকার করেন। জবাই করে পাখিগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে নেয়ার আগেই ধরা পড়ে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ১ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে যেতে হয় বাবা-ছেলেকে।
তৎপরতা থেমে নেই বন দপ্তরের। ২০১২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এক দশকে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ৩৩০টি স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছে রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। একই সময়ে ২৭০টি সরিসৃপ, ৪৮২০টি পাখি, ১৫১টি কুইচা, ২০০ বস্তা সামুক, ৫০ বস্তা কাঁকড়া, ৪৭টি সাপের ডিম উদ্ধার করা হয়।
পাখি শিকারে ব্যবহৃত ৫টি এয়ারগান, ২০০ কেজি কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়। একই সময়ে ২টি হরিণের চামড়া উদ্ধার হয়। বন্যপ্রাণী আইনে দায়ের করা হয় ১০টি মামলা। তাতে আসামী করা হয় ৭৪ জনকে। এছাড়া বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় হয়। এই দীর্ঘ সময়ে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষকে বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
জানা যায়, বন্যপ্রাণী অপরাধ কমিয়ে আনতে ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ উদঘাটনে (তথ্য প্রদানকারী) পুরস্কার প্রদাণ বিধিমালা জারি করেছে সরকার। আর্থিক পুরস্কার উৎসাহ বাড়িয়েছে তথ্য প্রদানকারীদের। অপরাধ নির্মূলে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি নতুন করে আশা দেখাচ্ছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এই বিধিমালা জারির পর এ পর্যন্ত ৩৯ জনকে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ৮ জন তথ্য প্রদাণকারী ৮৬ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছেন।
এদের মধ্যে ৬টি অভিযানে তথ্য দিয়ে একাই ৩৬ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছেন নাটোরের সিংড়া উপজেলার মাদারীপুরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করছেন তিনি।
সাইফুল ইসলাম বলেন, চলনবিল দেশীয়সহ বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির অন্যতম বিচরণক্ষেত্র। বিলের পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিকারীদের তৎপরতা বাড়ে। ফাঁদ পেতে শিকারীরা দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি শিকার করে নিয়ে যান।
চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তারা ২০১২ সাল থেকে কাজ শুরু করেন। গত কয়েক বছরে অর্ধশতাধিক পাখি শিকারীকে তারা পাকড়াও করেছেন। উদ্ধার করেছেন ছয় হাজারের বেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তথ্য প্রদানকারী হিসেবে এই অর্থ পুরস্কার তাদের এই কাজের স্বীকৃতি।
প্রায় ছয় বছর ধরে প্রাণ-প্রকৃতির ছবি তোলেন ঠাকুরগাঁও সদরের সালান্দর এলাকার বাসিন্দা রাব্বী আল আমীন। স্থানীয় একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী প্রকৃতি সুরক্ষায় কাজ করেন। সম্প্রতি এই যুবকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুরে দুটি অভিযান চালায় বন দপ্তর।
তাতে বিপুল সংখ্যক পাখি উদ্ধার হয়। গ্রেপ্তার হন পেশাদার দুই পাখি শিকারী। এই দুটি অভিযানের তথ্যদাতা হিসেবে ৬ হাজার টাকা করে মোট ১২ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন রাব্বী। এই অর্থ পুরস্কার তার কাজের গতি বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন রাব্বী।
৮ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন রাজশাহীর সেভ দি নেচার অ্যান্ড লাইফের সভাপতি মিজানুর রহমান। এই পরিবেশ কর্মীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজশাহীর দুর্গাপুরের এক অনলাইন পাখি বিক্রেতাকে আটক করা হয়। তার কাছে পাওয়া যায় বিপন্ন ও পরিযায়ীসহ দুই শতাধিক পাখি। ওই ঘটনায় পাখি বিক্রেতার সাজা হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতে।
শুধু পরিবেশকর্মীরাই নন, তথ্য প্রদাণকারী হিসেবে অর্থপুরস্কার পেয়েছেন রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের একটি হোটেলে ক্রেতা সেজে গিয়ে ১৫ কেজি ঘুঘুর মাংস উদ্ধার করেন তিনি। এই অভিযান চালিয়ে ৫ হাজার টাকা অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন এই বন কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিধিমালা অনুযায়ী, প্রধান বন সংরক্ষকের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলো থেকে কমিটির কাছে আর্থিক পুরস্কারের জন্য তালিকা আসে। সেটি পর্যালোচনা করে আর্থিক পুরস্কারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
অনেক সময় বনাঞ্চলের ভেতরে বন্যপ্রাণীসহ অপরাধীরা ধরা পড়েন। কখনো বা বনাঞ্চলের বাইরেও পাকড়াও হন। বিধিমালা অনুযায়ী, বনাঞ্চলের বাইরের চেয়ে ভেতরে অপরাধী ধরা পড়লে আর্থিক পুরস্কার ক্ষেত্র বিশেষে প্রায় দ্বিগুণ হয়।
জানা গেছে, বনাঞ্চলে বাঘসহ অপরাধী ধরা পড়লে তথ্য প্রদানকারী পাবেন ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া কুমির বা হাতি উদ্ধারে ৩০ হাজার টাকা এবং হরিণ উদ্ধারে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার পাবেন তথ্য প্রদাণকারী। তবে বনাঞ্চলের বাইরে গিয়ে ধরা পড়লে অর্থ পুরস্কার মিলবে এর অর্ধেক।
বনাঞ্চলে কচ্ছপ বা সাপসহ অপরাধী ধরা পড়লে তথ্য প্রদাণকারী পাবেন ১৫ হাজার টাকা। বনাঞ্চলের বাইরে এই উদ্ধার অভিযান হলে তথ্য প্রদানকারী পাবেন ১০ হাজার টাকা। এছাড়া বনাঞ্চলের ভেতরে পাখি বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী উদ্ধারে তথ্য প্রদানকারী ১০ হাজার টাকা পাবেন।
তবে বনাঞ্চলের বাইরে পাওয়া গেলে তথ্যপ্রদানকারী পাবেন ৮ হাজার টাকা। অনুসন্ধান চলাকালী, তথ্য উদঘাটনের সময় কিংবা প্রয়োজনে পরবর্তীতে তথ্য দাতার পরিচয়সহ তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখতে বলা হয়েছে এই বিধিমালায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত তথ্য প্রদাণকারী মৌখিক বা লিখিত তথ্য দেন। সেগুলো রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ থাকে। পরে সুপারিশসহ ওই তথ্য এ সংক্রান্ত কমিটিতে যায়। ৩০ দিনের মধ্যে কমিটি তথ্য প্রদানকারীকে আর্থিক পুরস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ওই সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়। সাত দিনের মধ্যে পুরস্কারের অর্থ হাতে পান তথ্য প্রদানকারী।
অনেক সময় তথ্য প্রদানকারী প্রাণ সংশয়ে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চান। সে ক্ষেত্রে একটি পরিচিতি সংখ্যা দিয়ে তথ্য প্রদানকারীকে শনাক্ত করা হয়। ওই পরিচিতি সংখ্যাটি ধরেই তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে বন দপ্তর। তবে আগে প্রকাশিত কিংবা বেনামি তথ্য দিলে আর্থিক পুরস্কার মিলবে না। পুরস্কার মিলবে না তথ্য প্রদানকারী নিজেই অপরাধে জড়িত থাকলে। আবার অন্য কোনো বৈধ কারণ থাকলে আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হবে না।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল জানান, এই বিধিমালা প্রণয়নের পর খুলনা অঞ্চলে ৫ জনকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আরও ৯ জনের নাম অর্থ পুরস্কারের জন্য কমিটিতে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। অর্থ পুরস্কার সাধারণ মানুষ তথ্য প্রদাণে এগিয়ে আসছেন।
সংস্থাটির হবিগঞ্জ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, তথ্য প্রদাণকারীদের আর্থিক পুরস্কার দেওয়ার পেছনে কারণ হলো-আমরা যাতে বেশি বেশি বন্যপ্রাণী অপরাধের তথ্য পাই। অপরাধীদের হাত থেকে বেশি বেশি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে পারি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, বিধি প্রণয়নের পর পরিবেশকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ তথ্য প্রদানে এগিয়ে আসছেন। এটি ইতিবাচক। এ নিয়ে প্রচার প্রচারণা চলছে। আশা করা যায় আগামীতে তথ্যপ্রদাণকারীদের তৎপরতা আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, বন্যপ্রাণী অপরাধীরা সংঘবদ্ধ এবং অনেক বেশি শক্তিশালী। এজন্য তথ্য প্রদাণকারীর পরিচয় গোপন রাখার বিধান রাখা হয়েছে এই বিধিমালায়। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরও তথ্যদাতারা সুরক্ষিত থাকেন।
এবিষয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট পরিচালক ছানাউল্যা পাটওয়ারী বলেন, আমাদের কোনো জরিপ নেই, ইনভেন্টরিও নেই। ফলে এই বিধি প্রণয়নের পর সাধারণ মানুষ কতটুকু তথ্য দানে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন-সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে দীর্ঘদিন ধরে যারা এই সংক্রান্ত কাজগুলো করে আসছেন, এই আর্থিক পুরস্কার তাদের কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১ হাজার ৬১৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৩১টি প্রাণী একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মহাবিপন্ন অবস্থায় ৫৬টি প্রাণী। সংরক্ষণ না করা গেলে এরাও একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ ছাড়া বিপন্ন তালিকায় রয়েছে ১৮১ প্রজাতি। ৯০টি প্রজাতি রয়েছে হুমকির কাছাকাছি। এই পরিস্থিতিতে বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় জনসচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছে বন দপ্তর।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্য বলছে, গত ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ১ হাজার ২৭১টি অভিযান চালিয়েছে তারা। এসব অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ১২ হাজার ৮৮১টি বন্যপ্রাণী। এই সময় ২৩ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়মিত মামলা হয়েছে ২৯টি। একইসঙ্গে বন্যপ্রাণী আইন ও বিধিমালা বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার জনকে।
ঢাকা বিজনেস/এম