১৯ মে ২০২৪, রবিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

বুলবুলি

এনাম আহমেদ || ০৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১২:০০ এএম
বুলবুলি


বুলবুলিদের জানালার সামনে ক’গজ দূরে একটা শান বাঁধানো পুকুরপাড়। যেখানে সকাল সকাল পাড়ার মহিলারা বসে ছাই দিয়ে বাসন মাজে। তখন শব্দ হয় ঘ্যাচর ঘ্যাচর। মাঝে মধ্যে পুকুরটায় হলুদ রঙের একটা সাপ দেখা যায়। যেটা মাথা উচু করে পানি নাচাতে নাচাতে পাক খায়। কখনও এদিকটায় আসেনা। একদিন বুলবুলি সাপ দেখে তার মাকে বলেছিল, মা দ্যাখ দ্যাখ, সাপ। বুলবুলির মা তখন হায় হায় হারামজাদি, সারলুতো বলে ওর মাথার চুল ধরে নিচু করে পিঠে ধপ ধপ করে ৫টা কিল বসিয়েছিল। সাপ দেখাতে গিয়ে বুলবুলি ওর মার হাতে থাকা ধোয়া থালাবাটি ফেলে দেয়ায় দন্ডটা তাকে পেতে হয়।

পুকুরের ওদিকটায় বিঘা বিঘা জমি। জমিগুলোতে সরষের আবাদ করলে জানালা থেকেই ওগুলো খেজুরপাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়। কিন্তু ওগুলোর গন্ধ ঠিকঠাক জানালা ভেদ করে ঘরে প্রবেশ করে। পুকুর ঘেঁষে বড় একটা কড়ই গাছ দাঁড়িয়ে আছে কবে থেকে তার ইয়ত্তা নেই কারো। কিন্তু ওর পাতাগুলো মাঝে মাঝে পুকুরে পড়ে পুকুরটাকে কেমন ভৌতিক করে তোলে। মজার ব্যাপার হলো, লোকে বলে ও গাছে নাকি পেত্নি থাকে। পেত্নির দাঁত বড় বড়, অনেকে চুল দেখেছে। কেউ বলে পেত্নির শরীরে কোন কাপড় থাকে না।

 এক সন্ধ্যায় প্রৌঢ় বৃদ্ধ গাছটার ধার ঘেঁষে পেশাব করতে বসে ‘চিৎকার করে বলে উঠেছিল, ওবাবারো হামাকে লিয়্যা গেলো রো’। তারপর ওখানেই চিৎপটাং। বুড়োর চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় একটা পেত্নি উলঙ্গ শরীরে গাছ বেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছিল!! শুনে অনেকে মজা করে বলেছিল, বুড়োর কপাল খুলেছিল, কিন্তু ব্যাটায় জ্ঞান হারিয়ে কপালটা নিজেই পুড়ালো! 

তারপর কি কাণ্ড! বাড়ি ফিরে বুড়ো’র মুখ দিয়ে অন্ন ঢোকে না। একমনে আকাশে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই বলে ওঠে ‘হামি দেখিছি, ওবাবারো’। বুড়োর কান্ড দেখে নাতবৌ নূরবানু দূর থেকে হাসে। বুড়োর সাথে মাঝে মাঝে বলে ওঠে ও দাদু কে আসিছিলো? দাদী নাকি? আপনেক পছন্দ করিছে নাকি? আপনে পছন্দ করেননি? বুড়ো পাল্টা জবাব দেয় ‘তুই মরবু রো তুই মরবু’ ও বাবারো, হামি দেকিছি। চুলগুলা কালো কুচকুচা।’ বুড়ো’র কথা শুনে নূরবানূ খিক খিক করে হেসে ওঠে। ‘বউ অত হাসিচ্চু ক্যা? কি হছে?’ আফসার আলীর কথা শুনে নূরবানু আরো হেসে গড়াগড়ি খায়। ‘ওমা আপনে জানেন না সাঁঝের বেলা কি কান্ডটা হছে। বুড়ো হাট থেকে ফিরার সময় কড়ি’র গাছের কাছে মুতপ্যা’র বচ্চিলো। তারপর গাছেত থেকে নাকি পেত্নি ন্যামা আচ্চে। পেত্নি’র গায়েত নাকি পেটিকুট বেলাউজ আছিলো না! বলেই নূরবানু আবার হেসে ওঠে। নাতবৌয়ের মশকরা সহ্য করতে না পেরে বুড়ো রাগে গরগর করে চলে যায়! যাওয়ার সময় বলে যায় ‘হামি দেকিছি, তোরাও দেখ।’ 

ভাবতে ভাবতে বুলবুলির ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়! গুলবানু বুলবুলির মাথায় হাত বুলাতে থাকে। বুলবুলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে এক সময় ঘুমিয়ে যায়!

পরদিন বুড়ো বাড়ির খোলায় বসে বিড়ি টানছিলো। বুলবুলি দৌড়াতে দৌড়াতে বুড়োর সামনে থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘দাদা মা’য় কলো ক্যাল আপনে নাকি পেত্নি দেখিছেন। পেত্নি দেখতে কেংকা? বুড়ো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিড়িতে আরেকটা টান দিয়ে ধক করে ধোয়া ছেড়ে বললো ‘ ধারি হছু এখনও দৌড়াস? কতা কস ন্যা তো, বাড়িত যা। তুর চাচি মুড়ি ভাজিছে খা যা’। বুলবুলি আবার জিজ্ঞেস করলো ‘দাদা কবেন না?’। বুড়ো এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো, ‘কঞ্চিটা কুটি গেলো’। বুলবুলি কঞ্চির কথা শুনে বাড়ি’র ভেতর দৌড়ে পালালো। 

বুলবুলির পা সবেমাত্র কৈশরে গড়িয়েছে। চুলগুলো পেছনে কাধ অবধি। সামনের চুল প্যাঁচ খেয়ে থুঁতনি পর্যন্ত গড়ায়। বুকে শবরী অঙ্কুরিত হচ্ছে মাত্র। ইংলিশ প্যান্ট পরে উদল গায়ে ক’দিন আগেও বুলবুলি এ পাড়া ওপাড়ায় বরই, জাম, আম গাছতলা চষে বেরিয়েছে। একদিন বুলবুলির মা গুলবানু ওর চুলের মুটি ধরে তাকে বলেছে ‘কিরে মাগি, তুক না কছি খালি গায়ে বাড়িত থ্যাকা আর বাড়াবুনা? কতা কানেত যায়নি?’ তারপর থেকে বুলবুলি বুকের কাছে ঝালট দেয়া ফ্রক পড়ে ঘুরে বেড়ায়।

একদিন পাড়া’র মেয়েদের সঙ্গে পুকুরে দাপাদাপি’র পর ভেজা গায়ে বাড়ি ফিরছিলো হঠাৎ বুলবুলি খেয়াল করলো ওর প্যান্ট বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ও দৌড়ে বাড়ি গিয়ে ওর মাকে বললো, ‘মা....আ, মা....রো, প্যান্টের ভেতর জুঁক ঢুকছে। জুঁক ছাড়ায়ে দে রো মা’ বলেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করলো। গুলবানু পুরনো শাড়ীর ন্যাকড়াসহ বুলবুলিকে টিউবওয়েল পাড়ে নিয়ে ওর রক্ত ধুয়ে বললো ‘জুঁক ব্যার করে দিছি। এই তেনা যেংকা করে লাগায়ে দিচ্চি, এংকা করে প্রত্যেকদিন প্যান্টের নিচে পড়বু। রক্ত দিয়ে বেশি ভিজে গ্যালে তেনা পাল্টাবু’। কয়দিন বাড়ি থেকে ব্যার হোস না মা’। বুলবুলি ততক্ষণে স্থির হয়ে গেছে। বললো ‘আচ্ছা’।

রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে বুলবুলি ওর মাকে বললো, ‘মা জুঁক হামার প্যাটের মধ্যে ঢুকচে। প্যাটের নিচে খালি লাগিচ্চে।’ বলে খুঁত খুঁত করতে লাগলো। বুলবুলির বাবা কাজেমউদ্দিন বললো, ক্যারে গুলবানু বুলবুলি’র কি হছে? হামাক তো কসনি? ওর কি অসুখ করছে? গুলবানু বললো, ‘আপনে ঘুমায়ে যান বুলবুলি’র বাপ। অর কিছু হয়নি।’ ‘তালে ঊই খুঁত খুঁত করিচ্চে ক্যা?’ ‘আপনে বুজপেন না। ঘুমায়ে যান। ক্যাল কমুনি।’

পরদিন বুলবুলি স্কুলে যাওয়ার জন্য সকালে তৈরি হলেও পেট ব্যথা আর হালকা জ্বরে যেতে পারলো না। ঘরের ভেতর বসে জানালা দিয়ে বাইরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। হলুদ রঙের সাপ দেখার জন্য। তখনও পাড়া’র মহিলাদের কেউ থালাবাটি মাজছিলো আবার কেউ কাপড় কাচতেছিল। একটা কালো ভ্রমর জানালার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে বুলবুলি’র চোখের সামনে উড়তে লাগলো। ‘ওই যা যা’ বলে বুলবুলি ভ্রমরটাকে তাড়িয়ে দিলো। হঠাৎ রূপালী জানালার কাছে এসে জোরে করে ‘হাউ’ বলে বুলবুলিকে চমকে দিয়ে পালিয়ে গেলো। বুলবুলি বললো ‘ওই থাম থাম’। রূপালী বললো ‘পরে আসমুনি, ওই পাড়া যামু, মৌঅল আমের গাছেত থ্যাকা মধু নামাবি, ওড্যা দেখমু। মৌঅল মধু চ্যাকপ্যার দিবি রো’। বাড়ির ভেতর থাকতে বুলবুলির আর ভালো লাগছে না। ওর বার বার মনে হলো কাল পুকুরে গোসল করতে গিয়েই ভুল করেছে। পেটের ভেতর জোঁক ঢুকেছে। বের হচ্ছে না! পেট ব্যাথা আর শরীর চিবানোয় বাড়ি থেকে বেরও হতে পারছে না। এভাবে কেটে গেলো আরো কয়েক দিন। বুলবুলি খেয়াল করলো ওর পেটে ব্যাথা নেই। রক্তও বের হচ্ছে না আর। ওর মা ওকে বলেছে ‘প্রত্যেক মাসেই তুর প্যাটের ভিতর জুঁক ঢুকপি। তখন তুই ওই তেনা পড়বু। শুনে বুলবুলি’র মন ভাড় হয়ে হয়েছে তখন। এরপর বার বার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে সেদিন পুকুরে গোসলে নামায়।

একদিন বিকাল বেলা বুলবুলি বাসায় ঢুকতেই অপরিচিত কয়েকজন মানুষকে দেখতে পেলো। বুলবুলি’র মা বললো ‘কুনটি গেছিলু? খুঁজে খুঁজে হয়রান। তুর জন্যে লোকজন বসে আছে’। ‘কে আচ্চে মা? মামা আচ্চে?’ ‘না বেগুনব্যাড়া থ্যাকা লোকজন আচ্চে, তাড়াতাড়ি রেডি হ’। তালহারা গ্রাম থেকে চার গ্রাম পরেই বেগুনবাড়িয়া। বুলবুলি কিছু বুঝতে পারলো না কেন তাকে রেডি হতে হবে। কেন লোকজন বসে আছে। সে বললো ‘কুটি যাবু মা?’ ‘হামি লয় খালি তুক লিয়্যা যাবি’ ‘হামাক একলাই কুটি লিয়্যা যাবি?’ ‘অ্যাজ লিয়া যাবি ন্যা, উন্ন দিন লিয়্যা যাবি, তুই তাড়াতাড়ি রেডি হ, চল’। গুলবানু বুলবুলিকে শাড়ী গহনা লিপস্টিক পড়িয়ে দিলো। লোকজনের সামনে নিয়ে যাওয়ার আগে মাথায় ঘোমটা টানিয়ে দিলো। আর বললো ‘মানসের সামনে যায়্যা বেশি কতা কবু না।’ 

গুলবানু বুলবুলিকে নিয়ে ঢুকতেই একজন বলে উঠলো ‘মিয়েটা তো ভালোই ডাঙ্গর হছে, কুন কেলাসে পড়িচ্চে?’ কাজেমউদ্দিন বললো ‘কেলাস সিক্সে পড়িচ্চে চাচা’। খুব ভালো যোগ বিয়োগ করব্যার পারে।’ পান চিবোতে চিবোতে আরেকজন বললো ‘রান্দিব্যার’ পারে? গুলবানু বললো ‘ঘরের সব কাম করব্যার পারে’। মাঝবয়সী একজন মহিলা বলে উঠলো ‘মিয়ে’র ঘুমটা তুলেন দেকি’। ‘এ মা মিয়ে’র চুলগুলো অত ছুটু ক্যা?’ ‘অল্প বয়েস বিআন সায়েবা, চুল বড় থুল্যাই হবি’। ‘দেকি মিয়েক এনা হাঁটান।’ ‘মিয়েক হামাকেরে পছন্দ হছে, বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেন তালে’ পান চিবানো লোকটি বললো। এতগুলো লোকজনের মধ্যে কিশোরী বুলবুলি নিজেকে অসহায় বোধ করছিলো। শাড়ি পড়ানোর সময় খুশি হলেও বিয়ে’র কথা শুনে তার বুকটা কেঁপে উঠলো। লোকজনের সামনে চেয়ারে বসে থাকা থেকে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। কাজেমউদ্দিন বললো ‘মিয়েটা খুব লজ্জা করে’।

রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে বুলবুলি বললো ‘মা হামি বিয়্যা করমু না, হামাক বিয়্যা দিস না। ওই পাড়া’র বিউটি খালার তো আখুনো বিয়্যা হয়নি। হামিও লেকাপড়া করে পরে বিয়্যা করমু?’ ‘ওই কতা মুখে আনিস ন্যা মা, বিউটি’র নামে গেরামের লোকজন কি কি কয় শুনিসনি? তুকো বারোভাতারি কবি। র‌্যাতের বেলা লোকজন জাংলা’র কাছে আসপি। বাড়িত ঢুকা’র চেষ্টা করবি। মা রো। ভালো ছেলে পাছি। ৭ বিঘা জমি আছে। বয়স না হয় অল্পেনা বেশি। বাড়ির ভাত খায়। মিয়ে মানুষ পরের ঘরেত যাওয়াই লাগবি। কান্দিস ন্যা মা।’ 

মায়ের কথা শুনে বুলবুলি ফোঁপাতে থাকে। বুলবুলির তালহারা গ্রাম। পুকুর পাড়। পেত্নি থাকা কড়ই গাছ। রূপালী, মনি, মল্লিকাদের ছেড়ে যেতে হবে। এদেরও বিয়ে হয়ে যাবে? মাকে বাবাকে আর প্রতিদিন দেখতে পাবে না। ছেড়ে যেতে হবে সবাইকে! ভাবতে ভাবতে বুলবুলির ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়! গুলবানু বুলবুলির মাথায় হাত বুলাতে থাকে। বুলবুলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে এক সময় ঘুমিয়ে যায়!




আরো পড়ুন