২২ ডিসেম্বর ২০২৪, রবিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

অনিকেত শামীমের সঙ্গে

মামুন রশীদ || ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ০৬:৩২ এএম
অনিকেত শামীমের সঙ্গে


ভূমিকার পরিবর্তে

পড়ার নেশা থেকেই পুরনো বইয়ের প্রতি আগ্রহ। ফুটপাত, পুরনো বইয়ের দোকান, ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে অনেক সময় কম দামে মেলে ভালো বই। এভাবেই যখন স্নাতক ক্লাসের ছাত্র, হঠাৎ হাতে আসে—‘মায়াবী টানে ডাকে মতিহার’। নাম দেখেই আগ্রহী হই—‘মায়াবী টানে ডাকে মতিহারে’র প্রতি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পড়ুয়াদের একটি সংকলন। স্মৃতিকথা, কবিতাসহ নানান বিষয়। সম্পাদনা করেছেন—শামীমুল হক শামীম। খুব বেছে বেছে বা খুঁজে খুঁজে শুধু প্রয়োজনের বই পড়ার মতো মন তখনও তৈরি হয়নি। হাতের কাছে যা পাই, তাই পড়ি। ভালো লাগলে বইটা শেষ হয়, আর ভালো না লাগলে—পাতা ওল্টেপাল্টে দেখে রেখে দেওয়া। এই সংকলনের সূত্র ধরেই পরিচয় শামীমুল হক শামীমের সঙ্গে। 

এরপর পেরিয়েছে অনেক সময়। নিজে লেখার চেষ্টা করি। সাহিত্যপত্রিকা, ম্যাগাজিন, ছোটকাগজের খোঁজ রাখার চেষ্টা করি। বইও পছন্দ করা শিখতে শুরু করেছি—নিজের মতো করে। তখন—হাতে এলো একটি কাগজ—‘লোক’। সুসম্পাদিত। প্রথম সংখ্যাতেই পেয়ে গেলাম—খুঁজে ফেরা বিষ্ণু বিশ্বাসের কয়েকটি কবিতা। কাগজটির প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হলো। কাগজের সম্পাদক হিসেবে নাম মুদ্রিত রয়েছে—অনিকেত শামীম। 

একসময় আনুষ্ঠানিক পড়ালেখার পাঠ শেষ হলো। রাজধানীতে এসে কাজের সুযোগ হলো অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজে, আন্তর্জাতিক ডেস্কে। কবি শামীম রেজা ফিচার বিভাগের সম্পাদক। তার স্নেহ জুড়ে থাকে ছায়ার মতো। মাঝে মাঝে সুযোগ হয় সাহিত্যপাতা সুবর্ণরেখা’য় লেখার। একদিন (সম্ভবত ২০০৬ সাল) সাহিত্য সম্পাদক জানালেন, ‘পরের সপ্তাহের পাতাটি হবে লিটলম্যাগাজিন সংখ্যা’। আমাকে আলোচনা করার জন্য দেওয়া হলো একটি ছোটকাগজ। নির্ধারিত সময়ে প্রকাশ পেলো আলোচনাটি। কাগজটির নাম—‘লোক’।

তারও অনেক পরে, নানা জায়গায় ঘুরে তখন কাজ করি দৈনিক জনকণ্ঠে। একদিন সুদীপ্ত সাঈদের ফোন। লোক’-এর কয়েকটি সংখ্যা নিয়ে একটি গদ্য লিখে দেবার অনুরোধ। যথাসময়ে অনুরোধ রাখতে পারায় লেখাটি আলোর মুখ দেখে—‘লোক’-এরই কোন একটি সংখ্যায়। 

এরও কয়েকবছর পর, (ততোদিনে পেরিয়ে গেছে প্রায় এক যুগ) পরীবাগে—এক আড্ডায় প্রথম দেখা ব্যক্তি অনিকেত শামীমের সঙ্গে। 

কবিতার ভূবনে

অনিকেত শামীমের কবিতা পাঠের সুযোগ হয় বিভিন্ন সাময়িকী, ছোট কাগজ এবং বইয়ে। নামটির সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘদিনের। সেই সূত্র তো বটেই, সঙ্গে লেখার আলাদা মেজাজও আগ্রহ ধরে রাখে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের কবি অনিকেত শামীমের কবিতায় স্মৃতিকাতরতার দিকটিই আমাকে বেশি টানে। ফেলে আসা সময় এবং জীবনের প্রতি তার যে বেদনাবোধ, তার প্রকাশে বরবারই তিনি মুগ্ধতার আবেশ ধরে রাখতে সক্ষম। তার ভাবনা, তার ইচ্ছেগুলো ডানা মেলে অতীতের পাখায় ভর দিয়ে। শব্দের মালায় তিনি নিজের স্বপ্নদেখা ভুবনের সঙ্গে চেতনাজগতের যে সেতু তৈরি করেন, তাতেও ঘিরে থাকে হƒদয়ের সূক্ষ্মতম অনুভতি। এটাই কবিতায় অনিকেত শামীমের নিজস্বতা। এই সারসত্তাকে সম্বল করেই তিনি পাঠককে টেনে নিতে থাকেন কবিতার গভীরে। তিনি ধারণা দিতে থাকেন বর্তমানের, যেখানে নিংড়ে দেয়া হয় অতীতের আর্তি—

‘আজও পাহাড় দেখার তীব্র বাসনার কথা মনে হলে
চুপিচুপি তোমাদের গ্রামে যাই। আজ হাটবার...
প্রচ­ ভিড় ঠেলে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ুতে থাকি
বড় রাস্তা থেকে আলপথ
আলপথ থেকে খেতের কোনাকুনি...

শস্য কাটা হয়ে গেলে পড়ে থাকে হাহাকার
বিরান মাঠে আমাদের প্রেমপর্ব
গোল্লাছুট             দাড়িয়াবান্ধা
দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে পড়ে থাকে শূন্যমাঠ...

সেই তালগাছ বরাবর হাঁটতে থাকি
যতই নিকটে যাই পাহাড় ততটা সরে সরে যায়
এভাবে কতটা সময় জমা হয় জীবনের খাতায়?
বরং হাটের ভিড়ে মিশে যাওয়া ভালো
হাট মানেই অনন্ত শৈশব, জাগ দেয়া পাটের গন্ধ...

উজান বাতাসে ধূসর নস্টালজিয়া
দূরে কোথাও বাঁশি থেমে গেছে
নিরন্তর প্রবহমান তার রেশ হঠাৎ হঠাৎ
থমকে দাঁড়ায় রাখালিয়া বোহেমিয়ান...

শৈশবের আরেক নাম হাহাকার, হারিয়ে যাওয়া প্রবেশপথ’
(দূরাগত পাহাড়ের সুর)

ব্যক্তি চিন্তার প্রকাশকে অনিকেত শামীম শব্দ প্রয়োগের কৌশলে করে তোলেন আকর্ষণীয়। ভাবনার প্রকাশের ক্ষেত্রে খুব অনাড়ম্বর, সাধাসিধে শব্দকেই তিনি বেছে নেন। অথচ সেই প্রকাশের মধ্য দিয়েই কবির চিন্তা এবং কল্পনার মধ্যে জেগে উঠতে থাকে নতুন বিশ্ব। যা মনোযোগী পাঠক তো বটেই অমনোযোগী পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। অনিকেত শামীমের কবিতায় উচ্চস্বর নেই, যেহেতু প্রকৃতি এবং মানুষের মনকেই তিনি প্রাধান্য দেন, তাই জীবনের সুড়ঙ্গ বেয়েই তিনি পাঠককে পৌঁছে দিতে চান অস্তিত্বের বেলাভূমিতে। তিনি জীবনকে আত্মস্থ করেছেন, জীবনের রসায়ন ঘিরেই তার কবিতা হয়ে ওঠে ধারাবাহিক অনুভূতির প্রকাশ। সেখানে দর্শন আছে, আছে প্রাণপ্রাচুর্য। আছে চিন্তার দুয়ার খোলার প্রয়াস— 

‘দীর্ঘ হতে হতে ক্রমশ ছোট হয়ে আসে 
দুটি ছায়া। আবারও দীর্ঘ হয়...
অনন্তকাল ধরে এই পথহাঁটা শেষ হয় না। 
আর কতদূর যাবো আমরা, কতদূর?’
(যুগল)

স্বদেশ-সংস্কৃতি সংলগ্ন বিষয়কে নিজের ভেতরে ধারণ করেই তিনি জীবনের উত্থান-পতনের নির্যাসকে ধরে রাখতে চেয়েছেন। ঐতিহ্যের প্রতি দাঁড়িয়ে থেকেই তিনি পাঠককে নানান ভুবনে ঘুরিয়ে আনেন। পাঠকের সংবেদনশীল মনে নিজের সুরকে বাজিয়ে তোলেন। জীবনের মোহন অভিঘাতকে তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার অভিলাষী। সেই অভিলাষ থেকেই অনিকেত শামীম তার কবিতাকে করে তোলেন মুক্তপাখির কল-কাকলী। অতীতের প্রতি তার যে আগ্রহ, ভালোবাসা তাকেও এক বৃত্তে আবদ্ধ না রেখে নতুনকে আহ্বান জানাতেও তাই দ্বিধা নেই।

‘শুরু হোক তবে নোতুন অধ্যায় 

সবকিছু ঝেড়েমুছে ফিটফাট 
প্রাক্তনের আজ বিদায়পর্ব 
আসবে নতুন 
প্রাক্তন এবং নোতুনের সম্মিলনী উৎসব

এইভাবে পরম্পরায়
সমূহজীবন 
উৎস থেকে ক্রান্তি 
ক্রান্তি থেকে পরিসমাপ্তির দিকে ক্রান্তিমান 

কীভাবে কবে শুরু হয়েছিল উন্মেষপর্ব? 
পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই 
যাও, শুধু যাও 
অগ্রসরমান...

অধরা তবুও হাতছানি দিয়ে ডাকে’
(জীবন পরম্পরা)

অনিকেত শামীম, একাকীত্ব এবং নিজের অনুভবের সংমিশ্রণে কবিতাকে এগিয়ে নেবার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি কবিতায় নিছক কুহকের জাল নির্মাণ করতে আগ্রহী হননি। বরং জীবনের যে গতিময় প্রবাহমানতা তাকে স্বীকার করে নিয়েই সৃষ্টির সিঁড়িতে পা রেখেছেন। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে জীবনের জয়গান, তার কবিতায় কল্লোলিত হয়েছে—মানুষের ভেতরের নিজস্বতা। যাকে ব্যক্তি মানুষ কখনোই বাতিল করে না, বরং খুঁজে ফেরে—নিজস্ব অনুভূতিমালার মধ্য দিয়ে। মানুষের সেইসব অনুভূতিমালার প্রকাশ আমরা দেখি কবিতায়। যেখানে প্রতিদিনের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের বাইরে আসার যেমন তাগিদ রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনাগত দিনের সন্ধান। 



আরো পড়ুন