টানা তিন চার দিন তীব্র ঝাঁজ ছড়িয়ে এবার পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। তারা বলছেন, সম্প্রতি ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পরপরই দেশের বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে জরিমানার পর আবারও দাম কমতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর একাধিক বাজার সরেজমিন ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।
খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতারা জানান, গত বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) একরাতেই চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত পেঁয়াজ কিনে রাখেন ভোক্তারা। ফলে বাজারে পেঁয়াজের সংকট দেখা দেয়। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে পরের দিন শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) থেকেই পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। প্রতিকেজি ৭০ টাকা থেকে শুরু করে ১১০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যায়।
রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে জানা গেছে, ক্রেতা না থাকায় পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। একসপ্তাহ আগেও যেখানে পেঁয়াজ কেনার জন্য ক্রেতারা হুমড়ি খেতেন, এখন সেখানে তেমন ভিড় জমে না।
পাবনার পেঁয়াজ গত দুই দিন আগেও ২৫০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন ২০০ টাকা থেকে ২১০ টাকায় প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে। তবে এক সপ্তাহ আগে এই পেঁয়াজ প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকায়। দুই দিন আগে আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা থেকে ২২০ টাকা। আর এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। তবে এক সপ্তাহ আগে এই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকায়। আগাম পেঁয়াজ ইতোমধ্যে বাজারে উঠেছে, যা প্রতিকেজি পাতাসহ ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর আগারগাঁও বাজার, তালতলার খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা সুমন বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত একেকজন ক্রেতা ১০ কেজি থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনে নিয়ে গেছেন। তখনো আমরা জানতাম না ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। আমরাও আগের দামেই অর্থাৎ ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। তবে শুক্রবার থেকে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের বিষয়টি জানতে পেরেছি।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যাবে। আর আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে মৌসুমি দেশি পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করবে। বর্তমানে কিছুটা পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। তবে ভারত থেকে ৫২ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খোলা আছে। এসব পেঁয়াজ দেশে আনতে অনেক চেষ্টা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে তারা এই পেঁয়াজের ছাড়পত্র দিতে ভারতকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রেতা রুবেল ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘পেঁয়াজ বিক্রি অনেক কমে গেছে। দুই দিন আগেও যেখানে প্রচুর ক্রেতা বাজারে দেখা যেতো। এখন সেখানে ক্রেতা অনেক কম। এক সপ্তাহ আগে ৭০০ টাকা থেকে সাড়ে ৭০০ টাকায় প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। এখন ৮০০ টাকা থেকে সাড়ে ৮০০ টাকায় প্রতি পাল্লা পেঁয়াজ বিক্রি করছি। মাঝে আরও বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘কোন চেইনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়ান, তা খুঁজে বের করতে হবে। এখন পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ রকম একটার পর একটা পণ্যের দাম হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন অজুহাতে তারা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেন। এই ব্যাপারে আমরা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছি।’
শামসুল আলম আরও বলেন, ‘আমাদের সংগঠনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আমরা কোথাও থেকে কোনো অর্থ পাই না সংগঠন পরিচালনার জন্য। তারপরও সংগঠনের স্বার্থে পণ্যের দাম ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখতে বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলি। মন্ত্রণালয়কে জানাই। যদিও এবার পেঁয়াজের দাম বাড়ায় এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়কে কোনো ধরনের প্রতিবাদমূলক চিঠি দেইনি। ব্যবসায়ীদের এভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই উচিত হয়নি।’
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এর মহাপরিচালক এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। এই সময়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজটি বাজারে না উঠলে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৩০০ টাকা বিক্রি করতেন ব্যবসায়ীরা। এই পেঁয়াজ আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আরো দাম কমে আসবে। কঠোরভাবে আমাদের অভিযানের কারণে পেঁয়াজের বাজারে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, তা কমতে শুরু করেছে।’
সফিকুজ্জামান বলেন, ‘গত তিন দিনে অভিযান পরিচালনা করে আমরা আনুমানিক ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছি। প্রায় ৫০০-এর মতো অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। মজুদ হওয়া পেঁয়াজ উদ্ধার করেছি। বাজারের স্বাভাবিক দামে সে-সব পেঁয়াজ আমরা বিক্রি করিয়েছি। বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলমান থাকবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার কামরুল ইসলাম ভূইয়া ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘বর্তমানে অমৌসুমি পেঁয়াজ বাজারে উঠছে। আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে নতুন মৌসুমি পেঁয়াজ উঠবে বাজারে।’
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর যুগ্ম পরিচালক ও তথ্যদাতা কর্মকর্তা মো. হুমাউন কবির ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে পেঁয়াজ স্বল্প মূল্যে বিক্রি করছি। বর্তমান সংকটেও নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে স্বল্প মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করা হবে। এই কার্যক্রম আমাদের আগামীতেও চলনাম থাকবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হায়দার আলী ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে তাতে কী হয়েছে? অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য আমাদের আগে থেকেই ব্যবসায়ীদের অনুমোদন দেওয়া আছে। বর্তমানে মৌসুমি পেঁয়াজের সরবরাহ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যে কারণে একটু ঘাটতি রয়েছে পেঁয়াজের। তবে এই ঘাটতি বেশিদিন থাকবে না।’
মো. হায়দার আলী বলেন, ‘ভারত থেকে যেসব পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে; সেগুলো আসলে ঘাটতি অনেকটা কমে যাবে। ভারত ছাড়াও চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মিশর, থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ৮/৯টি দেশ থেকে আমরা পেঁয়াজ আমদানি করে থাকি। তাই পেঁয়াজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আর আমাদের ব্যবসায়ীরা সামান্য সুযোগে যে অসৎ কাজটি করেছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না।’
/ঢাকা বিজনেস/এনই/