২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



ডে-কেয়ার সেন্টারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে

ইসরাত জাহান দিপা || ১৯ নভেম্বর, ২০২৩, ০৩:১১ পিএম
ডে-কেয়ার সেন্টারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে


ডে-কেয়ার সেন্টার যার বাংলা অর্থ হলো শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র। বর্তমান সময়ে পরিবারের কাছে শিশুদের জন্য  চাহিদার শীর্ষে যে সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এই শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র। সারাদেশে এই ডে-কেয়ার সেন্টার চালু ও সঠিক পরিচালনা যদি করা হয়, তবে নিঃসন্দেহে বলতে পারি আমাদের এই দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে বহুদূর।

যুগের বিবর্তনে আমাদের সমাজ এবং একইসঙ্গে পরিবারের চিত্র পরিবর্তিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েই স্ব স্ব যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। সময়ের চাহিদার সঙ্গে যৌথপরিবার ভেঙে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। আগের তুলনায় পেশাজীবী ও কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।  ফলে পারিবারিক জীবনে কর্মজীবী মা-বাবা যখন সন্তানের মুখ দেখেন তখন হাঁসির রেখার সঙ্গে সঙ্গে দিনে দিনে চিন্তার ভাঁজও এসে জমা হয় কপালে।আমাদের দেশে সরকারিভাবে প্রসূতি ছুটির মেয়াদ হলো ছয় মাস।আমরা জেনে অবাক হবো যে,নারী শ্রমিক যারা পোষাক শিল্প কিংবা বিভিন্ন কলকারখানাতে কাজ করেন এতদিন,তাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছিল মাত্র ৮ দিন।

গত ২ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল-২০২৩ পাস হয়েছে। যেখানে নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ৮ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে চাকরিতে যোগদানের পরই একজন নারী জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেন ও নানারকম সমস্যার সন্মুখীন হতে হয়।এক্ষেত্রে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাহায্য ও সহযোগিতা  না পেলে নারীকে চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হয়।সাধারনত দেখা যায় মা কিংবা শ্বাশুড়ি ভালোবেসে এই নাতি-নাতনির দায়িত্ব গুলো কাঁধে তুলে নেন।তবে এখনকার সময়ে অনেক নানী-দাদীরাও  চাকুরিজীবী নারী।আবার অনেক সময় পরিবারে বয়োজেষ্ঠ্য সদস্যের অবর্তমানে গৃহ কর্মে সাহায্যকারীর হাতে দুধের শিশুকে রেখে চলে যেতে হয় নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে।যার ফলে ঘটছে নানা দূর্ঘটনা ও নির্যাতনের চিত্র।আমাদের দেশে সন্তান পালনের দায়িত্ব কেবল মায়ের কাঁধেই চাপিয়ে দেয়া হয়। অথচ উন্নত দেশগুলোতে মায়ের মাতৃত্বকালীন ছুটির পর আবার বাবার পিতৃত্বকালীন ছুটির বিধানও রয়েছে।আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে পিতৃত্বকালীন ছুটি আমাদের দেশেও কার্যকর হবে এবং যা এখন সময়ের দাবি।

মা-বাবা কর্মস্থলে থাকার সময়টাতে ডে-কেয়ার সেন্টারগুলো শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে থাকে।সাধারণত একটা শিশু ছয় মাস থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে ডে-কেয়ারে বাস করে।একটি ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা খুব সহজ বিষয় নয়।এই সেবামূলক কাজ এবং ব্যবসায় দায়বদ্ধতা অনেক বেশি।শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন ও সনদ নিতে হয়। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আইনের অধীন নিবন্ধন সনদ নিয়ে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজ ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে।'শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র বিল-২০২১’ অনুযায়ী বলা হয়েছে, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থেকে শিশু হারিয়ে গেলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদাণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ লাখ পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে।এবং নিবন্ধন ছাড়া শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র চালালে দুই বছরের জেল ও দশ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।এছাড়াও বিলে বলা হয়েছে, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করলে বা তথ্য গোপন করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা হবে।শিশুদের সামগ্রিক মঙ্গল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, ডে-কেয়ার সেন্টারের কর্মীদের ঠিক সেভাবে শিশুদের যত্ন ও শিক্ষা প্রদানের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।এসব সেন্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য শিশুকে প্রস্তুত করার জন্য পড়তে, লিখতে ও অন্যান্য দক্ষতা বিকাশ করতে সহায়তা করে।শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

একটি ভালো ডে-কেয়ার সেন্টার বাবা-মাকে দেয় স্বস্তির নিশ্বাস।এতে করে তাঁরাও কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মনোযোগ ও আগ্রহের সঙ্গে তাঁদের অর্পিত দায়িত্ব পরিপালন করতে পারেন।কোনো পিছুটান কিংবা দুশ্চিন্তা নিয়ে কোন কাজেই সাফল্য লাভ করা যায় না।আমাদের দেশে অনেক নারীই সন্তান পরিপালনের জন্য সুব্যবস্থার অভাবে চাকুরি ছেড়ে দিতে কিংবা পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।ঢাকা শহর কেন্দ্রিক চিন্তার পাশাপাশি সমগ্র দেশে জেলা-উপজেলার ভিত্তিতে কঠোর তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে ডে-কেয়ার সেন্টারের সম্প্রসারন খুব জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।৪০ জনের বেশি নারী কর্মী রয়েছে এমন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের ব্যবহারের জন্য একটি উপযুক্ত কক্ষ দিতে হবে এটা বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ৯৪ (১.২) অনুসারে বলা আছে।অথচ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই এই আইন মানছে না।প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটি নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে এই ডে কেয়ার সেন্টারগুলো পরিচালিত হয়।বেসরকারি উদ্যোগে অনেক উন্নত ও আধুনিক যেমন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ, ডিজিটাল ও স্মার্ট  অডিও- ভিজ্যুয়াল সরঞ্জাম, লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, বয়স উপযোগী শিক্ষা সরঞ্জাম, ইনডোর ও আউটডোর কার্যক্রমের মতো সুবিধা রয়েছে।তবে এতে খরচের পরিমানও বেশি।মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের পরিবারের পক্ষে এসকল কেন্দ্রে শিশুদের ভর্তি এবং খরচ চালানো সম্ভব নয়। 

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর (ডিডব্লিউএ) সারা দেশে মোট ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালনা করছে। যেখানে ১০টি মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ও ৩৩টি নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য।নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মগবাজার, কল্যাণপুর,মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, রামপুরা, আজিমপুর, ফরিদাবাদ ও কামরাঙ্গীরচরে মোট ৮টি দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করছে ডিডব্লিউএ।সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ৬ মাস থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো মাত্র ১০০ টাকা মাসিক ফি হিসেবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।এবং মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর জন্য ৬টি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। যেগুলো ৫০০ টাকা ভর্তি ফি ও প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে নিয়ে থাকে।সবাই সরকারি এসকল ডে-কেয়ারের সেবা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পাষন করছেন।এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে।জেলা পর্যায়ে ৬০টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে সেখানে।

দেশের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারন বৃদ্ধি করতে হলে বাড়াতে হবে কর্মীর সংখ্যা ও কর্মঘন্টা।দেশের অনেক নারী কোলের শিশুকে কেবল নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার অভাবে কোনো কাজে নিয়োজিত হতে পারে না।যা দেশের জন্য বিরাট এক ক্ষতির কারন। দজনশক্তির পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের বিকল্প নেই।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা



আরো পড়ুন