২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার



নজরুলের গানে এ আর রহমানের বিকৃত সুর: ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড়

মুত্তাকিন আলম || ১১ নভেম্বর, ২০২৩, ১০:৪১ এএম
নজরুলের গানে এ আর রহমানের বিকৃত সুর: ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড়


মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি চলচ্চিত্র ‘পিপ্পা’ ব্যবহৃত নজরুলসংগীত ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ গানটিতে মূল সুর ভেঙে নতুন সুর দিয়েছেন ভারতীয় সংগীতজ্ঞ এ আর রহমান। তার দেওয়ার সুরটিকে গাণের বাণীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন সংগীতবিশেষজ্ঞ ও সংগীতপ্রেমীরা। তারা নিজ নিজ ফেসবুক টাইমলাইনে প্রতিবাদ জানিয়ে বলছেন,  এখানে সুরের বিকৃতি ঘটেছে। এর মাধ্যমে নজরুলকে হেয় করা হয়েছে। 

এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী সুজিত মোস্তফার ফেসবকু পোস্টটি বেশ গুরুত্ব বহন করছে। তিনি বলেছেন, ‘এ রকম একটা বিষয় ঘটুক, আমি কখনোই চাইনি। এটি নজরুলের নিজের সুর করা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গান। এই গানে এভাবে হাত দেওয়া মানে ক্রিয়েটরদের মরাল রাইটের আর কোনো অস্তিত্ব থাকলো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে নজরুলের গানে মাত্র দুটো জিনিস চেয়েছি। এক হচ্ছে, আদি রেকর্ড উদ্ধারের পূর্বে ভিন্ন সুরে তার বেশ কিছু গান জনপ্রিয় হয়ে গেছে, তার বিপুল সৃষ্টির তুলনায় এই সংখ্যাটা এমন কিছু বেশি নয়। নজরুল যেন টিকে থাকেন, এটলিস্ট তার কথাগুলো যেন টিকে থাকে এই গানগুলোর মাধ্যমে। তাই আদি সুরের পাশাপাশি এই সুরগুলোকে আমি সমর্থন দিয়েছি। আর নজরুল গায়কীর মধ্যে ইমপ্রোভাইজ করাটা সক্ষম শিল্পীদের জন্য যেন মুক্ত থাকে সেটাই কামনা করেছি। এইটুকুর জন্য আমাকে যেভাবে একপক্ষ বানিয়ে, দোষী বানিয়ে একটা দল সমানে ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে। এ. আর রহমানের ক্ষেত্রে এবার তারা কী পদক্ষেপ নেয়, সেটি আমি দেখতে চাচ্ছি। এ. আর রহমান এবং তার সঙ্গে যারা অংশ নিয়ে এই কাণ্ডটি করেছে তাদের আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’


বিশিষ্ট সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক বিধান রিবেরু লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহকপাট’ গানটি নিয়ে এ আর রহমান যা করেছেন, তাকে বলা যায় ‘খোদার উপর খোদকারী’। গানের স্বত্ব না থাকলেও এই গানের সুর, তাল, লয় পরিবর্তন করার ধৃষ্টতা রহমান দেখাতে পারেন না। কারণ নজরুল গানটি আদৌ ওভাবে তৈরিই করেননি। এটা রহমানের বিকৃতি। রহমান নিজেও তার গানের বিকৃতিকে মেনে নেবেন না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিকে অবলম্বন করে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। এটি শুনে বর্তমান প্রজন্ম রহমানের গানকে ভাববে নজরুলের সৃষ্টি! পুরনো প্রতিষ্ঠিত কাজকে নতুন করে উপস্থাপন করা অন্যায় নয়, তবে আত্মীকরণের নামে বিকৃত করা অপরাধ।’’

এই চলচ্চিত্র বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘‘আমার মতে, উল্লিখিত গানটির সফল প্রয়োগ হয়েছিল ১৯৭০ সালে,  জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে। গানের যে মর্মবাণী, তা সংগীতের ঝঙ্কারে ও গায়কীর অলঙ্কারে সেখানে যথাযথভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সেজন্য ওই ছবির সংগীত পরিচালক খান আতাউর রহমান ধন্যবাদার্হ। এ. রহমান যদি ওই রহমানের কাজ একটু দেখে নিতেন, তবে গানটির প্রতি তিনি এতোটা বে-রহম হতেন না বলে আমার বিশ্বাস।’’ 


‘সব জায়গায় মাতব্বরি করতে নেই’ মন্তব্য করে লন্ডনপ্রবাসী বিশিষ্ট কবি আবু মকসুদ লিখেছেন, ‘‘ভারতের বিখ্যাত সুরকার এ আর রহমান কবি নজরুলের বিখ্যাত গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙে ফেল করলে লোপাট’ রিমিক্স করেছে, তার এই রিমিক্স অত্যন্ত জঘন্য হয়েছে। এত বিখ্যাত একজন সুরকার; কিন্তু না বুঝলো গান, না বুঝলো সুর। সব জায়গায় মাতব্বরি করতে নেই এ আর রহমান নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘শিল্পীর স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই খাটো করতে চাই না। তবু যে-কোনো শিল্পীকে সুরের আগে গানের মর্মবাণী অনুধাবন করতে হবে; এর কোনো ব্যত্যয় হলে গান এবং সুর কোনো কিছুই মানুষের মর্মে পৌঁছাবে না।’

কবি ও ছোটকাগজ সম্পাদক আহমেদ শিপলু বলেন, ‘‘কাজী নজরুলের চোখজোড়ার পাশাপাশি গরাদের শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আনোয়ার হোসেনের চোখজোড়াও তীব্র স্ফুলিঙ্গের মতো বেরিয়ে এসে গলার রগ ফুলিয়ে এ আর রহমানকে বলছে, ‘কী করেছিস নালায়েক! বারুদের মধ্যে পানি ঢেলে দিলি!’’

কবি-গবেষক-সাংবাদিক মোহাম্মদ নূরুল হকের মতে, ‘সুরকে অবশ্যই বাণীর অনুগামী হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাণী যদি পূজার  হয়, তবে সুর দ্রোহের হলে সুরকারের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। আবার বাণী  বিপ্লব বা সংগ্রামের হলে সুর যদি হয় মিনমিনে, তাহলেও লোকে সুরকারকে দুষবে। মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানই বলে, সিংহ সংগ্রামে যেমন হুঙ্কার দেয়, শিকারির হাতে মৃত্যুতেও গগনবিদারি গর্জনই ছাড়ে। আর বিড়াল সর্বাবস্থায়ই মিউ মিউ করে। এক পশুর কাছে প্রকৃতি কখনোই আরেক পশুর ভাষা আশা করে না। অর্থাৎ প্রকৃতির রাজ্যের সর্বত্রই নিয়মের শাসন। ব্যতিক্রম অন্যায় হিসেবেই বিবেচ্য।’

এই সাংবাদিক বলেন, ‘‘নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির সুরের বিকৃতি ঘটিয়ে বিশ্বনন্দিত সুরকার এ আর রহমান সেই অমার্জনীয় অপরাধই করেছেন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সুরের বিকৃতি, কপি রাইটের লঙ্ঘন ফৌজদারি অপরাধ। তাকে সমর্থন করা আরও বড় অপরাধ। সবচেয়ে বড়কথা বিপ্লবের গানে প্যানপ্যানে সুর কেবল জঘন্যই নয়, ঘৃণ্যও। এই কারার লৌহ কপাট ভাঙার আহ্বান নেই। আছে বিড়ালের ভয়ে ইঁদুরের গর্তে ঢোকার করুণ চিঁহি-চিঁহি আর্তনাদ। আর তার সুরে যারা কণ্ঠ দিয়েছেন, তারা সমদোষে দোষী। এই হেন জঘন্য কর্মের সমর্থন যারা করছেন, তারা আরও বড় অপরাধী। কারণটা রবীন্দ্রনাথ বহু আগে বলে গেছেন। তাঁর মতে, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ রবীন্দ্রবাণী শিরোধার্য মেনে নজরুলে গানের বিকৃতির সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক অপরাধীর জন্য তীব্র ঘৃণা। তাদের ঘৃণ্য কর্মকে যারা সমর্থন করছে, তাদের জন্য ধিক্কার।’’

সাহিত্যিক-সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন,  ‘‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি শুনলাম। মানে এ আর রহমানের সুর করাটা। আপনাদের জানিয়ে রাখলাম। পরে আবার বলতে পারবেন না যে, আমি কোনো খোঁজ-খবর রাখি না। তবে গানটি কেমন লেগেছে? এমন প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না। আপনার কাছে যা ভালো লাগে, আমার কাছে তা না-ও লাগতে পারে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। দেশে ব্রি-টি-শ শাসন থাকলে তারাও এই গান শুনে ঘুমিয়ে পড়তেন। সেটাও এক ধরনের কৃতিত্ব। যাই হোক, যারা এখনো শোনেননি। শুনে আসতে পারেন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এ আর রাহমানের সুরে ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ আবারও শুনলাম। আমাদের দেশের উৎসবের গানের মতো মনে হলো। ধান কাটার গান, গ্রামীণ খেলাধুলার গান বা নৌকাবাইচের গানের মতো। বিপ্লব বা বিদ্রোহের গানের মতো হয়নি। নিঃসন্দেহে তিনি গুণীজন। তবে বাংলা শব্দের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের কায়দা হয়তো ধরতে পারেননি।’’

ভারতীয় সংগীতকার রাঘব চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘‘জনাব এ.আর. রহমান, ভারতের সবচেয়ে প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক। পিপ্পা ফিল্ম থেকে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ নামে একটি গানে সুর করেছেন। একজন বাঙালি হিসেবে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের সুরেই গানটি শুনে বড় হয়েছি।  আমি এই গানের বিকৃতি একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে মোটেও মেনে নিতে পারছি না।’ 

মডেল ও নৃত্যশিল্পী মৌলি মাইতি লিখেছেন, ‘‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’ গানটির মধ্যে যে লৌহ, যা স্বাধীনতার যুগে বিপ্লবীদের রক্তে আগুন ও ব্রিটিশ শাসকদের মনে ভয় ধরিয়েছিল, তা এআর রহমানের ভার্সনে পুরোপুরি মিসিং। স্বাধীনতার অগ্নিযুগের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা এই বিপ্লবী গানের সুর, মূল ভাব, গানটি শুনে গায়ে কাঁটা ধরানো ইমোশন- সবটাই লোপাট! অত্যন্ত জঘন্য কম্পোজিশন এটা।’’

সাংবাদিক সালেয়া নীলসুরি লিখেছেন, ‘সময়ের একটা শ্রেষ্ঠ থাকে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব। সেই শ্রেষ্ঠত্বের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব করা শ্রেষ্ঠত্ব হয় না, কখনো কখনো ধিক্কারও আনে। নজরুল-রবীন্দ্র আমাদের রক্ত, আমাদের মগজ, আমাদের হৃদয়। এটাকে নিয়ে ছ্যাড়াব্যাড়া করবেন কেন? ঐ শাহ্ আব্দুল করিম, লালনকেও বুকের ভেতরটায় আমরা ধারণ করি। এর স্বকীয়তায়, নিজস্বে হাত দিয়েন না কেউ। নিজের মুরোদ থাকলে নিজে সৃষ্টি করুন। নিজে জন্ম দিন। সেই গান ভালো হলে মানুষ এমনিতেই শুনবে। অন্যের গানে হাত দেন কেন? আমার কাছে আপনাদের এসব ফিউশন কুৎসিত লাগে। একটা মামলা করা হোক।’

কবি আহমেদ কাওসার লিখেছেন, ‘ভারতীয় পিপ্পা সিনেমায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগীতের সুর পাল্টে  দিলো এ আর রহমান। ছেলেবেলা থেকে যে গানের সুর শুনে শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় প্রতিবাদের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠতো, যে সুর প্রতিটি মজলুমকে নতুন করে বাঁচার শক্তি যোগাতো, সে সংগীতকে খুবই করুণভাবে অবমাননা করেছে ভারতীয় পিপ্পা সিনেমা এবং এ আর রহমান। নজরুল সংগীত আবমানমা করায় এ আর রহমানের প্রতি তীব্র নিন্দাসহ তার যথাযোগ্য শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। যেন ভবিষ্যতে আর কেউ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত বিকৃত করার সাহস না করে।’

সাংবাদিক এসএম রায়হান বলেন, ‘‘কী দরকার বাংলা গান বানানোর, এ আর রহমান? ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটার মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে। শুনলে মনে হয় যুদ্ধে যাই। এ আর রহমানের কম্পোজিশন শুনে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়ি। বিদেশি শিল্পী হলেই আমাদের আহ্লাদ হয়,আবেগ বেড়ে যায়। এই আর রহমান গানটার ভাইভই বুঝতে পারেননি।’

ঢাকা বিজনেস/এমএ/



আরো পড়ুন