১৮ মে ২০২৪, শনিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

আমিনুল ইসলামের কবিতা: নিজের সঙ্গে কথোপকথন

মোহাম্মদ নূরুল হক || ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ০৫:৩০ এএম
আমিনুল ইসলামের কবিতা: নিজের সঙ্গে কথোপকথন


যা-কিছু মানবজীবনকে আলোড়িত করে; সময়ের বিপুল অপচয় ও গ্লানিবোধ থেকে স্বস্তিদায়ক দূরত্বে সসম্ভ্রমে দাঁড়াতে প্রাণিত করে, এর মধ্যে কবিতার একটি আবেগ আপ্লুত-সম্ভ্রান্ত অবস্থান রয়েছে। আর এজন্য কবির কাজ মানুষের যাপিতজীবনের শৈল্পিক রূপায়ণ স্পষ্ট করা। সেখানে প্রতিদিনের উচ্চারিত শব্দসমবায় বহুলব্যবহারে ক্লিশে হয়ে আসার পরেও কবিতার পঙ্ক্তিতে প্রতিস্থাপিত হয়ে ওঠে। কবি সাধারণ বস্তুকে কেবল রঙের প্রক্ষেপণেই বাঙ্ময় করে তোলেন। আমিনুল ইসলাম সেই জাতের কবি, যারা শব্দকে ব্রহ্ম জ্ঞান করেন; আবার চিত্রকল্প-উপমাকে সে ব্রহ্মের রূপৈশ্বর্য জানেন। 

আমিনুল ইসলামের প্রথম কবিতাগ্রহন্থ ‘তন্ত্র থেকে দূরে’। এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, প্রথম কাব্যে তার নবিশি দৌর্বল্য স্পষ্ট। পৃথিবীর প্রায় সব কবির প্রথম দিককার কাব্যে নবিশি দৌর্বল্য অহঙ্কারের তিলক হয়েই থাকে। কারণ প্রথম কাব্যের সঙ্গে যতটা থরথর আবেগ জড়িয়ে থাকে, ততটা প্রজ্ঞার সংশ্লেষ থাকে না। তাই সেখানে দৌর্বল্যই প্রাধান্য পায়। ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ কাব্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই কাব্যটি শুরু হয়েছে ‘অক্ষম উচ্চারণ’ কবিতা দিয়ে। এটি লিরিক-প্রধান কবিতা। পয়ারের সুরকে এখানে কৌশলে প্রয়োগ করা হয়েছে। ‘লোভের কাতারে দ্যাখো ঝোলে ক্যামন বীরের তকমা/ অগ্রজের বুকের ছাপ মুছে যায় কৃতঘ্ন দলনে/ আমের বাগানে শুধু বেড়ে যায় বিপরীত উপমা/ সূর্যের খুনসুটি হায়! সমাসীন আঁধার চরণে...’ পঙ্‌ক্তিগুলোয় মানুষের নীচতা-দীনতার স্বরূপ প্রকাশিত। 

এ কাব্যের সবচেয়ে সৌকর্যপূর্ণ ছন্দবদ্ধ কবিতার নাম নিঃসন্দেহে ‘পর্ণমোচী’। এই কবিতায় কবি প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতির ছদ্মাবরণে মানব চরিত্রের বিশেষ দিক উম্নোচনের কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন। কবি বলছেন, বৃষ্টি শেষ হয়েছে অনেক আগে। শীতের অনুভূতিও এখন শেষ। মুগ্ধ ও স্বার্থপর পা ঝরাপাতাকে দলে গেছে। সেখানে অনাত্মীয় বীজ সতর্ক জনপদের চোখে ধাঁধা সৃষ্টি করে। সেখানে অপসংস্কৃতির উদ্ভিদ জেগে ওঠে। আমদানি করা মতবাদ ও তত্ত্ব বাঙালির মননশীলতাকে বিব্রত করেছে মাত্র। বাঙালির মননে কোনো নিশ্চিত সুখ ও আনন্দের সংবাদ এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কেবল বাঙালিকে ইউরোপমনস্ক কবি ও তত্ত্বের আমদানিকারকেরা বিভ্রান্ত করেছেন, কোনো আনন্দ কিংবা সুখভোগের প্রয়োজনীয় শৈল্পিক রসদের সন্ধান দিতে পারেননি। 

আমাদের ঝরা অদ্ভুত এক শীতে
শত বসন্তে রয়েছি অপুষ্পিত
পোকায় ধরেছে বোধিবৃক্ষের ভিত
বনসাই মন কুহূতানবিরহিত।
(পর্ণমোচী : তন্ত্র থেকে দূরে)

‘সোনালি কাবিন’ কবিতায় আল মাহমুদ যেমন ‘মগজ বিকিয়ে দেওয়া পণ্ডিতসমাজ’ দেখে মনোক্ষুণ্ন হয়েছেন, তেমনি আমিনুল ইসলামও বলছেন, ‘পোকায় ধরেছে বোধিবৃক্ষের ভিত/ বনসাই মন কুহূতানবিরহিত’। অগ্রজের মতো এই কবিও বোধিবৃক্ষের ভিতে পোকাধরা পণ্ডিতসমাজকে অভিসম্পাত দেওয়ার কাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন। কারণ, আল মাহমুদের পণ্ডিতসমাজে ‘সর্বকারুকাজে অস্তিবাদী জিরাফেরা’ ব্যক্তিগত গলা বাড়িয়ে থাকে। আর আমিনুল ইসলামের বোধিবৃক্ষরা এখন বনসাই হয়ে গেছে। ফলে তাদের কানে আর কোনোভাবেই কুহুতান পৌঁছায় না। সমকালীন সমাজবাস্তবতার এমন প্রকাশ অভিনব। একইসঙ্গে তার নিজস্ব উপলব্ধির মূর্তরূপও। এটি বিশ পঙ্ক্তির একটি লিরিকধর্মী কবিতা। ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তে রচিত। ‘গোড়ায় জড়িয়ে দাঁতাল শীতল ফণা’ পঙ্ক্তিতে মানুষের বিবেকের একটি বিশেষ বন্ধ্যাত্বের স্বরূপ অঙ্কিত হয়েছে। এই বক্রোক্তির ব্যঞ্জনা কবিতাকে বিশেষ মহিমা দিয়েছে। কবিতাটি তিনি শেষ করেছেন এভাবে,

বলাকা বৃথাই ছড়ায় আমন্ত্রণ
নির্বীজ সাঁঝেও ধরিত্রী ঋতুমতী
নষ্ট আঁধার বাড়ায় আলিঙ্গন
উৎসব আড়ালে ঝরছে পর্ণমোচী। 

যেখানে সম্ভাবনার সব দুয়ার রুদ্ধ হয়ে যায়, সেখানে আনন্দ আর সুখের আমন্ত্রণ জানানো বৃথাই। ঋতুমতী, শব্দের সঙ্গে পর্ণমোচী শব্দের মিল চোখে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও কানে ধ্বনিসাম্য ঠিকই ধরা পড়ে। 

‘মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম’ তার দ্বিতীয় কাব্য। এই কাব্য পূর্ববর্তী কাব্য ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ কাব্যের সম্প্রসারিত রূপ মাত্র। তবে এ কাব্যের একদিন প্রতিবেশী জলে কবিতায় কবির নবিশি দৌর্বল্য কাটিয়ে ওঠার পরিচর্যা স্পষ্ট। তবে কবিতার প্রথম পাঁচ স্তবকে তার বক্তব্য পরিপূর্ণতা পেয়েছে। পরবর্তী স্তবকের অন্তর্ভুক্তিতে কবিতাটির রসহানি ঘটেছে বলে মনে করি। কবিতাটির প্রথম স্তবক উদ্ধার করা যাক,

আকাশজোড়া মেঘ ছিল কি?
ছিল বুঝি! তখন নয়কো রাত
তুমি ছিলে! আর কে ছিল?
গুনগুনানী। কলিংবেলে হাত। 

কবি স্বগতস্বরে প্রশ্ন করছেন, ‘আকাশে মেঘ ছিল’ কি না। আবার নিজেই অবাক হচ্ছেন, মেঘের অস্তিত্ব বিষয়ে, না কি নিজের সংশয়ীচিত্তের কারণে, তা এখানে স্পষ্ট নয়। অনুমান করা যায়, তখন ঝড়ের রাত ছিল। ওই সময় কেউ একজন কলিংবেলে চাপ দিয়েছিল এবং কণ্ঠে ছিল সুরের মোহ। এই ঝড়ো রাতে দুজন মানবমানবী আবেগের তোড়ে নদীতে ভেসে গেছে। অথচ বোকা মাঝি যাত্রীর মন ও শরীরের খবর নেয়নি। এ সময়ের বর্ণনা,

এই তো আমি বেঁধে এলাম
আমার নৌকা—দুলছে গলুই তার
নোঙর বাঁধা! জমলো তবে
এই সুযোগে সিন্ধু অভিসার।

এর পরের অংশে তসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গ টেনে এনে কবিতাটির চিরকালীন ব্যঞ্জনা ক্ষুণ্ন করেছেন কবি। এছাড়া, মাত্রাপতনের মতো ভুলও আছে এই অংশে। এই অংশটুকু উদ্ধার করা যাক: 

আমি এখন পঁচিশোর্ধ্ব
আর তুমি? আমি তিরিশ পার
ভয় কি তবে নতুন গাঙে!
বৈঠা বাঁধা সুঠাম দুটি দাড়!

ফুঁসছে হাওয়া—শোনো মাঝি!
গাঙে বাজে তসলিমার ওই ডাক।
বঙ্গনারী খোঁটায় বাঁধা
আজ তবে এই নিন্দা ঘুঁচে যাক।
কথায় কথায় ঢেউ যেন সব
নিচে নদী অথই জলের বান
ডুবে গেছি! গামছা কোথায়!
চরে ঠেকা—তখন ভাটার টান।

‘আমি এখন পঁচিশোর্ধ/ আর তুমি? আমি তিরিশ পার।’ পঙ্ক্তি দুটির প্রথম পঙ্ক্তিতে মাত্র দু-পর্ব। অথচ প্রত্যেক পঙ্ক্তিতে স্বরবৃত্তের  চারমাত্রিক দু-পর্ব এবং শেষে একটি অপূর্ণ পর্ব রয়েছে। এ পঙ্ক্তিতে শেষ এবং অপূর্ণ পর্বের অনুপস্থিতি পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলে।  দ্বিতীয় পঙ্ক্তির প্রথম পর্বের ‘আর তুমি’ পর্বে একমাত্রা কম পড়ার কারণে শ্রুতিকটু লাগে। তদুপরি ‘গাঙে বাজে তসলিমার ওই ডাক’ পঙ্ক্তি সমকালীন বিশেষ কোনো নারীকণ্ঠের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইশারাকে বোঝানো হয়; যা কোনোভাবেই আবহমান নারীকণ্ঠের মানবিক আহ্বানকে স্পষ্ট করে না। আবার ‘আজ তবে এই নিন্দা ঘুঁচে যাক’ পঙ্ক্তিতে রাবীন্দ্রিক স্বর বেজে ওঠে, যা আধুনিক মানসকে ধারণ করতে ব্যর্থ। বরং সেখানে রোমান্টিক মানস স্পষ্ট হয়। 

এ গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ শিল্পীমনের কোনো বিশেষ মুহূর্তের চেতনাগত উদ্ভাস কিংবা তীব্র ভাবাবেগে ভেসে যাওয়ার এক পবিত্রতম বর্ণনার শব্দগত বয়ন। নবিশি দৌর্বল্য কাটিয়ে ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’য় স্বতন্ত্র কণ্ঠ নির্মাণের দিকে নিজেকে নিরন্তর ক্রিয়াশীল রেখেছেন আমিনুল ইসলাম।  

‘মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম’ কবিতায় মহানন্দা নদীর ফেরারি যৌবনের কালখণ্ডের কথা স্মরণ করে কবিমনের অভিব্যক্তি প্রগাঢ়ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এ কবিতায় আমিনুল ইসলাম মূলত মহানন্দা নদীর তীরবর্তী জনপদ বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচারের দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের বহু স্পর্শকাতর বিষয়কে তুলে এনেছেন শব্দ ও অলঙ্কারের আশ্রয়ে। তিনি বলতে চেয়েছেন, বখতিয়ার খিলজির আগমনে এ দেশের ব্রাত্যশ্রেণীর মানুষ শ্রেণী-বিভেদ ভুলে বখতিয়ার খিলজির আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। অবশ্যই সে ক্ষেত্রে বখতিয়ার খিলজির প্রচারিত সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্মানুভূতির সংযোগও ক্রিয়াশীল ছিল। তা ছিল বরেন্দ্র অঞ্চলসহ সমগ্র বাংলার সাধারণ মানুষের মনেও। এই কবিতার শুরুটা কিছুটা নাটকীয় ও গাম্ভীর্যপূর্ণ। 

মহানন্দা নদীবিধৌত পলল-বাহিত জনপদে মানুষের প্রাণের হিল্লোল আর মননের প্রাখর্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় যখন, তখনই কবিমনের গহনে সৃষ্টি হয় আত্মক্ষরণ ও আত্ম-উন্মোচনের যন্ত্রণা, যা থেকে মুক্তি আপাতত তার মেলে না। মেলে কেবল তখন, যখন নিজেকে সংবেদনশীলতার সব অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করার নীচতায় বিমূঢ় সত্তায় পর্যবসিত হতে পারে। কিন্তু একজন সৎ কবির পক্ষে শেকড় বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। 

‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ কাব্যের ‘একদিন’ আহ্বান ও সাড়া দেওয়ার শ্রুতিমধুর সংবেদী ভাষাচিত্র অঙ্কনের স্বাক্ষর রয়েছে। আধুনিক বাংলা কবিতার বাঁকের ভেতর জেগে ওঠা চর-চড়া-পার-পাড় ভাঙার ছলাৎ-ছলাৎ শব্দকে এই কবি করেছেন কবিতার সহজ রসদ। একই সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের একান্ত উপলব্ধিজাত ধারণাকেও আমিনুল ইসলাম আন্তরিক ও নিবিড় পরিচর্যায় তুলে ধরেছেন। এ কাব্যে তিনি নদী, বৃক্ষ, নারী, দিঘি, বৃষ্টি ও শস্যের পক্ষে সৎ থেকেছেন। নির্মাণ করেছেন প্রকৃতিবর্তী চিত্রকল্প। ‘নদীর গল্প’, ‘নদী ও খালের গল্প’ ও ‘নদী’ সিরিজের কবিতাগুলোয় কবি ব্যক্তি মানুষের নৈঃসঙ্গ্যরূপ, মনোবৈকল্য, শৈশব ও কৈশোরের পটভূমি ফুটিয়ে তুলেছেন।  

‘বৃক্ষ’ সিরিজে মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ধরন ও আত্মিক সম্পর্কের ধারণা এঁকেছেন। ব্যক্তির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যাতনা এবং মনোকষ্টের চিরন্তন রূপ আঁকার প্রতি কবিরা চিরকালই দ্বিধাহীন-আন্তরিক। মানুষের সততা ও চাতুর্যকে শিল্পের তুলিতে অঙ্কন করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য কবি কতটা আন্তরিক; তার প্রমাণ মেলে ‘ভালোবাসায় ফিরে আসা’, ‘বৃষ্টির বন্ধুত্ব’, ‘তৃতীয় বিশ্ব’, ‘পাহাড় বাসনা’, ‘তোমার ঘরে না’, ‘বাধ্যবাধকতা’, ‘হয়তো সে কোন বিবিধ ব্যর্থতা’ ও ‘মিউজিয়াম’ শীর্ষক কবিতায়। এ কাব্যের স্বরবৃত্তে রচিত একমাত্র কবিতা ‘জরিপ’। চিত্রকল্প, উপমা, অনুপ্রাস ও ছন্দের এক অনুপম অন্বয় রক্ষা করেছেন, তাতে কবিতাটি লিরিকধর্মিতার কারণে শ্রুতিমধুর হওয়ার পথে সহায়ক হয়ে ওঠে। জীবনবোধও প্রস্ফুটিত হয়েছে বুননগুণেই। 

ব্যক্তি মানুষের রুচিবোধ, মানবিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, চিন্তার বৈপরীত্য, চেতনার বিরোধ—এসব প্রপঞ্চকে উপজীব্য করে কবিতার পঙ্ক্তি বয়নে সার্থকতা কেউ কেউ অর্জন করতে পারেন। সেই কেউ কেউয়ের দলে আলোচ্য কবিকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে পারি পাঠক হিসেবে আমরা। সমাজের-রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তাকেই মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়। গ্রামবাংলার অশিক্ষিত মানুষের ভেতর ধর্মান্ধতার যে বিষবৃক্ষ, তার বিরুদ্ধে কাব্যিক প্রতিবাদ ‘রাই সরিষার কাব্য’। এ গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ শিল্পীমনের কোনো বিশেষ মুহূর্তের চেতনাগত উদ্ভাস কিংবা তীব্র ভাবাবেগে ভেসে যাওয়ার এক পবিত্রতম বর্ণনার শব্দগত বয়ন। নবিশি দৌর্বল্য কাটিয়ে ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’য় স্বতন্ত্র কণ্ঠ নির্মাণের দিকে নিজেকে নিরন্তর ক্রিয়াশীল রেখেছেন আমিনুল ইসলাম।  

তার কবিতার সৌন্দর্যে অবগাহনের যে নান্দনিক ইঙ্গিত তিনি মনোযোগী পাঠককে দেন, তাতে পাঠক কেবল চমকে ওঠে না, সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ চিন্তা করার এবং আপনমনে ভাবনার জগতে বিচরণ করার জন্যও অনেকটা প্রণোদিত হয়। ‘পাঠশালা’, ‘স্রোত ও ঢেউ সিরিজ’-এর কবিতাগুলো, ‘মাছিতন্ত্র’, ‘সখিনার গল্প’, ‘দিশা’, ‘আমার আউশে দাও বাতাসের দোলা’, ‘নির্দলীয় ভালোবাসা’, ‘তুমি হলে সন্ধ্যাবতী সকলি কবুল’ কবিতায় ফুটে উঠেছে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক ও সম্পর্কের টানাপড়েন।  

‘নীড় বিষয়ক’, ‘কল্পচিত্র’, ‘হায় বসন্ত’ কবিতায় কবি প্রথাগত ধারণা ও চিত্রকল্পকে সম্মানের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ করে তুলে ধরতে গিয়ে কবিতাকে এতই সহজ ও সাবলীল করে প্রকাশ করেছেন যে, এ কবিতাগুলো পাঠকের নিকট নিবিড় মনোযোগ দাবি করার আগেই ম্লান হয়ে উঠেছে। কিন্তু ‘এলোমেলো হাওয়ায়’ কবিতায় তিনি শব্দকে অভিজ্ঞতার স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সঙ্গে পরাবাস্তববাদী চেতনার সম্মিলন ঘটিয়েছেন। 

তার চিত্রকল্প নির্মাণে নতুনত্ব আছে; স্বকীয়তা আছে তার প্রয়োগেও। উপমাকে নিজস্ব সম্পদে পরিণত করার চেষ্টা তিনি করেন না, সম্ভবত যুগের প্রভাবে। যুগের প্রভাবে কবি প্রভাবিত হন ততটুকু, যতটুকু আত্মস্থ হতে সময় লাগে। আমিনুল ইসলাম নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেন। তিনি কবিতায় কোনো আদর্শের প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তার কবিতায় নিভৃতচারিতা ও মৌনতা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। 

কবি সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব বলেই রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধেও তর্জনী তুলে ধরেন। কবিমাত্রই যৌক্তিক স্বপ্নচারী। স্বপ্নেই তার স্বস্তি ও আস্থা। স্বপ্নহীন পৃথিবী কবিকে শ্বাসরুদ্ধ করে তোলে। ফলে কবি ক্রমাগত স্বপ্ন রচনা করে যেতে থাকেন, সে স্বপ্নের গহনে কে অবগাহন করলো আর কে ডুবে মরলো, সে হিসাব তার রাখার কথা নয়। ‘অন্ধকারের অধিক যে রাত’ কবিতায় চিত্রকল্পে আর উপমায় কবি তা-ই চিত্রায়িত করেছেন।

 ‘ভুলের ভূগোলে ভালোবাসা’ ও ‘মিষ্টিমুখের ভূগোল’—কবিতা দুটিতে জীবনানন্দীয় চেতনা ও কল্পসত্যের বিপরীতে বস্তুসত্যের অনিবার্য রূপকে স্বীকার করা হয়েছে। তিনি ইউরোপীয় মেকি আভিজাত্যে মুগ্ধ হতে পারেননি। বরং ভারতবর্ষের এই নাতিশীতোষ্ণ ভূ-খণ্ডের জলবায়ু, মানুষের সারল্য আর আতিথেয়তার রুচিস্নিগ্ধ বর্ণনা দিয়েছেন। ‘বৃক্ষ সিরিজ’-এর কবিতাগুলোয় এর প্রমাণ উজ্জ্বল হয়ে আছে।

শেকড় প্রোথিত মহানন্দার মাটিতে; অথচ রসালের প্রসঙ্গ ওঠালেইক্যাকটাসদৃষ্টি! ফলে হয়তোবা নিমফলজাতীয় গোলমাল হয়ে গেছে—এমন ভাবনা ভেঙে দিতে চায়! কিন্তু যেখানেই যাই—একরাশ কুসুমিত গন্ধ সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকে অনুভবের বাতাবরণ; তবু সত্য এই যে এই ওয়ানটাইম সময়ে অদ্যাবধি এমনকি একটা টোকাও হয়নি খরচ।
(বৃক্ষ-পাঁচ)

এ কবিতায় আবহমান বাংলার রূপ-ঐশ্বর্যের পাশাপাশি, স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যের প্রতি পাঠককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। তথাকথিত আভিজাত্যের মূলোৎপাটনের অঙ্গীকারের চিত্র এঁকেছেন।  

আমাদের চারপাশে বিস্তারিত কচুক্ষেত
সেই ক্ষেতে খোলা হাওয়ায় দোলে
বামনচাষের হাসি
আমাদের মাটিবর্তী দেহ, শয্যাবর্তী মন
ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে তবে আর কাম কি
আকাশবর্তী তালগাছের শাখায় ঝুলে থাকা
বাবুইয়ের স্বর্গ দেখে!
তাইতো আমরা ইতিহাসের উঠোন থেকে
কুড়াল এনেছি—কুড়াল
আমরা অনার্যের ওয়ারিশ কি না!
বটগাছের দিন শেষ

আমগাছের গোড়ায় শেষ সামন্তের জল
অতএব কচুক্ষেত;
হা হা! হো হো! হি হি! 
(কচুক্ষেতের হাসি)

শেষ পঙ্‌ক্তিটি কবিতার স্বাভাবিক পরিণতি ও উৎকর্ষের পথে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। একইসঙ্গে পুরো কবিতাটির ঔজ্জ্বল্যকে ম্লান করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ভূমিকাও রেখেছে। শেষ পঙ্ক্তিটিকে পাঠককে বাংলা সিনেমার খলনায়কের মেকি অট্টহাসিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই পঙ্ক্তিটিই কবিতাটিতে না থাকলেই সমীচীন হতো। 

‘শীতের বাতাসের দোলে পাপিয়ার নীড়’ ভাবাবেগের নিদর্শন। ‘হাওয়া’, ‘গাঙ ও দ্বীপ’, ‘সিকস্তি-পয়স্তি’, ‘আবহসঙ্গীতের খসড়া’, ‘ডায়েরি ও গোলাপ’, ‘সুন্দর বনের সুরসভায়’, ‘প্রথম সাঁতার’, ‘আমাদের ভালোবাসার দিন’, ‘সূত্র’ কবিতায় কবিহৃদয়ের অগভীর জলের তীব্র আন্দোলনের ছাপ রয়েছে। 

এ গ্রন্থের কবিতাগুলোয় ছন্দস্পন্দনের ছাপটি পাঠকের কানকে স্বস্তি দেয়। যেহেতু ছন্দে কবি সিদ্ধহস্ততার প্রমাণ তার প্রথম কাব্যেই রেখেছেন, সেহেতু তিনি নিরূপিত ছন্দে হাঁটলে আরও কবিতার প্রান্তসীমার দিকে অনেক দূর অগ্রসর হতে পারতেন। 

তার চিত্রকল্প নির্মাণে নতুনত্ব আছে; স্বকীয়তা আছে তার প্রয়োগেও। উপমাকে নিজস্ব সম্পদে পরিণত করার চেষ্টা তিনি করেন না, সম্ভবত যুগের প্রভাবে। যুগের প্রভাবে কবি প্রভাবিত হন ততটুকু, যতটুকু আত্মস্থ হতে সময় লাগে। আমিনুল ইসলাম নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেন। তিনি কবিতায় কোনো আদর্শের প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তার কবিতায় নিভৃতচারিতা ও মৌনতা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। সে বাঙ্ময়তা কবিকে কবিতার সড়কের দিকে ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপ দেওয়ার প্রণোদনা দেয়।



আরো পড়ুন