পুঁজিবাজারের নাজুক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর কিছু পলিসিগত ত্রুটির কারণে দিনে দিনে ফরেন ট্রানজেকশন (বিদেশি লেনদেন) ও বিনিয়োগ কমছে বলে জানিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তবে, করোনা, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও ফরেন ট্রানজেকশন গত কয়েক বছর ধরে কমতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জানান, পুঁজিবাজারের অধিকাংশ কোম্পানি ডিভিডেন্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। অনেক কোম্পানি আছে, যেগুলো প্রফিট হওয়ার পরেও ডিভিডেন্ড দেয় না অথবা বিনিয়োগকারীদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ডিভিডেন্ড দেয় না। এসব কারণে প্রতিনিয়ত পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমতে শুরু করেছে। কমতে শুরু করেছে ফরেন ট্রানজেকশন। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি বিনিয়োগ কমলে, বিদেশি লেনদেনও আপনা-আপনি কমতে শুরু করে।
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আরও জানান, বিএসইসি বিভিন্ন দেশে রোড-শো করছে। বর্তমান কমিশন সরকারি খরচে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার রোড-শো সম্পন্ন করেছে। এসব রোডশার মূলে উদ্দেশ্যই হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করা। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়েনি। উপরন্তু কমেছে। এসব রোড-শো করে কোনো লাভ হয়নি। পুঁজিবাজারে বিদেশি লেনদেন বাড়াতে হলে দেশের পুঁজিবাজারকে ঠিক করতে হবে। ভালো মানের কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। কোম্পানিগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিএসইসিসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে ডিএসইতে মোট ফরেন ট্রানজেকশন হয়েছে ১০ হাজার ৩৮৭ কোটি ৬৫ লাখ ৫৫ হাজার ৭২৫ টাকা। আর ২০২২ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৭৯ কোটি ৯২ লাখ ২৭ হাজার ৬৯৩ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে ফরেন ট্রানজেকশন কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২০৭ কোটি ৭৩ লাখ ২৮ হাজার ৩২ টাকা। অর্থাৎ ৫৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ বিদেশি লেনদেন কমেছে। আর ডিএসই’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুন মাসে বিদেশি লেনদেন এসে দাঁড়িয়েছে ৯৭৯ কোটি ২০ লাখ ৬২ হাজার ২৪৬ টাকা; যা আনুপাতিক হারে গত কয়েক বছরের তুলনায় আরো কমেছে।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিএসইতে বিদেশি লেনদেন হয়েছে ৪৭ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের মে মাসে বিদেশি লেনদেন কমে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশীদ চৌধুরী ঢাকা বিজনেসকে বলেন,‘পুঁজিবাজারে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়, সেগুলোর অধিকাংশই কাগজে-কলমের কোম্পানি। তারা পুঁজিবাজারে আসার আগে তাদের প্রফিট কাগজে-কলমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখায় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তাদের প্রফিট খুবই কম। তাছাড়া এসব কোম্পানি ডিভিডেন্ড ঠিকভাবে দিতে চায় না বিনিয়োগকারীদের। এসব কারণে প্রতিনিয়ত শেয়ারবাজারে ফরেন ট্রানজেকশন কমছে। কমছে ফরেন ইনভেস্টমেন্টও। এছাড়া বিএসইসির পলিসিগত কিছু সমস্যা বা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ফরেন ইনভেস্টররা শেয়ার সেল করে বের হয়ে যাচ্ছে।’
মিজান উর রশীদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘যেসব কোম্পানির পেইড আপ ক্যাপিটাল (পরিশোধিত মূলধন) সর্বনিম্ন ৫০ কোটি টাকা, কেবল সেসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করানো উচিত। পাশাপাশি পরিশোধিত মূলধনের সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ টাকা বাজার থেকে নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া উচিত। তবেই বিদেশি লেনদেনসহ শেয়ারবাজারের সামগ্রিক লেনদেন বাড়বে।’
ডিএসই’র ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী পুঁজিবাজারে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট ও ফরেন ট্রানজেকশন কমে গেছে। পাশাপাশি বাজারে ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার কারণেও ফরেন ট্রানজেকশন কমে গেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী যখন দেশের অর্থনীতি পজেটিভের দিকে টার্ন নেবে, তখন ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বাড়বে। বাড়বে ফরেন ট্রানজেকশনও।’
সাইফুর রহমান মজুমদার আরও বলেন, ‘ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বাড়ানোর জন্য আমরা বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। আর কিছু কিছু পলিসি জায়গায় এড্রেস করতে হবে। কিছু ইতোমধ্যে এড্রেস করা হয়েছে। বিভিন্ন রেগুলেটরদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হচ্ছে। মার্কেটের গভীরতা বাড়ানোর জন্য আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। যেমন বন্ড মার্কেট তৈরি করা, অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট বোর্ড, এসএমই বোর্ড, অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, এসমস্ত জায়গায় প্রডাক্ট ডাইভারসিফিকেশনের উদ্যোগ ইতোমধ্যে নিয়েছি। নির্বাচন পরবর্তী এসব উদ্যোগ কাজে লাগবে। তখন ফরেন ট্রানজেকশনও বাড়বে।’
সিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম ফারুক ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবী স্থবির হয়ে গেছে। ফলে ফরেন ট্রানজেকশন কমে গেছে। আর দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে গেলেই ফরেন ইনভেস্টমেন্ট আসা শুরু হবে। তখন এর ট্রানজেকশনও বাড়বে।’
বিএসইসি’র মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। পাশাপাশ ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণেও বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। তবে বর্তমানে ডলারের রেট স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। ডলারের এই স্থিতিশীলতা যদি বিরাজমান থাকে তবে ২০২৩-এর শেষ দিকে এবং ২০২৪ সালে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বাড়বে। আর ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বাড়লে ফরেন ট্রানজেকশনও বাড়বে। ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশে বিএসইসি রোড-শো করছে। আর রোড-শো করলেও রাতারাতি ফরেন ইনভেস্টমেন্ট আসবে না। সময় দিতে হবে।’
ঢাকা বিজনেস/এনই