২৯ জুন ২০২৪, শনিবার



টাঙ্গাইলে ধুম লেগেছে নৌকা তৈরির

আব্দুল্লাহ আল নোমান, টাঙ্গাইল || ১০ জুলাই, ২০২৩, ০২:০৭ পিএম
টাঙ্গাইলে ধুম লেগেছে নৌকা তৈরির


টাঙ্গাইলের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকা তৈরির ধুম পড়েছে। জেলার ৩২ হাটে এখন তৈরি নৌকা বিক্রি হচ্ছে। নৌকা তৈরির মৌসুমি কাঠমিস্ত্রিরা খুবই ব্যস্ত সময় পার করছেন। দিনরাত হাতুড়ি-বাটালের ঠোকাঠুকিতে মুখর হয়ে উঠেছে টাঙ্গাইলের নৌকা তৈরির হাট-বাজার।

স্থানীয়রা বলছেন, টাঙ্গাইলের ১২ উপজেলার মধ্যে মধুপুর ছাড়া বাকি ১১ উপজেলায় বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতে নৌকার প্রয়োজন হয়। বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে নৌকা তৈরির কাঠমিস্ত্রিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দিনরাত কাঠ চিরানো, কাঠ ও গুঁড়া বানানো, র‌্যাঁদা দিয়ে কাঠ মসৃণ করা ও তারকাঁটার ব্রাশ দিয়ে কাঠ জোড়া লাগানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন মিস্ত্রিরা।  

নৌকা তৈরির মৌসুমি কাঠমিস্ত্রিরা বর্ষা ছাড়া বাকি সময়ে পারিবারিক কাজ করে থাকেন। আবার পেশাদার কাঠমিস্ত্রিরা সারাবছর নৌকা তৈরি ছাড়াও ঘর, খাট, চেয়ার, টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, আলনা, আলমারি ইত্যাদি গৃহস্থালি আসবাব তৈরি করেন। 

টাঙ্গাইলের ১১ উপজেলার ৩২ হাটেই বর্ষা মৌসুমে নৌকা বিক্রি করা হয়। হাটগুলো হলো,  টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলি, মাহমুদ নগর, ছিলিমপুর ও ওমরপুর; নাগরপুরের গয়হাটা ও চরসলিমাবাদ; মির্জাপুরের বরাটি, ছাওয়ালি মহেড়া ও চাকলেশ্বর; কালিহাতীর রামপুর, আউলিয়াবাদ ও কস্তুরিপাড়া; বাসাইলের মিরিকপুর, কাউলজানী, রাশড়া করিম বাজার ও ফুলকী; ঘাটাইলে কদমতলী ও হামিদপুর; ধনবাড়ীর পাইস্কা ও কেরামজানী; গোপালপুরের মোহনপুর, নলীন বাজার, নবগ্রাম ও চাতুটিয়া; ভূঞাপুরের ফলদা, গোবিন্দাসী, কুঠিবয়ড়া ও অর্জুনা; সখীপুরের দাড়িয়াপুর ও বহেড়াতৈল এবং দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি, এলাসিন ও ফাজিলহাটি।


সরেজমিনে দেখা গেছে, কাঠমিস্ত্রিরা কেউ বাড়ির আঙিনায় বা পাড়ার খালি জায়গায়, কেউ কেউ হাটের পাশে নৌকা তৈরি করছেন। আর তাদের কাজে সহযোগিতা করছেন পরিবারের লোকজন।

কাঠমিস্ত্রি বলরাম সূত্রধর, বিশ্বজিৎ সূত্রধর, স্বপন সূত্রধর, পলাশ সূত্রধর বলেন, ‘এখন প্রায় প্রত্যেক এলাকার বড় রাস্তাই পাকা করা হয়েছে। ফলে দূরের যাত্রার জন্য কেউ বড় নৌকা তৈরি করে না। বর্ষায় এ পাড়া থেকে ও পাড়া যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট নৌকার প্রয়োজন হয়। তাই বড় নৌকা তৈরি হয় না। ছোট নৌকার কদর বেশি। আগে এই পেশা তাদেরই ছিল। অন্য পেশা থেকে এই পেশায় এসে আমাদের উপার্জনের পথ সংকুচিত করে দিয়েছেন।’

তারা আরও বলেন, ‘বর্ষায় কাঠমিস্ত্রির কাজ করেই আমাদের সংসার চলে। ছোটবেলা থেকে বাপ-দাদার কাছে হাতেখড়ি নিয়েছি।  কাঠমিস্ত্রির কাজ করাই আমাদের নেশা ও পেশা।’ 

বাসাইল উপজেলার সদর ইউনিয়নের মিরিকপুর প্রফুল্ল সূত্রধর বলেন, ‘আমি রাশড়া করিম বাজারে নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেছি। আমার সঙ্গে আরও দুই জন কাজ করছেন। তারাও ব্যস্ত সময় পার করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ৫৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাঠমিস্ত্রির কাজ করছি। ছোটবেলায় হাতুড়ি ও বাটালের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। আমাদের সময় পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি ছিল। সংসার চালাতে বাপ-দাদার সঙ্গে কাঠমিস্ত্রির কাজ শিখেছি। মুরব্বিদের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাজ করছি। এখন বর্ষার সময় হলে নৌকা তৈরি করছি। শুকনো মৌসুমে ঘর, খাট, চেয়ার, টেবিল ড্রেসিং টেবিল, আলনা, আলমারি ইত্যাদি তৈরি করে হাটে বিক্রি করে সংসার চলে।’

বর্ষা মৌসুমে নৌকার কদর বেড়ে যায়। তাই বর্ষার সময় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এই মিস্ত্রিরা। বাপ-দাদাদের শিখিয়ে যাওয়া কাজ এখন তাদের নেশা ও পেশা হয়ে গেছে। একটি ছোট নৌকা তৈরি করতে ২-৩ দিন সময় ও ৮ থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ হয়। হাটে ওঠালে একটি ছোট নৌকা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়।

কাঠমিস্ত্রি রমেন স্যানাল বলেন, 'শিশুকালে হাতুড়ি-বাটালের সঙ্গে বড় হয়েছি। লেখাপড়া করিনি। পূর্বপুরুষের পেশাকেই মূল পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। বউ-বাচ্চা নিয়ে মোটামুটি ভালোই চলে যায়। চুক্তিতে বায়নায় নৌকা তৈরি করা হয়। এতে প্রতিদিন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা মজুরি পাই। বর্ষার সময় এলে আয়-রোজগার ভালোই হয়। শুকনো মৌসুমে সংসারের টুকিটাকি আর কৃষিকাজ করি। এই পেশায় প্রায় ৩৫ বছর ধরে আছি।'

আরেক কাঠমিস্ত্রি সখী সরকার বলেন, 'প্রায় ৩০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। বর্ষার সময় নৌকা তৈরি ও অন্য সময় ঘর তৈরির কাজ করি। বর্ষা মৌসুমে নৌকার খুবই কদর থাকে। এ সময় নৌকার কাজ বেশি করি।'

ঢাকা বিজনেস/নোমান/এন/



আরো পড়ুন