নারী-সে তো শিকল দিয়ে বাঁধা নয়, তবে সে মুক্তি চায় কেন? কোথায় সেই অদৃশ্য কারাগার যেখান থেকে নারী প্রতিনিয়ত মুক্ত হতে চায়। নারী কি বাকশক্তি, চিন্তাশক্তি কিংবা কর্মশক্তিতে স্বাধীন। মূলত নির্ভরশীলতাই নারী মুক্তির অন্তরায়। ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে নারীমুক্তি আন্দোলন এর সূচনা হয়েছিল, যা ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে অব্যাহত ছিল। মূলত এ জাগরণ গোটা বিশ্বে একটা বড় প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। নারীদের জন্য সমতা অর্থাৎ সব মানুষের জন্য সাধারণ মানবাধিকার ছিল এ আন্দোলনের লক্ষ্য। নারীমুক্তি আন্দোলনের কারণ ছিলো পুরুষতন্ত্র ও লিঙ্গবাদ।
আশির দশক পার হয়ে নানা প্রতিকুলতার পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমানে নারী এগিয়েছে বহুদূর। পুত্র সন্তানের পাশাপাশি কন্যাকেও শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের দ্বার এখন অনেকটাই প্রসারিত। এখন শিক্ষা,কর্মে,সংস্কৃতিতে পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে নারী। কিন্তু এতদূর আসার পরও নারীর কি সচ্ছলতার মুক্তি মিলেছে?
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, একটি শিশু জন্মের পর থেকে পরিবারে পুরুষ প্রাধান্য বা কর্তৃত্ব দেখেই বড় হতে থাকে। যেহেতু বাবা আয়ের উৎস; সেহেতু তার মাধ্যমেই পরিবার পরিচালিত হয়। খুব কম পরিবারই আছে, যেখানে নারীর ইচ্ছা,চিন্তা কিংবা মূল্যবোধের অধিকারকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সচ্ছলতা এমন একটি বিষয়, যার মধ্যে স্বাধীনতা ও অধিকার নিহিত। সচ্ছল নারী কিংবা পুরুষ সবাই এই স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করার অধিকার রাখে। তবে নারী সেই প্রাচীন কাল থেকেই সচ্ছলতার দিক থেকে পিছিয়ে। কারণ জন্মের পর থেকেই পুরুষনির্ভর সমাজব্যবস্থায় শিশুরা বড় হয়ে ওঠে এবং এটাই লালন করে। নারীর সচ্ছলতার মূল হলো আত্নকর্মসংস্থান। কিন্তু সেই কর্মস্থলেও দেখা যায় বৈষম্য।
করোনাকালীন মহামারীতে দেখা গেছে বাবা চাকরি হারিয়েছেন, স্বামী চাকরি হারিয়েছেন। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সফলতার সঙ্গেই অনেক কন্যা,অনেক স্ত্রী হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। ধরেছেন সংসারের হাল, সংসারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মুখ দেখিয়েছেন।
স্বল্পশিক্ষিত কিংবা লেখাপড়া না জানা নারী ও কিন্তু তার অবস্থান থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। গৃহ পরিচালিকা থেকে শুরু করে দিনমজুর,গার্মেন্টসকর্মী পারিবারিক অভাব মেটাতে আর্থিক সচ্ছলতার জন্য কাজ করে। যদিও এসব কাজে নানা বৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে নারীকে টিকে থাকতে হয়। নারীকর্মীরা পুরুষকর্মীর চেয়ে বেশি মনোযোগী এবং পরিশ্রমী হন। পারিশ্রামিকও কম দিয়ে কাজ করানো যায়। তাই গার্মেন্টসশিল্প নারীকর্মীর চাহিদা বেশি। একইভাবে দৈনিক মজুরির কাজে যেমন, ইটভাঙা, ছাদঢালাই, মাটি কাটা ইত্যাদি কাজেও পুরুষের চেয়ে নারী কর্মীকে মজুরি কম দেওয়া হয়। দরিদ্র নারী সংসারে একটু সুখের মুখ দেখা,সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মিটানোর জন্য,একটু ভালো পোশাকের আশায় এ বৈষম্য মেনে নিয়েও কাজ করে যায়।
বর্তমানে নারীরা ব্যবসায়ে এক অভূতপূর্ব জাগরণের সৃষ্টি করেছে। প্রথমত নারী শুধু হস্তশিল্প, কিছু কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে কাজ করবে; এমন ধারণা করা হতো না। ই-কমার্সের ক্ষেত্রেই বর্তমানে ব্যাপক হারে নারী উদ্যোক্তা কাজ করছেন। আমরা পরিসংখ্যান দেখি, বর্তমানে নারী উদ্যোক্তার হার মোট উদ্যোক্তার ৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনাকালীন মহামারীতে দেখা গেছে বাবা চাকরি হারিয়েছেন, স্বামী চাকরি হারিয়েছেন। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সফলতার সঙ্গেই অনেক কন্যা,অনেক স্ত্রী হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। ধরেছেন সংসারের হাল, সংসারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মুখ দেখিয়েছেন।
শ্রমবাজারে বৈষম্য দূর করতে হলে পরিবারে সৃষ্ট বৈষম্যকে আগে দূর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের প্রথম দায়িত্ব বাবা-মাকে সন্তানকে ছেলে-মেয়ে হিসেবে নয়, বরং সন্তান হিসেবে মানুষ করা। নারীর কাজের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা পরিবার থেকেই শেখাতে হবে। কখনো কখনো দেখা যায়, নারীর উপার্জিত অর্থ গৃহকর্তার হাতে বন্দি হয়ে যায়,নারীর স্বাধীনতা বা অধিকার বলে কিছুই থাকে না। আবার কখনো দেখা যায় স্বল্প আয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জন কতটা সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। পরিবার থেকেই সমাজের সৃষ্টি, সমাজ থেকে রাষ্ট্রের। সুতরাং পরিবার থেকেই মানসিকতার বিকাশ হতে হবে।
জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর যে শ্রম ও উদ্যোগ যুক্ত, তার যথাযথ মূল্যায়ন যেন আমরা করতে পারি
নারীর অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য কর্মস্থলের পরিবেশ, নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণ জরুরি। নারী শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে। সরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্টের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ফ্রি ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অনুদানের ব্যবস্থা নিতে হবে।এছাড়াও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে জামানত ছাড়া ঋণ এর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
নারী গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা এবং তাঁদের শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা সময়ের দাবি।
২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রতিবছর গার্মেন্টস খাতে কর্মী বেড়েছে ১ শতাংশ হারে। এ সময়ে পুরুষ কর্মী ৪ শতাংশ হারে বাড়লেও নারী কর্মী কমেছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে। সর্বত্র প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে পোশাক খাতে ও প্রযুক্তিগত ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র চালাতে সক্ষম কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীদের সীমাবদ্ধতা থাকায় অনেকে পিছিয়ে পড়েছেন নারী কর্মীরা। তাই টিকে থাকতে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।
বেতন বৈষম্য হ্রাস করতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়নে আমরা যেন অন্তরায় না হই। জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর যে শ্রম ও উদ্যোগ যুক্ত, তার যথাযথ মূল্যায়ন যেন আমরা করতে পারি এবং তাদের যেন আমরা অভিনন্দিত করতে শিখি।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা