২১ ডিসেম্বর ২০২৪, শনিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

ধ্যান নাকি মোহ

রকিবুল হাসান || ২৩ জুন, ২০২৩, ১০:৩৬ এএম
ধ্যান নাকি মোহ


মাজি ভাই 
মাজি ভাই, ক তো ক্যাম্বা আছিস কোথায় আছিস
কতদিন কুনো কথা হয় না মন ভরে তোর সঙ্গে,
পোটনিতে তোর সাথে রাতবিরাত কবিতা নিয়ে 
কথাও হয় না- ভাতের হাড়িতে চালশূন্য। 
কবিতারা একদিন ক্যাম্বা জীবনের জীবন হয়ে স্রোত হয়ে
বয়ে যেতো নগর বন্দরে হাওরে বাঁওড়ে!

মাজিভাই, কচুরিফুল তুলতে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটতাম 
পুকুরের পচা পানিতে-পচাপানির বুকে কী সুন্দর ফুল
কবিতার শরীরে জড়িয়ে যেতো রাতের জ্যোৎস্নায়, 
আহা! যেন বাড়ির পাশের কী সুন্দর অষ্টাদশী রূপবতী!
কতোদিন তোর সাথে হাঁটা হয় না শিলিদা  
রবিঠাকুরের নায়িকাদের গল্প করতে করতে, 
ওসব নায়িকা তো আমাদের কত চেনা
অধিকাংশই তো আড়পাড়া শিলিইদা জাতপুরেরই মেয়ে। 

মাজিভাই, তোর কথা খুব মনে হয়ে
রাত জেগে কুশোরের রসে টিন ভর্তি করা রাতজাগা ঘুমচোখ
সেই রসে ঢেউ খেলতো আগুন—
আহা! গুড় জন্মানোর টগবগে ঢেউ! 
মাঠে গরুরাখা শামুক খেলা মাঠের পর মাঠ 
সদরপুরের বিলে কতদিন যে সাপ ধরে গলায় জড়িয়েছি
মনে আছে তোর ওসব- তুই এখন ক্যাম্বা আছিস মাজি ভাই?

মাজিভাই তোর জবাফুলের গাছটার এখন আর কদর নাই
তোর ভাঙা চেয়ার টেবিল মা’র গা’র গন্ধমাখা খাট 
ওসব কোথায় মিশে গেছে 
তোর গলায় জড়ানো তেলচিটচিটে গামছাটা 
খুব মনে আছে মাজি ভাই,
তুই কী যে যত্ন করে ছোট ভাইবোনদের রোদে ঘামা গা
মুছে দিতি-তারপর কোলের ভেতর জড়িয়ে নিতি 
কাঁচা তুলতুলে ফুলের মতো নরম শরীরগুলো!
বাতাসে ওসব গন্ধ এখন কি তোকে খোঁজে মাজি ভাই!

মাজি ভাই, তুই এখনো শূন্যে বসত করে কী সুন্দর হেসে 
পথের পরে পথ হাঁটিস—নিজের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে 
কী সুন্দর তুই দারুণ সুখী একতারা হয়ে ভেসে যাস 
নদীপথ আলপথ জীবনপথ কত পথ ঘুরে ঘুরে,
তুই একদিন আমাকে কবি তো মাজি ভাই
শিশিরভেজা দুবলাঘাস 
কেমন করে ভালোবেসে পা জড়িয়ে ধরে ভোরের আলোয়
কেমন করে আকুতি করে বুকে ধরে রাখে প্রেম!

মাজি ভাই, তুই কি এখনো কষ্ট পাস ছোট্টপাখির মৃত্যু দেখে!
এখনো কি তুই কাঁদিস মধ্যরাতে 
এখনো কি চোখে ভাসে অপমানে বাবার কান্না
এখনো কি চোখে ভাসে অপমানে মায়ের কান্না
এখনো কি চোখে ভাসে অপমানে পিতামহের কান্না!
আহারে সেই যে বাতাস এখনো কী আতর্নাদ করে ভেঙে পড়ে
নদীর পাড় ভাঙার মতো বিকট শব্দে তোর বুকে!

মাজি ভাই কোনো কথা কয় না
মাজি ভাইয়ের চোখে কোনো আলো থাকে না
মাজি ভাইয়ের বুকে কোনো  ব্যথা থাকে না
মৃত মানুষ আর মাজি ভাইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না।

বাতাসে ব্যাকুল একতারা কেঁদে যায়
একতারা সুর এখন নিজেও মরে মরে ভেসে যায় 
মাজিভাইও ভেসে যায় বুকভাঙা ঢেউয়ে কূল-কিনারা ঠিকানাহীন। 

একটি সাধারণ ছবি 
খুব সাধারণ মানের একেবারেই সাদাসিধে একটি ছবি 
কী এক অদ্ভুত শক্তিতে
ধরে রাখে আমাকে গভীর সুতোবন্দি করে

একটুও যত্ন নেই ছবিটির কোথাও
শুধু নিখাদ মাটিতে দাঁড়ানো যেন কাঁচাবালিকা মুখ 
পুষ্পিতা পাপড়ি ছড়ানোছিটানো

মায়াবী দু’চোখে যেন মেঘভরা কথার পালক—
উড়ে আসে ভেঙে ভেঙে
আমাকে অনেক কথা বলে যায় কোনো কথা না বলেই

ছবিটা কি রঙিন প্রজাপতি নাকি দোয়েলিকা পাখি 
মনের অরণ্যে ওড়ে নিজমনে বাঁধা আপন সংগীতে
নাকি কবিতার রহস্যঈশ্বর জীবনছন্দে দুলে ওঠা 
সুন্দরিমা স্বর্ণ ফসলের মাঠ

আমি কী যে মল্লিকা মুগ্ধতা নিয়ে ডুবে থাকি 
ছবিটি কি তাহলে নদী অথবা সমুদ্র
আমাকে এ কোন স্রোতে টানে— 
আষাঢ়ের বন্যা কীভাবে চেনে সে...

খুবই সাধারণ মানের মধ্যবিত্ত পরিবারের অষ্টাদশীর 
সাদাকালো ছবি যেন
একটুও প্রসাধনের ঘষামাজা নেই—নগরীনাবিলার 
ঘ্রাণ নেই বসনে, কোনোরকমে 
একখণ্ড কুচকুচে কালো মৈথিলী মেঘের মতো একমুঠো চুল 
ছড়িয়ে রয়েছে ঢেউবতী বুকের কার্নিশে
আনমনে কখনো হয়তো সে নিজেই নিয়েছিল টেনে...

কোথায় দেখেছি যেন— 
কাহ্নপা নাকি বড়ু চণ্ডীদাসের ঘরে—মনে পড়ে না
শিলাইদহ নাকি লালনের মাজারে—গভীর ধ্যানে খুঁজি 
পথ ভেঙে পথে পথে—‘আমার মনের মানুষ যে রে...’

এসে দেখে যাও
শ্যামল দীঘির জলে স্বপ্নভরা সেই চোখ খুঁজে নিতে 
কোনোদিন যদি পারো এসো, দেখে যেও 
কেমন আছে ডাহুকেরা আর কলমিলতার ফুল
যেখানে আমার রাত্রিদিন 
ডানা ঝাপটায় কতো যে রোদ বৃষ্টি শিশিরের গান। 

যদি পারো এসো, অন্তত একবার হলেও এসো
অভাবের রাত্রিতে কীভাবে শিখেছি দৃঢ়তা
গন্ধহীন জবাফুল থেকে কীভাবে জেনেছি 
আবেগহীন শ্রমিকের ঘামে স্বপ্নের কঠিন চাষ,
কিভাবে গোখরা সাপের সাথে খেলেছি অবাধ্য যৌবন। 

তামাদি মাটির বুকে যে ফলাতে জানি সবুজ ফসল
ঝড়ে আছড়ে পড়া ৃবৃক্ষের কাছ থেকে জানি
ভেঙে পড়েও কীভাবে দাঁড়াতে হয় নতুন জীবনে
পারলে এসে দেখে যেও শ্যামল দীঘির জল
জবাফুল বাড়ি বিবর্ণ বৃক্ষের মাথাউঁচু দাঁড়িয়ে থাকা। 

তোমার নগরে কোনোদিনই যাওয়া হবে না আমার
যদি পারো এসো, দেখে যেও নিখাদ মাটিতে এখনো 
কিভাবে কবিতা দুবেণী দুলিয়ে দোল খায় উঠতি যৌবনা,
বাতাসের গায় কীভাবে দারুণ মুগ্ধতা ছড়িয়ে ভেসে যায়
ঘর্মাক্ত যৌবন স্বপ্নমৌতাত মৃত্তিকা গান, এসো, দেখে যাও।

উৎসবে আমার নাম লিখো না 
তোমাদের উৎসবে কোনোভাবেই নাম লিখো না আমার 
কোনো উৎসবেই আমি নেই,
সব উৎসব থেকে আমি আমাকে নিয়েছি ফিরিয়ে 
কাফনে জড়াানো শরীরের মতো নিঃসঙ্গ একাকী বাউল।

কেন যেন আমার ভেতর আমি মরে মরে পড়ে থাকি
কোনো রঙ কিছুতেই স্পর্শ করে না আমাকে,
বিবর্ণ দুর্বাঘাসের করুণ আকুতি শিশিরের রাত 
শীতল বাতাস আমাকে ডুবিয়ে রাখে মাটির অতলে। 

আমাকে বোঝেনি কেউ, হয়তো আমিও-শ্মশানের কাছে 
বসে থেকেছি গভীর কতো রাত-মানুষ পোড়ানো গন্ধ,
কেউ বোঝে না নিজেকে কে কীভাবে পোড়ায় জীবনরাত্রি
উৎসবের অপেক্ষায় থাকা যৌবন নিজেই এখন উৎসবহীন। 

পোটনির পাশে লাল গোলাপের সেই যে অকাল মৃত্যু-
সেই তো প্রথম উৎসবহীন হওয়ার গভীর বেদনা,
আজও উৎসবহীন থেকে গেছি-কেউ চায়নি আমাকে
বিকেলের গানে একতারা হাতে হেঁটে যাই দূরের গহন। 

এখন আমার উৎসবের রঙ নেই- বিবর্ণ দুচোখে
শুধুই বিস্ময়-নিজেকে পোড়ানো বুকে, 
কিছুতেই কখনো পাই না উৎসবের ঘ্রাণ
কাফনে জড়ানো শরীরের মতো একাকী, নিঃসঙ্গ একতারা। 

তোমাদের উৎসবে কোনোভাবেই লিখো না নাম আমার
একদিন চৌচির মাঠের মতো অপেক্ষা করেছিৃ

নিজেকে খোঁড়ে না কেউ 
ইদানীং মানুষ মানুষকে খুঁড়তেই বেশি পছন্দ করে
চায়ের দোকান থেকে আবাদী জমির মাঠ 
অফিস থেকে রাজনীতির পাড়াা মহল্লা 
রাজকীয় লালগালিচার অহমিকা ক্ষমতার মসনদ 
প্রেমের শরীর থেকে স্বার্থের হিসেবী ধারাপাত।

সর্বত্র মানুষ মানুষকে খুঁড়তে থাকে ছিঁড়তে থাকে 
মাহাত্ম্য ও পাণ্ডিত্যের হিংস্র নিষ্ঠুর বাক-শাবলে 
খুঁড়তে খুঁড়তে একসময় নিজেই পচে যায়
নিজের দুর্গন্ধ বাতাসের অদৃশ্য শরীরে ভেসে যায়, 
বুঝতে পারে না কিছুতেই-
একদিন নিজেই ভাগাড়ে যে শকুনের সুস্বাদু খাবার। 

অথচ কী ভীষণ আশ্চর্য 
নিজেকে কখনো ভুল করেও খোঁড়ে না কেউ
কতোটা পাপের পচা কুয়োয় ডুবে আছে জীবনভর!
নিজেই নিজের বুকের ভেতর পুষে রাখে বিষাক্ত সাপ,
নিজেকে না-খুঁড়তে খুঁড়তে থাকে খুনের নেশায় প্রেমের শরীর।

উত্তরহীন বিবর্ণ সুর 
বারবার উন্মত্ত মাতাল এসেছিল দরোজায়
গ্রহণ করিনি তাকে
কাঁচের চুড়িতে রক্তাক্ত হাত
এখনো সে ক্ষত  পোড়ামাটির মতোন কথা কয়
তবুও ভালোবাসিনি দিকহারা মাতাল প্রেমিক।

অথচ অপেক্ষার ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত 
বিশ বছর অচেনা আমার,
কতোদিন কতো ভাবে ছুটে গেছি
জীবনকে তুচ্ছ করে
দিগন্ত পেরিয়ে দিগন্তের সীমারেখা ভেঙে
একদণ্ড দেখার বাসনা-
জানি সে আমার কেউ নয়
তবুও যাই -কেন যাই গগনের একতারা 
‘আমার মনের মানুষ যে রে’
সেই উত্তর আজও খুঁজি
উত্তরহীন বিবর্ণ সুর ভেসে যায়। 

কতভাবে আমাকেই আমি খুঁজি-
তাকে খুঁজি
যে আমার পরান গহীনের গোপন যৌবন
গোপন বেদনা 
একাকী রাতের দূরের গাঁয়ের একতারা সুর।

এ শহর তোমার ধ্যানী 
অকস্মাৎ ঝড়ের গতিতে অগ্নিকা নগরে তুমি
সঙ্গে একটু একটু বৃষ্টি যেনো আদরের ফোঁটা,
তারপরও তোমার মুখ ভিজেছিল ঘামে
ঘাম আর বৃষ্টিতে একাত্ম দারুণ রূপশ্রী রমণী।

এ নগর চেয়েছিল 
তোমাকে আরও কিছুটা সময়,
ওদিকে জীবনবেলার হুইসেল 
ডাকে প্রবল তাগিদে ফেরার সময়। 

তবুও কিছুটা সময় তো এ নগর 
পেয়েছে প্রশান্তি আগুনের মেঘে শীতল হাওয়া 
বুকুল থেকে বৃন্দাবন, অতঃপর
এ শহর তোমার দিকে তাকিয়ে নির্বাক ধ্যানী।

সামান্য নগর অসামান্য হয়ে ওঠে তোমার মরমি স্পর্শে
নিশ্বাসের ঘ্রাণে।

এখানে এখন বৃষ্টি 
সেই প্রার্থনা তুমিই দিয়েছ শিখিয়ে
আগুনের মেঘে কিভাবে নামাতে হয় বৃষ্টির ফোয়ারা!

ধ্যান নাকি মোহ
তোমাকেও নয়
আমাকেও নয়
কাউকে তো কিছুই বলিনি
শুধু ধ্যানে আছি

ইশ্বরের একটা ছবি 
আঁকতে চেয়েছি
তুমিও 
আমিও
অথচ কখনো খুঁজে পাইনি ঈশ^র।

কাউকে বলিনি কখনো এসব
তোমাকেও নয় 
আমাকেও নয়
কাউকেই নয়।

একটা জীবনপথ 
একটা জীবনভর
হাঁটতে হাঁটতে
ভালোবাসতে বাসতে
শেষ অবধি শূন্যতে হারাই নিজেকে।

এর বাইরে কিছুই নেই
তাই কিছু বলিনি 
না তোমাকে
না আমাকে
না অন্য কাউকে;
আমরা শুধইু প্রেমের ধ্যানেতে আছি
নাকি মোহতে মেলাতে পারিনি কিছুতেই।



আরো পড়ুন