কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ও নোয়াখালীর ভাসানচরে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। মিয়ানমারে দেশটির সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন। আজ (২০ জুন) বিশ্ব শরণার্থী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। এই দিনকে ঘিরে ফের নতুন করে আলোচনায় এসেছে রোহিঙ্গা সংকট। কেমন আছেন রোহিঙ্গারা, সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা জানালেন, তাদের অধিকাংশই স্বদেশে ফিরতে চান।
রোহিঙ্গারা দ্রুত প্রত্যাবাসন চান। মিয়ানমারে ফিরে স্বাধীন জীবন উপভোগ করতে চান তারা। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের এই দিনে এসে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে দীর্ঘসময় রেখে দেওয়ার চক্রান্তে বিশেষ মহল ইন্দন দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বেশি। যারা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ-কুতুপালংয়ের ৩৩টি ক্যাম্প এবং ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছেন।
রোহিঙ্গারা জানান, তারা স্বদেশে ফিরতে চাইলেও পারছেন না। তারা দ্রুত প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছেন।
বিশ্ব শরণার্থী দিবস নিয়ে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়ার ১ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ডা. জুবায়েরের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে আরও ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত ছিলেন।’
ডা. জুবায়ের আরও বলেন, ‘জাতিসংঘের পক্ষ থেকে খাবারসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু এরই মধ্যে সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কখন জানি বন্ধ হয়ে যায়, সেই বিষয়ে দুশ্চিন্তা কাজ করছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। আশ্রয়শিবিরের জীবন খাঁচায় বন্দি জীবন। আমরা স্বদেশে ফিরতে চাই। পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়েমিয়ানমারে ফিরে স্বাধীন জীবন উপভোগ করা এখন আমাদের একমাত্র চাওয়া।’
একই ক্যাম্পের মাস্টার কামাল বলেন, ‘মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে আমার প্রাণ মিশে আছে। পূর্বপুরুষের স্মৃতি ওই মাটিতে। সেখানে স্বজনদের কবর, নিজস্ব চাষের জমি, গবাদি পশু, বাগানবাড়ি রয়েছে। আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেনাবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।’
মাস্টার কামাল আরও বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মেহমান। বাড়িতে মেহমান এলে আতিথেয়তা থাকে কয়েক দিনের। বেশি দিন হলে তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াই আমাদের একমাত্র দাবি।’
রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা মৌলভী নূর হোসেইন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে দীর্ঘসময় রেখে দেওয়ার চক্রান্ত করছে কিছু গোষ্ঠী। নিজেদের দেশ থাকতে আমরা এখানে আর ভাসমান জীবন কাটাতে চাই না। এ ছাড়া মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের অনেক ভাই এখনো ভুলের মধ্যে রয়েছেন। নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ইত্যাদির যে দাবি আমরা তুলছি, সেগুলো বাংলাদেশে থেকে সম্ভব নয়। নিজের দেশ জন্মভূমিতে বসবাস করা আমাদের জন্য অনেক স্বস্তির।’
টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা জাফর আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জাতিগত ঐতিহ্য আছে, নিজেদের দেশ আছে। আমরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। আমরা এখন আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই।’
কক্সবাজারের শরণার্থী,ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে একযোগে কাজ চলছে। আমরা যা প্রত্যাশা করেছিলাম, তা পূরণ হয়নি। তবু আলোচনা চলছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা দুই বার এখানে এসেছেন। রোহিঙ্গা নেতাদের একটি প্রতিনিধি দলও মিয়ানমার সফর করেছে। আমাদের আশা, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে।’
মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান মনে করি প্রত্যাবাসন। আমাদের সব পরিকল্পনাও এই প্রত্যাবাসন ঘিরে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই। তাই রোহিঙ্গা নিয়ে আমাদের সব কার্যক্রম প্রত্যাবাসনবান্ধব করেছি। আন্তর্জাতিক মহল, এনজিওসহ ক্যাম্পকেন্দ্রিক কার্যক্রম প্রত্যাবাসন উপযোগী করে সাজানো হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গারাও স্বদেশে ফিরতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। আশা করছি, এই প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখবে।’
ঢাকা বিজনেস/এনই