বর্ষার আবহাওয়া ভীষণ ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে শহরে। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত মন চায় সবুজ আর নীলের সমারোহ। সবকিছু যেন অসহ্য হয়ে উঠতে শুরু করে। ভ্যাপসা গরম অথবা বৃষ্টির স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। এমন মুহূর্তে চলে যান পাহাড়ে। পাহাড়কে কে না ভালোবাসে! ভিড়ভাট্টা নেই, কোলাহল নেই, সবচেয়ে বড় কথা ব্যস্ততা এড়িয়ে প্রকৃতির কোলে কাটাতে পারবেন কিছুদিন। তাহলে কোন পাহাড়ে যাবেন? চলে যান কাঞ্চনজঙ্ঘায়। তিন পাহাড়ের কোলে কাটিয়ে আসুন ক’টি দিন। সাহিত্যপ্রেমী হলে হয়তো মিলিয়ে নেবেন কাকাবাবু নাহয় সমরেশ মজুমদারের গল্প। এখানে একাকী নিস্তব্ধতা যেন প্রকৃতির গায়ে আবাসন গেঁড়েছে। বিষণ্ন মনে শীতল আদর নামাতে তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার বিকল্প নেই।
অর্থাৎ দার্জিলিংকেই এবার বেছে নিতে হবে আপনার ক্লান্তি দূর করার জন্যে। দার্জিলিংয়ে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে উপভোগ করার নানা জায়গা আছে। সেক্ষেত্রে তিনপাশে পর্বঘেরা টিনচুলে বা তিনচুল গ্রামটি ঘুরে আসতে পারেন সহজেই। টিনচুল গ্রামে গেলেই মনে হবে প্রকৃতির গায়ে ওড়নার মতো নিজেকে জড়িয়ে রাখবেন। মনের গহীনে থাকা সুপ্ত আবেগ যা কি না, প্রচণ্ড ক্লান্তিতে লুকিয়ে ছিল তা জেগে উঠবে এখানেই। যে স্নিগ্ধতার খোঁজ করছেন তা হয়তো তিনচুলেই পেয়ে যাবেন। পাখির কুজন, ঝিঁঝির ডাক মনের অন্তরালে মেশাতে হলে চলে যান শিলিগুড়ি। সেখান থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে এগোতে হবে তিনচুলের দিকে।
আসছে সেপ্টেম্বরের দিকেই টিনচুল যাত্রার শ্রেষ্ঠ সময়। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ি রাস্তার বাঁক তো প্রস্তুতিমাত্র। সেই শান্ত আঁকাবাঁকা পথে হয়তো এক অনাবৃত সুখে হারিয়ে যাবেন ক্ষণিকের জন্যে। একটু চারপাশে নজর ফেরান, পাহাড়, জঙ্গল, সবুজ নদী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আপনাকে। চড়াই-উতরাই পার হয়ে টিনচুলে যেতে অবশ্য দুপুর হয়ে যেতে পারে। এখানে পর্যাপ্ত রিসোর্ট আছে। থাকা নিয়ে খুব একটা কষ্ট হবে না।
বারবার তো টিনচুলের কথা বললাম। এটি দার্জিলিংয়ের পাহাড়বেষ্টিত গ্রাম। ১৯৯০ সালে ইকো পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয় ও ক্রমশ এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। সেজন্যেই আশেপাশে হোমস্টে, লজ ও বিভিন্ন সুন্দরী রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। টিনচুল নামটির অর্থ তিন চুল্লি। কারণ এর চারপাশে তিনটি পাহাড় যেন বৃহদাকার চুল্লির মতোই অবস্থান করছে। আপাতত ছোট এক পাহাড়ি জনপদ। দ্রুত হয়ে যায় দার্জিলিংয়ের গভীর গোপন ইকোফ্রেন্ডলি পর্যটন কেন্দ্র। তবে কৃত্রিমতা এখানে ভারী হয়নি। সারি সারি পাইন ও ওকে গাছের বিস্তার আপনার চোখের একঘেয়েমির ছানি তুলে দেবে নিমেষেই। চারপাশে কোনো ট্র্যাফিক জ্যাম নেই।
সমতল থেকে ৫ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু হলেও জায়গাটি দার্জিলিং থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে। এমন শান্ত জায়গায় পাইন ও ওকে বনের ভেতর হাঁটতেই হবে। এখানে পাবেন চা-বাগান, কমলা বাগান। জঙ্গল দিয়ে হাঁটার সময় তিস্তার টলটলে জল দেখে অবাক হতে বাধ্য আপনি। সেখানে কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে পাখির খোঁজে আকাশে তাকান। এখানে নীরবতা থাকলেও একঘেয়েমি নেই। মঠ, সানরাইজ পয়েন্ট, দুরপিনদারা, তিস্তা নদী, রঙ্গিত নদী, গম্ফুদারা ভিউ পয়েন্ট সবই আছে। আকাশের বুক চিরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা আর নতুন করে কী বলবো। কেভপয়েন্টে যাবেন। মনে হবে সূর্যের আলো এখানে যেন মুখ ভার করে আছে। তবে অপরূপভাবে সাজানো পাথরের সারি দেখে মুগ্ধ হবেন অনেকেই।
টিনচুলে ভিউপয়েন্টগুলোর বৈচিত্র্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। কিন্তু এখানে এলে অন্তত মনাস্ট্রিটা ঘুরে যেতেই হবে। শান্তি ও বাতাবরণে ঘেরা বিশাল জায়গাজুড়ে মনাস্ট্রি। দুরপিন্দারা ভ্যালিটিও ঘুরতে হবে। হাইকিং-এর অভ্যাস যাদের নেই তারাও এখানে এসে কিছুটা অভ্যাস ঝালিয়ে নিতে পারবেন বিরক্তি ছাড়া। যাদের আবার রক ক্লাইম্বিং-এর শখ তারা তো টপাটপ পাহাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছেন। তা দেখে বরং আপনার মনে কেন আতঙ্কের সঞ্চার হবে সে প্রশ্নটা রাখতেই হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে এখানকার গম্ফুদারা রকগুলিই ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার মূল কেন্দ্রস্থল।
এখানেই তো ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিতো। এখানকার যেকোনো পাহাড় থেকেই হিমালয় দেখা যায়। সেইসঙ্গে সকালের অদ্ভুত সূর্যোদয়। নিবিড় সবুজের কোলে এক অনবদ্য স্থান টিনচুল। রিসোর্ট বা হোমস্টে যেখানেই ঠাঁই গড়ে নিন না কেন, বাইরে ঘুরে আসার জন্যে মন আনচান করবেই। ঘোরাঘুরির জন্যে যারা হৃদয়ের খোরাক খুঁজছেন, তারা চলে আসুন টিনচুল। তিন পাহাড়ের কোলে শান্ত গ্রামটি স্বাগত জানাচ্ছে আপনাকে।