বাড়িতে সংবাদপত্র পড়ার চল ছিল। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি, বাড়িতে নানারকম সংবাদপত্র রাখা হতো। স্কুলের ছুটিতে যখন নানাবাড়িতে যেতাম, সেখানেও দেখতাম একগাদা পত্র-পত্রিকা। হরেক রকমের, নানা কিসিমের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন মামা। তারাও ছুটতে বাড়ি আসার সময় দেশি-বিদেশি নানান ধরনের পত্র-পত্রিকা আনতেন। দৈনিক পত্রিকার বাইরে, তখন বাড়িতে দেখেছি রহস্য পত্রিকা, বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা, মহাকাশ বিষয়ক পত্রিকা, কার্টুন পত্রিকা উন্মাদ, এছাড়া অহরহ নামের একটি বিজ্ঞান পত্রিকারও তখন ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম।
একটু বড় হতেই, এসব পত্র-পত্রিকার হাত ধরে ঢুকে পড়ি সংবাদপত্রের অন্য এক জগতে। এর আগে, দৈনিকের পাতায় শুধু সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনগুলোর বিষয়ে আগ্রহ ছিল আমার। সেসব পোস্টার কেটে কেটে আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে জমাতাম। সেই অধ্যায় পেরিয়ে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়লাম সম্পাদকীয় পাতায়। নামে-বেনামে প্রকাশ পাওয়া নানা বিষয়ে কলাম পড়তে পড়তে তৈরি হয় সাংবাদিকতা বিষয়ে কৌতূহল। আগ্রহ জমতে ও বাড়তে থাকে সংবাদপত্র বিষয়ে। সেই সময়ে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশ, আমাকে আরও বেশি মোহগ্রস্ত করে। সেই মোহে আজও ছুটে চলেছি।
ঢাকা শহর আজব শহর। এই শহরে নানা কাজে, নানা অছিলায়, জীবনের উত্থান-পতনের সিঁড়ি খুঁজতে আমরা ছুটে আসি। মফস্বল শহর থেকে আমিও এসেছি স্বপ্ন বেঁধে, সাংবাদিক হবো। আমরা যারা তখন লেখালেখিতে হাত মকশো করেছি, আমাদের চোখে রাজধানী তখন বুনে দিয়েছে এক মায়াবী স্বপ্ন। লেখক হতে হলে, কবি যশ চাইলে তোমাকে রাজধানীতে আসতেই হবে, এরকম ধারনা কেনো এবং কী দেখে যে আমরা চোখে ও মনে ঝুলিয়েছিলাম, আজ মনে নেই। আমার বন্ধুরা যারা সঙ্গে এসেছে, আবার যারা একটু আগে বা পরে এসেছে সবাই প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি লেখক-কবি হওয়ার স্বপ্নটিকে আঁকড়ে ধরেছি।
আমিও এসেছি, তবে লেখালেখিকে প্রাণে ধরলেও স্পন্দন হিসেবে চেয়েছি সাংবাদিকতা। ভেবেছি সাংবাদিক হবো। সাংবাদিক হবার আগ্রহ ও স্বপ্ন যাদের সামনে রেখে, তাদের একজন তোয়াব খান।
আমি যখন মাধ্যমিকের সিঁড়ি টপকাই, তার অল্প পরেই, বাজারে আসে দৈনিক জনকণ্ঠ। প্রকাশ পায় ঢাকাসহ দেশের পাঁচটি জায়গা থেকে। সে এক এলাহীকাণ্ড। তার ঝা চকচকে রূপ চোখ ঝলসে দেয়। সেই চোখ ঝলসানো রূপের মোহে, একসময় আনুষ্ঠানিক পড়ালেখার পাঠ শেষে ঢুকে পড়ি আজব শহরে। ঘুরতে ঘুরতে, নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সংবাদপত্রের জগতে প্রবেশাধিকার জোটে। একসময় সেই স্বপ্নের জনকণ্ঠেও। উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান, আমার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা ২০০৮ সালে। সেই দেখার পর থেকে সৌভাগ্য হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর সঙ্গে থেকে কাজ করার। যদিও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়ের। তবে তার সবই আজ স্মৃতি।
দেখা হওয়ার বছরে, দৈনিকটির ঈদম্যাগাজিন প্রকাশের দায়িত্ব পাই। কাগজটিতে তখনো আমার চাকরি হয়নি। প্রদায়ক হিসেবে আমার দায়িত্ব ম্যাগাজিনটি প্রকাশের। অস্থির এক সময়। নানা বাধা-বিপত্তি, সহযোগিতা-অসহযোগিতাকে সঙ্গী করে নির্ধারিত সময়েই শেষ করি ঈদম্যাগাজিনের কাজ। যথাসময়ে বাজারেও আসে। পত্রিকা হাতে নেওয়ার পর দেখি, সূচিপত্রে একটি বড় ভুল রয়ে গেছে। আরও অনেকের চোখেও ধরা পড়ে ভুলটি। একজন লেখকের নাম ছাপা হয়েছে দু’বার। শুভার্থীরা আফসোস করেন, চাকরি স্থায়ী হবে না ভেবে। তোয়াব ভাই রেগে যাবেন, ভেবে আমিও ভয় পাই।
আমার আগেই তিনি পত্রিকা দেখেছেন। ছাপা-বাঁধাই শেষ। সংশোধনেরও সুযোগ নেই। কী আর করা, অস্থির মন নিয়ে অপেক্ষা করি। সন্ধ্যায় তিনি অফিসে আসার কিছুক্ষণ পরেই তার ব্যক্তিগত সহকারী এসে জানান, তিনি আমাকে ডেকেছেন। দুরুদুরু বুকে কাঁচের ভারী দরজা ঠেলে রুমে ঢুকি। শান্ত গলাতেই তিনি বলেন, ‘অ্যাই, সূচির ভুলটা দেখেছ?’ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি। তিনি বলেন, ‘একা কাজ করেছ, এজন্য শেষ মুহূর্তে ভুলটা রয়ে গেছে। এরপর যেখানেই যে কাজ করবে, বারবার চেক করবে।’ ঠিক আছে ভাই, বলে বেরিয়ে আসি।
তখন একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচন এগিয়ে আসছে। একটি বিপর্যস্ত সময় পার করছে তখন পত্রিকাটি। আমার চাকরি স্থায়ী হয় না। মাঝে পেরিয়ে যায় বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময়। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পত্রিকাটিতেও পরিবর্তন আসে। নিভু নিভু হয়ে থাকা ফিচার সেকশন আবার নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। নতুন, তরুণদের একটি দলের সঙ্গে আমিও যোগ দেই সম্পাদকীয় বিভাগে। যোগ দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই, বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে যুক্ত হয়-সাময়িকী পাতা। তা হঠাৎ করেই। কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই শুক্রবারের সাময়িকী সম্পাদনার দায়িত্ব পাই।
তোয়াব খান
প্রথম সপ্তাহের পাতাটি প্রকাশের উপযোগী করতে সময় পেয়েছিলাম দুদিনেরও কম। পুরনো ফাইল যা আছে, তা দিয়ে পাতা করায় বারণ। নতুন ম্যাটার দিয়ে সাজাতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে সাময়িকীর কাভার স্টোরি তাৎক্ষণিক লিখে দেয় এক বন্ধু। তাড়াহুড়োয় লেখাটি পড়ে দেখার সুযোগ থাকে না। কারণ, প্রুফ-মেকাপ-পেস্টিংয়ের জন্য যে সময় বরাদ্দ, সঙ্গে আরও দুটি পাতার ম্যাটার সংগ্রহ, মেকাপ এবং যথাসময়ে ট্রেসিং ছাড়ার বাড়তি চাপ আমাকে ভুলিয়ে দেয় মূল গদ্যটি পড়ার বিষয়ে। আমার দেখা ছাড়াই প্রকাশিত হয়ে যায় পাতাটি। শুক্রবার, তোয়াব ভাই সকালে অফিসে আসতেন না। একবারে বিকেলে, সন্ধ্যার আগে আগে আসতেন। দুপুরে খাবার খেতে অফিসের বাইরে গিয়েছি। ফেরার পরেই, তোয়াব ভাইয়ের সহকারী এসে জানান, আমি যেন তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা না করে অফিস না ছাড়ি।
কী ঘটনা? কী ভুল করলাম? প্রকাশিত পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। সারা দুপুর চাপা অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করি। সন্ধ্যার মুখে তোয়ার ভাই আসেন। আমার ডাক পড়ে। রুমে ঢুকতেই, টেবিলের ওপর সাময়িকীর পাতাটি মেলে ধরেন। দেখি প্রচ্ছদ গদ্যের নানা জায়গায় লাল কালি দিয়ে দাগানো। আমি টেবিলের উল্টো পাশে। ইশারায় পাশে ডাকেন। পাশে গেলে বলেন, লেখাটি পড়েছ? ‘না’ সূচক জবাব দেই। আমাকে অবাক করে না রেগে, বকা না দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘এরপর কখনো কোনো ফাইল না পড়ে ছাপতে দেবে না। দেরি হোক, কিছু সময় হয়তো পিছিয়েও যেতে পারে প্রকাশনা, যে যতই তাড়া দিক, এরপর আর কখনো কোনো ফাইল না পড়ে ছাড়বে না। যেখানেই কাজ করো, কথাটি মনে রেখো।’ মাথা নাড়ি। এরপর তিনি লাল কালিতে দাগানো শব্দ এবং বাক্যগুলো আমাকে পড়তে বলেন। পড়া হলে বলেন, ভুলগুলো কী এবং কোথায় বুঝেছ? এবারও মাথা নাড়ি। তিনি বলেন, ‘যদি পড়ে দিতে, তাহলে এ ভুলগুলো হতো না। তুমি হলে তোমার দায়িত্বের শেষ চেকপোস্ট। সব হাত ঘুরে আসার পর, ট্রেসিং ছাড়ার আগেও চোখ বোলাবে।’ আমি এবারও মাথা নাড়ি, নিজের কাজে চলে আসি।
সংবাদপত্র প্রতিদিনই শেখার জায়গা। প্রতিদিনই নতুন নতুন শিক্ষা। এ শিক্ষার শেষ নেই। যখনই নিজেকে শেখার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মনে হবে, তখনই নিজের পতনের শব্দ শোনা যাবে, এ শিক্ষাও তোয়াব ভাইয়ের কাছে পাওয়া। তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে কাজের সুবাদে শিখেছি অনেক। নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। অভিভাবক হিসেবে বকাও দিয়েছেন। কিন্তু সেই বকার মধ্যেও যে স্নেহ মিশে ছিল, তা সবসময়ই টের পেয়েছি। প্রায় পাঁচ বছর তার সঙ্গে কাজ করার সময়ে, দু-বার দু’জন বয়োজ্যষ্ঠ কবি তোয়াব ভাইয়ের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাদের দুজনের কারও লেখাই তখন আমাদের পাতায় থাকতো না। (তবে তা আমার সিদ্ধান্তে নয়)। সেই ক্ষোভ থেকে একজন সরাসরি আমার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আর অন্যজন টেলিফোনে। লিখিত অভিযোগটি পেয়ে তোয়াব ভাই আমাকে ডেকে চিঠিটি পড়তে দেন। আমার পড়া শেষ হলে চিঠিটি ফিরিয়ে দেই তার হাতে। আমাকে তিনি কিছুই বলেননি। কারণ, সেই বয়োজ্যেষ্ঠ’র লেখা না ছাপানোর কারণটি তার জানা ছিল। আর টেলিফোনে যিনি অভিযোগ করেছিলেন, তার লেখা না ছাপানোর কারণটিও তার জানা ছিল। তবে এবারে বলেন, ‘দুই চার মাসে একটি লেখা দিও। সিনিয়র লেখক।’
তোয়াব ভাইয়ের প্রশ্রয়েই পেয়েছিলাম কাজের স্বাধীনতা। তার প্রশ্রয়, ভালোবাসা ও আশীর্বাদের হাত মাথায় ছিল বলেই, মাত্র আড়াই বছরের মাথায় পদোন্নতি পেয়েছি। সংবাদপত্রে পদোন্নতি যখন অনেক প্রতিষ্ঠানেই প্রায় বিরল ঘটনা হয়ে উঠছে, তখন তার আশীর্বাদেই সহকারী সম্পাদক পদে উন্নীত হই। এও তো প্রশ্রয়, ভালোবাসা।
তখনো চিঠি যুগ শেষ হয়নি। ডাকে আসতো প্রচুর লেখা। সেসব লেখা পড়ে, ভালোলাগা লেখাগুলো প্রকাশের চেষ্টা করতাম। চিঠির খাম খুলে খুলে পড়তে দেখে, একদিন রুমে ডাকেন। এই স্বভাবের প্রশংসা করে বলেন, ‘চিঠি বা মেইল যাই আসুক, সবই পড়বে। একসময় চোখ বোলালেই বুঝতে পারবে কোনটি ছাপার যোগ্য আর কোনটি নয়। চেয়ে নেওয়া লেখার বাইরে চিঠি বা মেইলে আসা লেখা প্রকাশ পেলে, পত্রিকার প্রতি সেই লেখকদের ভালোবাসা তৈরি হয়। তারা সেরা লেখাটিই তখন পাঠায়।’ সঙ্গে এও বললেন, ‘আমাদের মেয়েরা এখনো নানাক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে, তাদের সুযোগ দিতে হবে। ডাকে আসা মেয়েদের লেখাগুলো যদি সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তা করে হলেও রাখার চেষ্টা করবে। এতে অন্যরা উৎসাহ পাবে।’
পাঁচ বছর কম সময় নয়। অনেক স্মৃতি। অনেক কিছুই হুড়মুড়িয়ে মনে আসছে। মনে পড়ছে তার দেওয়া অনেক পরামর্শ। যখন বিদায় নিয়ে নতুন কাগজে কাজের জন্য যাচ্ছি, সেই শেষ দেখা। এরপর আর সরাসরি দেখা হয়নি। সেদিনের বিদায়ই ছিল শেষ বিদায়। সেই বিদায়ে স্নেহবৎসল একজন অভিভাবকের হাসিমুখ, কিছু উপদেশ; আমাকে আজো জাগিয়ে রাখে। সংবাদপত্র জগতের মহীরুহ তোয়াব খান। চলে গেলেন, ৮৭ বছর বয়সে। তার এই যাওয়ার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি হলো আমাদের সংবাদপত্রের ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের। ১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক জনতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরুর পর কাজ করেছেন বিভিন্ন কাগজে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, পালন করেছেন প্রশাসনিক দায়িত্বও। কিন্তু সবকিছুর পর তিনি সাংবাদিক। আমাদের সংবাদপত্র জগতে পরিবর্তনের পক্ষের অকৃত্রিম বন্ধু।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক