আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতার জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা আরও বলছেন, প্রচার-প্রচারণার অভাবসহ বিভিন্ন কড়াকড়ি নীতি আরোপের কারণেও সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি; এই সাত মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছে ৩ হাজার ৬৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর গত (২০২১-২২) অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ১৭৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ৯ হাজার ১০৬ কোটি ২৩ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি সরকার ৫ লাখ টাকার ওপরে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম করেছে। অধিকাংশ মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল সম্পর্কে সচেতন নয়। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয়ও কাজ করে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাধারণ মানুষের অর্থ বিনিয়োগের সবচেয়ে ঝুঁকিমুক্ত খাত হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকলেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এই খাতে জনগণ যেন সহজেই বিনিয়োগ করতে পারে, সেজন্য সরকারকে বিশেষ সুবিধা দিতে হবে।
রাজধানীর উত্তরায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মুহাম্মদ মারুফ বিন ওয়ালী। তিনি ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘সরকার সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের সুযোগ করে দিচ্ছে। আমাদের মতো নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ কষ্টের টাকা এখানে বিনিয়োগ করে। সরকার এর বিপরীতে মুনাফা দেয়। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের জন্যও এই খাত অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
মারুফ বলেন, ‘সাধারণ মানুষ যেন এই খাতে বিনিয়োগে আরও বেশি আকৃষ্ট হয়, সেজন্য বিনিয়োগ পলিসিগুলো সহজ করতে হবে। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, আয়কর রিটার্ন দাখিল সহজ। ভয়ের কিছু নেই। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ব্যাপারে নিয়ম শিথিল করতে হবে।’
তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ.বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আর এর বিক্রির পরিমাণ কমার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, এ খাতে বিনিয়োগে টিআইএন সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন কাগজপত্র সাবমিট করতে বলা হয়। পাশাপাশি ইনফ্লেশন বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে মানুষ আপাতত সঞ্চয়পত্র কম কিনছে। তবে এই অবস্থা থাকবে না। শিগগিরই সঞ্চয়পত্র বিক্রি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার সঞ্চয়পত্রে যে সুদ দেয়; তা ব্যাংকের ডিপোজিটের চেয়ে বেশি। তাই এর বিক্রি বাড়াতে নতুন করে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।’
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ কমাতে অর্থনীতিতে খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, ‘পেনশনভোগী ও ছোট ছোট উদ্যোক্তরা সাধারণত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকে। সরকার এখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সুবিধা পেয়ে থাকে। যদিও এই খাতে সরকারের খরচ বেশি। কারণ সরকার তো জনগণের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নিচ্ছে। সেই ঋণ তো সরকারকে পরিশোধ করতে হয়। তারপরও সরকার এই খাতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। কারণ এই ঋণ নিয়ে সরকার বাজেট ঘাটতিসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা হয়।’
আতিউর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের ওপর যেন অতিরিক্ত প্রভাব না পড়ে, সেজন্য এই খাতকে সরকার উৎসাহ দেয়। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে স্বল্প সময়ের জন্য একটু সমস্যা হয়েছে। এই সমস্যা বেশি দিন থাকবে না। টিআইএন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য চাওয়ার কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। যাদের টিআইএন নম্বর নেই, আয়কর রিটার্ন দাখিল বোঝে না, তাদের বোঝাতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটার প্রভাব অর্থনীতিতে তেমন পড়বে না। কারণ এই সমস্যা সাময়িক।’
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ব্যুরো ও পরিসংখ্যান) নাজমা আক্তার বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কিছুটা কমেছে। এর মূল কারণ, সাধারণ মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল সম্পর্কে সচেতন নয়। অনেকে ২০ লাখ, ৩০ লাখ টাকা আমাদের কাছ নিয়ে আসে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য। কিন্তু আয়কর রিটার্ন দাখিলের রশিদ দেখাতে পারে না। তখন সঞ্চয়পত্রও কিনতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে যে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা করেছে সরকার, সেটি খারাপ কিছু না। খুব সহজ একটি বিষয়। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে। তাদের মাঝে এই ব্যাপারে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। যারা শিক্ষিত তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলে খুব একট সমস্যা হচ্ছে না। সমস্যা হচ্ছে যারা কম শিক্ষিত, অসেচেতন; বিশেষ করে যারা গ্রামে বাস করে,তাদের। এখন তাদের বোঝাতে হবে।’
নাজমা আক্তার বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যদি আমাদের সঙ্গে এক হয়ে প্রচার-প্রচারণা চালায়, তবে ভালো হবে। আর জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেক নমনীয় হতে হবে। সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনতে এলে তাদের সর্বাত্বক সহযোগিতা করতে হবে।’
ঢাকা বিজনেস/এনই/