২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার



নয় বছরে ১০ কোটি ১২ লাখ টাকার সিমেন উৎপাদন

ফেরদৌস সিদ্দিকী, রাজশাহী || ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ০৯:০২ এএম
নয় বছরে ১০ কোটি ১২ লাখ টাকার সিমেন উৎপাদন


প্রতিষ্ঠার নয় বছরে ৩৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯০ স্ট্র উৎপাদন করেছে রাজশাহীর আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগার। এর আর্থিক মূল্য ১০ কোটি ১২ লাখ ৭ হাজার ৭০০ টাকা। স্বল্প সময়ে রাজশাহী থেকে বিভাগের ৬ জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে হিমায়িত সিমেন। এতে সময় ও খরচ বাঁচছে সরকারের। আর স্বল্প সময়ের মধ্যে মানসম্মত সিমেন পাচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সিমেন দেশে গরুর ভালো জাত উদ্ভাবনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সরকারের রাজস্বও বাঁচাচ্ছে।

জানা গেছে, আগে সাভারের কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগার থেকে সিমেন সরবরাহ হতো রাজশাহী অঞ্চলে। ২০১৪ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাট এলাকায় গড়ে ওঠে আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র। লক্ষ্য ছিল উত্তরাঞ্চলজুড়ে সহজে প্রান্তিক পর্যায়ে মানসম্মত সিমেন পৌঁছানো।

কিন্তু বর্তমানে আঞ্চলিক গবেষণাগার থেকে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা এবং সিরাজগঞ্জ জেলায় হিমায়িত সিমেন সরবরাহ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার মতো বৈশ্বিক সংকট না এলে এত দিনে পুরো উত্তরাঞ্চলে সিমেন সরবরাহ হতো দেশের দ্বিতীয় এই কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগার থেকে। 

১০ একর আয়তনের খামারে রয়েছে অত্যাধুনিক হিমায়িত সিমেন ল্যাব। রয়েছে আলাদা ব্রিডিং বুল শেড, বুল কাফ শেড ও সিমেন কালেকশন শেড। সাড়ে ৩ একর জায়গাজুড়ে ঘাষ চাষও হচ্ছে এখানে। সরেজমিনে গবেষণাগারের বিভিন্ন শেড ঘুরে দেখা গেছে, হৃষ্টপুষ্ট বিভিন্ন প্রজাতির ৪৪টি ষাঁড়। এর মধ্য সিমেন দিচ্ছে ৩৭টি। বাকি সাতটি ষাঁড় রয়েছে পরীক্ষা পর্যায়ে।

খোঁজ নিয়ে যানা যায়, গবেষণাগারে ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড় রয়েছে ২৮টি। এর সবই শংকর। প্রত্যেকটি ষাঁড় থেকেই সিমেন সংগ্রহ চলছে। শাহীওয়াল জাতের ১০টি ষাঁড় রয়েছে এখানে। এর মধ্যে একটি ষাঁড় শতভাগ বিশুদ্ধ। বাকি ৯টি শংকর জাতের। এগুলোর সবই সিমেন দিচ্ছে। আরও ৭টি শাহীওয়াল শংকর জাতের বুল কাফ রয়েছে। এগুলো রয়েছে পরীক্ষা পর্যায়ে।

সিমেন সংগ্রহ শুরুর আগে প্রত্যেকটি ষাঁড়কে ধাপে ধাপে নিবীড় পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগারের উপ-পরিচালক ডা. মো. গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘সাধারণত ১৩ মাস বয়সে ফ্রিজিয়ান শংকর এবং ১৮ মাস বয়সে শাহীওয়াল এঁড়ে বাছুর প্রজননের জন্য আলাদা করা হয়। দীর্ঘ পরিচর্যার পর ২২ থেকে ২৪ মাস বয়স থেকে শুরু হয় পরীক্ষা।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এই সময় প্রজনন ইচ্ছা, বীর্জের পরিমাণ ও গুণগত মান এবং শুক্রানুর পরিমাণ দেখা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ফ্রিজিয়ান শংকরের ৩০ থেকে ৩৬ মাস এবং শাহীওয়ালের ৩৬ থেকে ৪০ মাস বয়স থেকে সিমেন সংগ্রহ শুরু হয়।’ 

এদিকে, আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগারের পাশেই রাজশাহী দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামার। দেশের শাহীওয়াল গরুর জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে কাজ করছে এই খামার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৩ বছরে ১৬টি এঁড়ে বাছুর আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগারে পাঠিয়েছে রাজশাহী দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামার। 

রাজশাহী দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারের উপ-পরিচালক. ডা. আতিকুর রহমান বলেন, ‘২০১৮-১৯ অর্থ বছরে তারা ১৩টি এঁড়ে বাছুর সরবরাহ করেছেন কৃত্রিম পজনন গবেষণাগারে। পরের দুই অর্থ বছরে আরও ৮টি করে এঁড়ে বাছুর সরবরাহ করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ ষাঁড় থেকেই কেবল সিমেন সংগ্রহ হয়।’

তিনি বলেন, ‘শাহীওয়াল জাতের এঁড়ে বাছুরের বয়স ১৪ থেকে ১৮ মাস হলেই সুস্থ ও সবলগুলো প্রজনন খামারে পাঠানো হয়। ২২ মাস বয়য়ে শুরু হয় পরীক্ষা। ২৪ মাস বয়স হলেই সিমেন নেওয়া শুরু করা যায়। সক্ষমতা থাকলে টানা ৭ বছর ধরে সিমেন দিতে পারে শাহীওয়াল ষাঁড়। একটি ষাঁড় তার জীবদ্দশায় ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ১ লাখ ৯২ হাজার স্ট্র সিমেন উৎপাদন করতে পারে।’ 

এদিকে, আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ৬ হাজার ৪৮ স্ট্র সিমেন উৎপাদন হয় এখানে। ৩০ টাকা হারে যার আর্থিক মূল্য ১ লাখ ৮১ হাজার ৪৪০ টাকা। বছর ঘুরতেই সিমেন উৎপাদন পৌঁছায় ২ লাখ ৪৭ হাজার ৪৪২ স্ট্র-তে। যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪০ গুণ বেশি। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৭৪ লাখ ২৩ হাজার ২৬০ টাকার।

২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫ স্ট্র সিমেন উৎপাদন হয়, যার মূল্য ১ কোটি ১৯ লাখ ৪১ হাজার ৯৫০ টাকা। পরের বছর ১ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার ২০০ টাকার ৪ লাখ ৪ হাজার ৩৪০ স্ট্র সিমেন উৎপাদন হয়। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৪ লাখ ৮৭ হাজার ১৭৫ স্ট্র সিমেন উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য ১ কোটি ৪৬ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে সর্বোচ্চ ৬ লাখ ৭ হাজার ৪৪০ স্ট্র সিমেন উৎপাদন হয় এখানে। যার মূল্য ১ কোটি ৮২ লাখ ২৩ হাজার ২০০ টাকা।

২০২০-২১ অর্থবছরে সিমেন উৎপাদন কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৫ হাজার ৩২০ স্ট্র তে। ওই বছর খামারের আয়ও কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ২১ লাখ ৫৯ হাজার ৬০০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে কিছুটা বেড়ে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩২০ স্ট্র সিমেন উৎপাদন ছিল, যার মূল্য ১ কোটি ৪২ লাখ ৫৯ হাজার ৬০০ টাকা। সর্বশেষ চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ লাখ ৪২ হাজার ৪৪০ স্ট্র সিমেন উৎপাদন হয়েছে। যার মূল্য ১ কোটি ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০০ টাকা।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগারের উপ-পরিচালক ডা. মো. গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার প্রায় ৯ বছরে ৩৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯০ স্ট্র সিমেন উৎপাদন হয়েছে রাজশাহীর আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগারের। প্রতি স্ট্র ৩০ টাকা ধরে উৎপাদিত সিমেনের আর্থিক মূল্য ১০ কোটি ১২ লাখ ৭ হাজার ৭০০ টাকা। এটি খামারের পরোক্ষ আয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণাগারের ষাঁড়গুলো উন্নত জাতের। এখানকার যন্ত্রাংশ অত্যাধুনিক। এছাড়া কর্মরত জনবলও দক্ষ। ফলে গবেষণাগারে উৎপাদিত সিমেন অন্যান্য বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত সিমেনের চেয়ে মানসম্মত। দীর্ঘদিন ধরেই নির্ধারিত কেন্দ্রে ৩০ টাকা প্রতি স্ট্র সিমেন পাচ্ছেন খামারিরা। যেখানে বেসরকারী পর্যায়ে উৎপাদিত সিমেনের মূল্য জাত ভেদে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। আঞ্চলিক কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র সেই হিসেবে প্রান্তিক খামারিদের খরচ কমাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশে গরুর ভালো জাত উদ্ভাবনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সরকারের রাজস্বও বাঁচাচ্ছে।’

ঢাকা বিজনেস/এইচ



আরো পড়ুন