শিল্প-সাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। গত শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানস্থ অমর একুশে বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বরে এই মোড়ক উন্মোচন করা হয়ে।
এদিন বিকাল সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠিত ‘সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কবি ও কবিতা সংখ্যা’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন— কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কবি মজিদ মাহমুদ, কবি তপন বাগচী, কবি জেবুননেসা হেলেন ও কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার।
স্বাগত বক্তব্যে অনুপ্রাণন সম্পাদক ও প্রকাশক আবু এম ইউসুফ ব্যাখ্যা করেন অনুপ্রাণন ত্রৈমাসিকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সম্পাদক বলেন, ‘এর আগে আমরা প্রকাশ করেছিলাম বাংলাদেশের কবি ও কবিতা সংখ্যা। সেখানে ছিলেন ১০০ জন নির্বাচিত কবি। তাদের জন্ম-সাল ছিল ১৮৯৭ থেকে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ। কিছুটা বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্বে আমরা প্রকাশ করেছি সাম্প্রতিকের কবি ও কবিতা সংখ্যা। এখানেও স্থান পেয়েছেন সাম্প্রতিকের ১০০ জন কবি। এই কবিদের জন্ম-সাল ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৫। বিগত কাজেরই পরম্পরা এটা। মূল বিষয় হচ্ছে, এভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে থাকা সাহিত্যের সম্পদ একত্রে জড়ো করে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া গ্রহণ করলে দেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যের বিশালত্ব আমরা উপলব্ধি করতে পারি।’
প্রকাশিত সংখ্যাগুলোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে আবু এম ইউসুফ আরও বলেন, ‘প্রথমে চার পর্বে সমাপ্ত হয়েছিল ১০০ জন কবির উপরে আয়োজন যারা বাংলাদেশের কবিতা সাহিত্যের ভিত্তি গড়েছেন। এবারের চারটি পর্বে যুক্ত হয়েছেন সাম্প্রতিকের কবিরা যারা পূর্বজদের সমৃদ্ধ ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র নির্মাণ করেছেন। এই কাজের মাধ্যমে আমরা চেয়েছি ভবিষ্যতের জন্য একটা দলিল রাখতে। এই সময়ে কারা অগ্রসর কবি ছিলেন, তাদের যেন আগামীর গবেষকরা সহজে সনাক্ত করতে পারেন।’
’বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কবি মজিদ মাহমুদ দশকওয়ারি সাহিত্য বিবেচনার বিপরীতে কবিদের জন্মসাল ধরে অন্তর্ভুক্তির ভুঁয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘এটা সময়ের চাহিদা পূরণ করেছে। অনুপ্রাণনের কার্যক্রম চলমান থাকুক। লেখক ও সমালোচকদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টি হলে আমাদেরই লাভ। সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারা বিকশিত হবে এসবের মাধ্যমে।’
বিশেষ অতিথি কবি তপন বাগচী বলেন, ‘বর্তমানে নিয়মিত সাহিত্য ম্যাগাজিন বলতে গেলে নেই-ই। এই শূন্যতায় যথাযথ ভূমিকা রাখছে অনুপ্রাণন। ম্যাগাজিন অনালোকিত দিকগুলোতে আলোকপাত করছে, বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা করছে ধারাবাহিকভাবে— এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিষয়বৈচিত্র্যের সংযোগ, একঘেয়েমি-মুক্ত থাকতে পারা, গতানুগতিকতার বাইরে অন্যকিছু করতে পারলে সম্পাদকদের এগিয়ে চলার প্রেরণা অক্ষুণ্ন রাখা যায়। এমন ক্ষেত্রে তারা হতোদ্যম হন না, অনেক তো হলো এমনটা ভেবে হালও ছেড়ে দেন না।’
বিশেষ অতিথি কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, ‘পর্যাপ্ত টাকা অনেকেরই আছে। তাই বলে তারা কোনো সাহিত্য বা লিটল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এগিয়ে আসেন না। না কোনো ব্যক্তি, না কোনো প্রতিষ্ঠান। অনুপ্রাণন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, ব্যয়বহুল কাজটা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু চেনা মুখ নয়, জনপ্রিয় কবিও নয়— জীবন-জীবিকার তাগিদে যারা গ্রামে চলে গেছেন, মফস্বলবাসী হতে বাধ্য হয়েছেন এমন কবিদেরও গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছে অনুপ্রাণন। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় দিক। শামীম সিদ্দিকী, ফিরোজ আহমেদ, গোলাম মোরশেদ চন্দন এমন নামগুলো চোখের সামনে দেখলে আমাদের স্মৃতি ঝালাইয়ের কাজটাও হয়ে যায়।’
ম্যাগাজিনের গেটআপ-মেকআপে আরও নান্দনিকতা ও বৈচিত্র্য আনার পরামর্শও দেন আহমেদ স্বপন মাহমুদ।
বিশেষ অতিথি কবি জেবুননেসা হেলেন অনুপ্রাণনের সঙ্গে তার ‘আজন্ম-বন্ধন সম্পর্ক’ উল্লেখ করে বলেন, ‘অনুপ্রাণনের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালে, ক্ষীণ কলেবরে। প্রথম সংখ্যায় আমার একটা বইয়ের আলোচনা ছাপা হয়েছিল, লিখেছিলেন সুরাইয়া হেনা। আর এখন অনুপ্রাণনের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে, বাড়ছে ব্যাপ্তি ও পরিধি। নির্বাচিত ১০০ কবির মধ্যে আমাকে স্থান দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ধন্যবাদ জানাই সম্পাদক আবু এম ইউসুফকে। আমার কবিতা নিয়ে লিখেছেন আনোয়ার রশীদ সাগর। যদিও সেই অর্থে তাকে আমি চিনি না, কখনো দেখা হয়নি। এখানেই অনুপ্রাণন ব্যতিক্রম ও অনন্য। উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে।’
দ্বিমাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন নব ভাবনার নির্বাহী সম্পাদক ইমরুল কায়েস অনুপ্রাণন যুগের চাহিদা মেটাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘দেশে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাংলা বিভাগ রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সাহিত্য গবেষণায় আরও এগিয়ে আসতে পারে, নিবিড়তা বাড়ানো জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ করতে পারে উল্লেখ্যযোগ্য বইয়ের পাশাপাশি সাহিত্য ও লিটল ম্যাগাজিনগুলো।’
কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার বলেন, ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক মীজানুর রহমান, রূপম ও কিছুধ্বনি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক আন্ওয়ার আহমদকে স্মরণ করছি এখন। এরা দুজনই তুখোড় সম্পাদক। হয়ে উঠেছিলেন অনেক লেখকের আশ্রয় ও দিশা। অসাধারণ সব কাজ করে গেছেন তারা। ব্যতিক্রমধর্মী সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে মীজানুর রহমানের পক্ষী সংখ্যা, নদী সংখ্যা, গণিত সংখ্যা, বৃক্ষ সংখ্যার মতো ঢাউস কাজ আমাদের বাংলাদেশে আর হয়নি। সৌভাগ্যক্রমে আমি এই দুজন সম্পাদকেরই স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি।’
অনুপ্রাণনের উদ্যোগ ও তৎপরতার প্রশংসা করে মনি হায়দার আরও বলেন, ‘সন্ধ্যা পেরিয়েছে, আমাদের মাথার উপরে চাঁদ উঠেছে। এই চাঁদনি রাতে দুজন সম্পাদকের স্মৃতিচারণ করলাম। ভবিষ্যতেও কোনো এক চাঁদনি রাতে সম্পাদক আবু এম ইউসুফের কথাও আলোচনা করব আমরা। তবে চিরদিন তো আমরা থাকব না, আমাদের মৃত্যুর পর ভবিষ্যতের প্রজন্ম আলোচনা অব্যাহত রাখবে। দিব্যদৃষ্টিতে তেমন চিত্রই দেখতে পাচ্ছি।’
অনাড়ম্বর এই অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন— লেখক নজমল হক খান, মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ ও রুশ্নি আরা।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন— মামুন মুস্তাফা, সৈয়দ নূরুল আলম, জয়দুল হোসেন, বাদল চৌধুরী, রুকসানা রহমান, মুহসীন মোসাদ্দেক, শেলী সেলিনা, সদ্য সমুজ্জ্বল, শফিক হাসান, সাদমান সজীব, শাহীন আলম শেখ প্রমুখ।
লেখক মনি হায়দারের কথার সূত্র ধরে অনুষ্ঠানের শেষে আরও ভালোভাবে অবারিত আকাশে, চাঁদের দিকে তাকিয়েছিলেন কেউ কেউ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাতিদীর্ঘ গাছগুলোর ফাঁক গলে ধূলির ধরায় নেমে এসেছে জোছনাঢালা অধ্যায়— নেমেছিল চাঁদের আলোর নীরব বন্যা! সাংস্কৃতিক বাতাবরণে এই আলো আমাদের পরিশুদ্ধ করে, উদ্বুদ্ধ করে সৃজনপ্রয়াসে, সৎ সাহিত্য নির্মাণে। জীবনের আরও গভীরে প্রবিষ্ট হতে প্রেরণা দেয় তো বটেই!