‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’ এমন প্রবাদ-বাক্য সামনে রেখেই কি শেষ হলো একুশে বইমেলা ২০২৫? বইমেলার শুরুর দিকে যেভাবে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ দেখা গেছে, স্টল বন্ধের পাঁয়তারা চালানো হয়েছে এই ধারা শেষপর্যন্ত বহাল থাকলে আরও বাজে প্রভাব পড়ত— বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘নতুন বাংলাদেশ’ বলা হচ্ছে বর্তমান সময়কে, সেটারই প্রথম বইমেলা ছিল এটা। বইমেলা সুচারুরূপে পরিচালনা করতে পারার সক্ষমতা নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল শুরু থেকেই, শেষপর্যন্তও তা বহাল থেকেছে। তবে শেষে বড় কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাক ছাড়াই পর্দা নেমেছে বইমেলার; এটাই স্বস্তির।
প্রবাসী লেখক তসলিমা নাসরিনের ‘চুম্বন’ বইটি প্রকাশ করেছিল সব্যসাচী প্রকাশন। বইমেলায় একশ্রেণির মানুষ পাকড়াও করে লেখক ও প্রকাশক শতাব্দী ভবকে। শেষপর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিম্মায় নেওয়া হয় তাকে, বন্ধ করে দেওয়া হয় সব্যসাচীর স্টল। বন্ধ ছিল বইমেলার শেষদিন পর্যন্তও। বাংলা একাডেমি এই স্টল খোলার বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। অবশ্য গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা এখন সর্বত্র, বিশেষ গোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার ঝুঁকিতে যাননি সংশ্লিষ্টরা। আবার সব্যসাচী প্রকাশনের ঘটনার রেশ ফুরাতে না ফুরাতেই একশ্রেণির মানুষ হামলে পড়েছিল ‘উজান’ স্টলে। সেই স্টল কয়েকদিন বন্ধ রাখার পর চালু হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্টের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কবি সোহেল হাসান গালিবকে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কেন এক করে দেখা হয়! ব্যক্তির ‘অপরাধ’ কি প্রতিষ্ঠানেরও! কে দেবে এসব প্রশ্নের জবাব।
এই দুই ঘটনার রেশ যতটা না তীব্র, আতঙ্ক ছড়িয়েছে ঢের বেশি। নীরবে সরবে অনেকেই এবারকার বইমেলাকে বয়কট করেছিলেন। এসব ঘটনার পর তাদের অবস্থান কিছুটা সংহত মনে করলেও সাধারণ ক্রেতা-পাঠকের মধ্যে ছড়িয়েছে মব ও স্বেচ্ছাচারিতার আগ্রাসন-আতঙ্ক। ফলে বইমেলামুখী হননি অনেকেই। প্রতি বছর ঢাকার বাইরে থেকেও প্রচুর মানুষ বইমেলায় আসতেন, এবার অনেকেই আসেননি। মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল চেতনা লালনকারীরা ছিলেন অনুপস্থিত। শারীরিক ও মানসিক— দুভাবেই। আবার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়তে চাইতেন যারা, তাদের অনুপস্থিতিজনিত অভাবও ছিল প্রকট। সংস্কৃতি অঙ্গনের শীর্ষ কুশীলবসহ নায়ক-নায়িকারাও ছিলেন প্রায় অধরা। বইমেলা সর্বজনীন হয়ে উঠতে না পারার প্রভাব পড়েছে দিকে দিকে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া বহুদূর অবধি।
কোনো কোনো প্রকাশকের আশঙ্কা ছিল, মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বইমেলা। বইমেলা-সুলভ শোভন-স্মিত আচরণের বিপরীতে উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্য এমন ধারণার ভিত্তি দিয়েছিল। গত ২১ ফেব্রুয়ারিতে হিরো আলমকে ধাওয়া দেওয়া হয় বইমেলার শেষপ্রান্তে। এতে নড়বড়ে হয়ে যায় নয়েস পাবলিকেশন্স’র স্টল-কাঠামো। হিরো আলমের সঙ্গে সংঘটিত অন্যায়ের খবরটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। এভাবে আরও কিছু সংবাদকে ধামাচাপা দিয়েও সুবাতাস ফেরানো যায়নি বইমেলার ভেতরে-বাইরে।
প্রায় সব প্রকাশকই বেজার এবার। প্রত্যাশিত বিক্রি হয়নি, টান পড়েছে পুঁজিতে, চিড় ধরা পকেটের ফাটল আরও বড় হচ্ছে। শুরুর দিকে স্টল ভাড়া কমানোর দাবি থাকলেও শেষপর্যন্ত তা হয়নি। ফলে প্রকাশকদের লোকসানের পরিমাণ কমেনি একটুও। স্টলকর্মীদের বেতন পরিশোধ, স্টল বানানোর ব্যয় ও আনুষঙ্গিক খরচের বাকি টাকাটা অধিকাংশ প্রকাশককে অন্য মাধ্যম থেকেই সংগ্রহ করতে হয়েছে নিশ্চয়ই। এটা যারা পারবেন না তাদের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে আরও দীর্ঘদিন। আইএসবিএন নেওয়ার টাকাও প্রায় দ্বিগুণ হারে নেওয়া শুরু হয়েছে। অথচ একসময় এটা বিনা মূল্যেই দেওয়া হতো।
বইমেলায় শৃঙ্খলাভঙ্গের ‘স্বর্গযুগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবারই প্রথম। হরেক রকমের হকারের উপস্থিতি মাঝে-মধ্যে বিভ্রান্ত করে দিত— এটা বইমেলা নাকি অন্য কোনো মেলা? চটপটি, ঝালমুড়ি, চানাচুর, পেটিস, খেলনাসামগ্রী থেকে শুরু করে কী ছিল না সেখানে! টোকাই ও ভ্রাম্যমাণ হকাররা সরব ছিল শুরু থেকে শেষপর্যন্ত। ডেটল, ফ্রুটিকা বা কোমল পানীয়ের স্টলও কেন থাকতে হবে বইমেলার প্রবেশদ্বারে? তাও মন্দিরের গেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এমন অনেক প্রশ্ন ছিল, জবাব পাওয়া যায়নি সেগুলোর। স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল দুটো, শেষপর্যন্ত প্রতিবাদের মুখে বাংলা একাডেমি সেটা বন্ধ করে নিজেরাই বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিল। এমন বগিজগি নিঃসন্দেহে বইমেলার সুষ্ঠু পরিবেশে বিঘ্ন ঘটিয়েছে, বইমেলাকে যারা গোছানো-পরিপাটি দেখে আসছিলেন, বাড়তি কোনো প্রত্যাশা ছিল না— আহত হয়েছেন তারাও। একদিকে বইমেলা চলছে, অন্যদিকে বানানো হচ্ছে নিত্যনতুন স্টল, এমন চিত্রও অতীতে দেখা যায়নি। শিশুচত্বরেরও শেষদিকে কিছু স্টল বানানো হয়েছে মেলার শুরুর বেশ পরে। আবার স্টল বরাদ্দ নিয়ে বইমেলায় আসেননি, এমন প্রকাশক ও প্রতিষ্ঠানও ছিল। লিটলম্যাগ চত্বরের কোনো কোনো স্টল ছিল ফাঁকা। সংশ্লিষ্টরা আসার প্রয়োজন মনে করেননি। এই এই অনাগ্রহ? জবাবটুকু খুঁজে বের করে আনতে পারলে অনেক প্রশ্নেরই জবাব মিলবে।
পুলিশের জন্য ভালো সময় যাচ্ছে না এখন। বিগত কয়েক মাসে এই বাহিনী নানাভাবেই আক্রান্ত হয়েছে, জীবন দিয়েছে, চাকরির ঝুঁকিতে পড়েছে। সেটারই প্রতিফলন হিসেবেই বোধকরি এবার বইমেলায়ও পুলিশের গা-ছাড়া ভাব লক্ষ করা গেছে। ঢিলেঢালা ভূমিকা লক্ষা করা গেছে নানাভাবেই। বইমেলার প্রবেশমুখে আগতদের চেক করার সময়ে শিথিলতা ছিল। শেষদিকে বোধকরি পুরোপুরিই হাল ছেড়ে দিয়েছে। দর্শনার্থী-ক্রেতাদের জন্য বইমেলায় প্রবেশের সময় নির্ধারিত রাত সাড়ে আটটা। অতীতে দেখা গেছে, এরপরে কার্ডধারী স্টলকর্মীদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। এবার যে কেউই একটু ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করলেই প্রবেশ করতে পেরেছে। পুলিশ কোনো বিতর্ক তথা ঝুঁকি নেয়নি। এই যে হাল ছেড়ে দেওয়া এটাও নিশ্চয়ই সামষ্টিক সুরক্ষার জন্য শুভ লক্ষণ ছিল না।
এবার অন্যতম দৃষ্টিকটু বিষয় ছিল— যত্রতত্র প্রস্রাব। টিএসসি গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বামে টিনের ব্যারিকেড দেওয়া জায়গাটায় দিনে-দুপুরেও অবাধে প্রস্রাব করেছেন অনেকেই। কোথাও থেকে কোনো বাধা পাননি তারা। অথচ পাশেই ছিল মুক্তমঞ্চ’র শৌচাগার। সেটুকু যাওয়ার কষ্টটুকু স্বীকার করেননি সহজে কাজ সারতে পারা ব্যক্তিরা! মেলার শেষপ্রান্তে নির্মিত এবারকার শৌচাগার ছিল পরিচ্ছন্ন। পর্যাপ্ত জায়গা রাখার পাশাপাশি পরিপাটি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়েছিল এটি। মুক্তমঞ্চ’র শৌচাগারটি বন্ধ করে দেওয়া হতো নয়টা বাজার আগেই। ফলে বিপাকে পড়ত মেলা থেকে শেষ মুহূর্তে বের হওয়া প্রকাশক, স্টলকর্মীসহ আগত বইপ্রেমীরা। বাধ্য হয়ে তারা নিচের করিডোরে ও উপরে উন্মক্ত স্থানে মূত্রত্যাগ করতেন। এটা বাজে একটা দৃষ্টান্ত হয়েই রইল। বই যেহেতু পবিত্র বস্তু, বইমেলাও তেমনই। সেখানে এমন যথেচ্ছাচার ও ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি নিন্দনীয়।
প্রত্যাশিতভাবেই চিহ্নিত চিহ্নিত গোষ্ঠীর স্টলও বরাদ্দ পেয়েছে এবার। এমনকি লিটলম্যাগ চত্বরেও তা দেখা গেছে। একটি মাসিক ম্যাগাজিন কীসের ভিত্তিতে স্টল বরাদ্দ পায়, হয়ে উঠতে পারে ‘লিটল ম্যাগাজিন’! প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরটাও জানা।
শিশুচত্বরের বেশ কয়েকটি স্টলে বিক্রি হয়েছে পাঠ্যবই। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে যদি কিছু সৃজনশীল বইও দেখা যেত, বলার সুযোগ থাকত ‘সমন্বয়’ করা হয়েছে। সেই সমন্বয়েরও বড় অভাব। একুশে বইমেলায় শুধু পাঠ্যবই বিক্রি কতটুকু শোভন ও যুক্তিসঙ্গত সেই প্রশ্নও রয়ে যায়। এমন অব্যবস্থাপনা কম ছিল না শুরু থেকে শেষপর্যন্ত। এবারও মূল মেলায় দশ টাকা কাপে চা বিক্রির ব্যবস্থা ছিল না। খাবারের দোকানের আধিক্য ও বিস্তৃত পরিসর ছিল চোখে পড়ার মতো। যথারীতি মেলা দাপিয়ে বেড়িয়েছে কফি। বিশ থেকে পঁচিশ টাকার কফির প্রয়োজন সবার থাকে না, এটা কখনোই বোঝানো যায়নি সংশ্লিষ্টদের। যত জায়গায় কফি বিক্রি হয়, তার আশপাশে একটা করে চায়ের স্টলও তো রাখা যেত। সেখানে বিক্রি হতো পাঁচ টাকার বিস্কুট। সর্বোচ্চ দশ টাকা দামের শিঙাড়া-সমুচাসহ তেলেভাজাও। এমনটি করা গেলে কোন সিন্ডিকেট ভেঙে পড়ার আশঙ্কা কি ছিল!
বইমেলা জমে ওঠার নেপথ্যে বড় আরেকটি কারণও ছিল। পাঠকের পাশাপাশি লেখকরাও এবার স্বাধীনভাবে মেলায় ‘প্রবেশাধিকার’ পাননি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, সুমন্ত আসলাম প্রমুখ লেখক বইমেলায় আসেননি। আবার কারাবন্দিও আছেন একশ্রেণির জনপ্রিয় লেখক— শাহরিয়ার কবির, কামাল চৌধুরীর মতো আরও কেউ কেউ। স্বভাবতই এদের ভক্ত-অনুসারীরা বইমেলার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেননি।
২০২৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে ৩,২৯৯টি বই। বাংলা একাডেমির হিসাবে বলা হলেও প্রকৃত অর্থে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। এটা শুধু বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে প্রচারের জন্য দেওয়া বইয়ের হিসাব। এর বাইরেও অনেক প্রকাশক আছেন, যারা বই জমা দেন না। অবশ্য ‘মাগনা’ একটা বই দিতে তারা বাধ্য কিনা এমন প্রশ্নও যৌক্তিক। অনেক লেখক নিজ উদ্যোগে বই প্রকাশ করেন। ঢাকায় বা ঢাকার বাইরে থেকে তারা সেসব মেলায় নিয়েও আসেন। ‘কাগজের ফেরকা’য় চাইলেও এসব বই তারা তথ্যকেন্দ্রে জমা দিতে পারেন না। তাহলে প্রতি বছর প্রচারমাধ্যমে যেভাবে ফলাও করে প্রকাশিত বইয়ের তালিকা দেওয়া হয়, সেটা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কী! অবশ্য এসব নিয়ে প্রকাশকদের অসন্তোষ নেই, তারা ভাবেনও না বোধকরি এমন ‘গৌণ’ বিষয় নিয়ে। প্রকাশকের সরাসরি সন্তোষ কিংবা অসন্তোষ যেখানে থাকে, সেটা হচ্ছে বইয়ের বিক্রি। প্রতি বছর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা জানানোর পাশাপাশি বইমেলায় বিক্রির পরিমাণও জানানোর সংস্কৃতি ছিল। কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম ছিল এবার। বছর কয়েক আগে কাগজে প্রতিবেদন লিখেছিলাম ‘রেকর্ড বিক্রি মনগড়া’ শিরোনামে। বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও ‘অন্যপ্রকাশ’ প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলামের মন্তব্য সংবলিত সেই প্রতিবেদন নজর কেড়েছিল সংশ্লিষ্ট কারও কারও। এমন কাল্পনিক গল্পগাথার কী প্রয়োজন, এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল সেখানে।
এবারকার বিক্রির হিসাব জানায়নি বাংলা একাডেমি। প্রকাশকের দুর্ভোগের পাশাপাশি সামষ্টিক নেতিবাচক চিত্রের বিপরীতে হয়তো এমন সংখ্যাবাচক হিসাব ফলপ্রসূ হতো না, কলকে পেত না। অবশ্য শত কোটি টাকার গল্প ফাঁদার সুযোগ থাকলে সেটা নিশ্চয়ই সামনে আসত!
shafique_hasan79@yahoo.com