বিশ্বের সব দেশের তুলনায় পাকিস্তানে মামাতো, ফুপাতো বা চাচাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি৷ কিন্তু এই চল যুক্তরাজ্যের প্রবাসী পাকিস্তানিদের মধ্যে কমছে৷ জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
১৯৯০ সালে পাকিস্তান থেকে যুক্তরাজ্যে যান ব্রিটিশ-কাশ্মিরী শাগুফতা রাশিদ৷ তার স্বামীকে বিয়ের আগে তিনি চিনতেন ‘ভাই’ হিসাবে৷ কিন্তু তার সংস্কৃতিতে এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল৷ পাঁচ সন্তান নিয়ে যুক্তরাজ্যে তাদের জীবন স্বাভাবিকভাবে চলছিল, জানান তিনি৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘আমার সকল সন্তানই সুন্দর, বু্দ্ধিদীপ্ত৷ আমরা যখন আমার মেয়ের আঠারোতম জন্মদিন পালন করতে যাই, তখন সে প্রথম চোখের সমস্যার কথা বলে।’ এর কিছুদিন পরেই, শাগুফতার মেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে৷
শাগুফতা বলেন, আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি৷ ডাক্তাররা বলেন যে, তার মেয়ের এমন এক রোগ থাকতে পারে, যা বয়সের সঙ্গে ধরা পড়ে। যার ফলে দৃষ্টি শক্তি সারা জীবনের জন্য হারিয়ে যেতে পারে৷
তা হয়নি৷ দুটি জটিল অপারেশনের পর, একটি মোটা পাওয়ারের চশমাকে সঙ্গী করে তার মেয়ে এখন দুবাইতে সংসার করছে৷ কিন্তু তিন দশক আগে এই জটিলতা ধরা পড়ার সময়েই শাগুফতার পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে সতর্ক করেছিল যে, পরিবারের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক থাকা মামাতো, ফুপাতো, চাচাতো ভাইবোন বা ‘কাজিন’-এর সঙ্গে বিয়ে হলে, এমন রোগ হতে পারে সন্তানের৷
শাগুফতার বোন সাবিহা হাসানেরও বিয়ে হয়েছে তাদেরই এক আত্মীয়ের সঙ্গে৷ সাবিহার এক সন্তানের অটিজম রয়েছে৷ অন্যদিকে, পরিবারে এমন আরও অনেকে রয়েছেন, তিনি জানান, যাদের এমন বিয়ে হয়েছে ও যাদের সন্তানদের কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে৷ কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রে, শারীরিক সমস্যার সমাধান হলেও এমন বিয়ের ফলে পরিবারের অনেককে নানা ধরনের কটুকথা শুনতে হয় তাদের, জানান সাবিহা৷
কাছের সম্পর্কের ভাইবোনের সঙ্গে বিয়েকে বলা হয় কনস্যাংগুইন ম্যারেজ৷ যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ডের একটি গবেষণা ব্র্যাডফোর্ড, বার্মিংহাম ও লন্ডনে শিশু মৃত্যুকে খতিয়ে দেখে৷ সেখানে বলা হয়, অন্তত ২০ থেকে ৪০ শতাংশ মৃত্যুর পেছনে হয়ত এমন কনস্যাংগুইন ম্যারেজ ও অন্যান্য জেনেটিক কারণ থাকতে পারে৷
বার্মিংহাম সিটি হাসপাতালের চিকিৎসক ড. শাবি আহমেদের মতে, কনস্যাংগুইন বিয়ের ক্ষেত্রে গুরুতর জেনেটিক ব্যাধি দেখা যেতে পারে৷ তিনি বলেন, শুধু ব্রিটিশ পাকিস্তানি বা কাশ্মীরীরাই নন, এমন প্রবণতা দেখা যায় আরব বা অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও, যাদের সংস্কৃতিতে এমন বিবাহ হয়ে থাকে৷
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এমন ধরনের বিয়ের চল রয়েছে, যাদের ইংরেজিতে বলে সেকেন্ড কাজিন৷ বিশ্বের মোট ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নবজাতকের মা-বাবাই ‘সেকেন্ড কাজিন৷
২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ১৩ হাজার ৫০০টি পরিবারের তথ্য থেকে জানা যায়, ৬০ শতাংশ পাকিস্তানি দম্পতিই একে অপরের ‘কাজিন’৷ কিন্তু যদি কোনো দম্পতির দুজনেই যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে এমন বিয়ের হার কমে দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ৷
২০১৬ থেকে ২০২০ সালে আরেকবার এই সমীক্ষা চালানো হলে দেখা যায় যে সার্বিক পরিসংখ্যানটিও ৬০ থেকে কমে ৪০ শতাংশ হয়েছে৷
কিন্তু প্রযুক্তি ও খোলামেলা আবহ এই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, জানান শাগুফতা ও সাবিহা দুজনেই৷ শাগুফতা বলেন, ব্রিটিশ সন্তানরা খুবই স্বাস্থ্য সচেতন, কারণ তারা সোশাল মিডিয়ায় সারাক্ষণ সব কিছুই আলোচনা করে৷
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক ব্রিটিশ পাকিস্তানি নারী বলেন যে তার মতে, বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত পরিবারের চাপের বদলে নিজেই নেওয়া উচিত৷ তিনি বলেন, পরিবারের চাপ থাকা সত্ত্বেও আমার ছেলে তার কাজিনকে বিয়ে করতে মানা করে৷ কিন্তু আমি তার পক্ষে ছিলাম, আমার পরিবার সঙ্গে না থাকা সত্ত্বেও৷ আমাদের বুঝতে হবে যে এমন বিয়ের ফলে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকে৷
তবে, ব্র্যাডফোর্ডের সমাজকর্মী বিনাশ ফারিসের মতে, সার্বিকভাবে এই প্রবণতা নিম্নগামী হলেও যাদের মধ্যে ধর্মীয় আচারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে, সেই সব পরিবারে বা সেই সব তরুণদের মধ্যে ধর্মীয় রীতি মেনে এমন বিবাহের চল থেকেই যাচ্ছে৷