বাসের ভেতর বসার মতো তুচ্ছ ঘটনায় সুপারভাইজারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর গেটে সেই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় এক দোকানী। এ থেকেই শুরু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলা দফায় দফায় সেই সংঘর্ষে আহত হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ৮০ জন শিক্ষার্থী। প্রায় ৪ ঘণ্টার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আরও শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া থেকে ‘মোহাম্মদ’ নামের একটি বাসে রাজশাহী আসছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আলামিন আকাশ। বাসে আসনে বসার ঘটনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে চালক শরিফুল ও চালকের সহকারী রিপনের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে বাসটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটে পৌঁছালে রিপনের সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর পুনরায় বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। এ সময় স্থানীয় এক দোকানদার এসে ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে তর্কে জড়ান। একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।
এ সময় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে ওই দোকানদারের ওপর চড়াও হন। এরপর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এক জোট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। তখন শিক্ষার্থীরাও তাদের পাল্টা ধাওয়া করেন। এরপর থেকে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিনোদপুর।
এক পর্যায়ে বিনোদপুর গেটের কাছে থাকা পুলিশ বক্স ও কয়েকটি দোকানে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টা পর্যন্ত ক্যাম্পাস ও বিনোদপুর বাজারে মহাসড়ক দখলে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
এসময়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের ভেতরে নিতে চেষ্টা করেন উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার। উপস্থিত হন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
এদিকে সংঘর্ষের প্রায় ৪ ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার। তবে তিনি রবি ও সোমবার সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণা দেন।
এসময় উপাচার্য বলেন‘ তোমাদের প্রতি অনুরোধ হলে ফিরে যাও। তোমাদের জন্য প্রশাসন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। রুমে যাও তোমরা। এ ঘটনায় প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
তবে এ ঘোষণা দেওয়ার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ক্লাস বন্ধের প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটে জড়ো হয়ে তারা আবারও দোকানে হামলা ও ভাঙচুর করতে থাকে।
এক পর্যায়ে মটোরসাইকেল, পুলিশ বক্স ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারসেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এসময় ২০ এর অধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর কিছুটা শান্ত হয় পরিবেশ।
এদিকে, বিনোদপুরে মেসে যাওয়ার পথে স্থানীয়দের আক্রমণের শিকার হন কিছু শিক্ষার্থী। বিনোদপুরের কয়েকটি মেসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার চেষ্টা করেছিল স্থানীয়রা, এমন অভিযোগ করেছেন কয়েকজন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রাত ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে আহত ৮০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া শতাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টার থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদনপুর এলাকায় নামানো হয় বিজিবি। রাতে ওই এলাকায় বিজিবি সদস্যদের সতর্ক টহলে দেখা গেছে।
বিজিবি পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এম জাহিদ পারভেজ রাতে সাংবাদিকদের জানান, স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় এরই মধ্যে ৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আমাদের আরও কয়েক প্লাটুন স্ট্যান্ডবাই আছে, প্রয়োজন দেখা দিলে তা নামানো হবে।
রোববার-সোমবার ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুই দিনের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার (১১ মার্চ) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার সাংবাদিকদের এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে রোববার ও সোমবারের সব ধরনের পরীক্ষা ও ক্লাস স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
রেলপথ অবরোধ
শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় সংলগ্ন রেললাইন অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন। রেলপথ অবরোধ থাকায় কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়া রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের সঙ্গে অন্যসব জেলার ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে কোনো ট্রেন ঢোকেনি, বেরও হয়নি।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক আবদুল করিম জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রেলাইনে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ শিক্ষার্থী শুয়ে-বসে ছিলেন। ট্রেন যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাই রাতে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছেড়ে যেতে পারেনি। রাত ১১টা ২০ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্য রাজশাহী ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল।
রেললাইন অবরোধ থাকায় ঢাকা থেকে রাজশাহী হয়ে একটি মেইল ট্রেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেতে পারেনি। ট্রেনটি নাটোরের আবদুলপুর জংশনে আটকে ছিল বলে জানান ব্যবস্থাপক।
সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহবান রাসিক মেয়রের
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়দের শান্ত থাকার আহবান জানিয়েছেন রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। দুপক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে শনিবার (১১ মার্চ) রাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে এই আহবান জানান রাসিক মেয়র।
সন্ধ্যার পর থেকে দুপক্ষের মধ্যে এই সংঘর্ষ বাধে। এতে রণক্ষেত্র হয়ে যায় পুরো এলাকা। খবর পেয়ে রাত ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে যান রাসিক মেয়র। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বিনোদপুর বাজারে ছিলেন তিনি।
এসময় মেয়র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিনোদপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে দুপক্ষকে আহবান জানান।
এসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর গোলাম সাব্বির সাত্তার, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. আনিসুর রহমানসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও কথা বলেন।
ফেরদৌস/এম