দাম্পত্যজীবনে কলহ ও মতের দ্বিমত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। একসঙ্গে বসবাস করতে গেলেই বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মতামতের অমিল হয়ে থাকে। দু’জনের ভাবনা, পছন্দ, পরিকল্পনা ও লক্ষ্যেও অমিল থাকতে পারে। তবে এসব বিষয় পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করে নিতে না পারলেই শুরু হয় জটিলতা।
সংসার জীবনে জটিলতা যখন প্রকট আকার ধারণ করে, তখন বিচ্ছেদ হয়। যা বৈধ প্রক্রিযা। আইনিভাবে যেকোনো দম্পতি যেকোনো বয়সে এসেই বিচ্ছেদে যেতে পারেন। এরপরও এই বিচ্ছেদ নিয়ে সমাজে বিভিন্ন ধরনের অলিখিত নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিয়েবিচ্ছেদে আগ্রহী বা উৎসাহী করার মতো কিছু না হলেও অনেক সময় এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
বিয়েবিচ্ছেদ সংক্রান্ত ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তিন লাখের বেশি পরিবারে একটি জরিপ চালায়। চলতি বছর প্রকাশিত সেই জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে দেশে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ, দুটির হারই বেশ বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে ৬ থেকে ১ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে বিচ্ছেদের হার ছিল।
২০২২ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৪ শতাংশে। এর আগে ২০২১ সালে ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের সাধারণ বিয়েবেচ্ছদের হার ২ শতাংশের কিছুটা বেশি ছিল। কিন্তু পরের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশে। এই বিচ্ছেদের প্রধান কারণ ছিল বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক।
এছাড়া ২০২০ সালে দেশের অন্য একটি গবেষণা নিবন্ধ (ইবিএইউবি জার্নাল অব ল, ভলিউম ২, ২০২০) থেকে জানা যায়, ২৫-২৯ বছর বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়েবিচ্ছেদের হার বেশি। আবার বাল্যবিয়ের শিকার নারী-পুরুষের মধ্যেও বেশি এই হার।
এদিকে সাইকোলজি টুডে জার্নালে ২০১৮ সালে প্রকাশ হওয়া এক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে দেখা গেছে, একবার যদি কারও বিয়েবিচ্ছেদ হয় তাহলে তার মধ্যে পরবর্তীতে বিচ্ছেদের প্রবণতা থাকে। আর এই প্রবণতা বেশিই থাকে। পশ্চিমা বিশ্বে ‘গ্রে ডিভোর্স’, অর্থাৎ ৫০ বছর বয়স হওয়ার পরবর্তীতে বিচ্ছেদের হার অনেক বেড়েছে। এরপরও এই হার ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে হওয়া বিচ্ছেদের হারের থেকে কম। অর্থাৎ―বিয়ে পরবর্তীতে সাংসারিক জীবন যত দীর্ঘ হয়, বিচ্ছেদের হারও তত কমতে থাকে। তবে অনেক সময় এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়।
এছাড়া দাম্পত্যজীবনে বিচ্ছেদের মধ্যে অধিকাংশই দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ের জন্য হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল না বিধায় বিয়ে টিকিয়ে রাখেন। কেউ কেউ বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন আর ভাবেন, সন্তানরা কিছুটা বড় হলে বিচ্ছেদ চূড়ান্ত করবেন। স্বামী-স্ত্রী যখনই বিচ্ছেদে যাক না কেন, বিচ্ছেদ তাদের সন্তানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সন্তান ছোট হোক বা বড় হোক কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক হোক, এর নেতিবাচক প্রভাব সন্তানের মধ্যে পড়বেই। অনেক সময় ৫০ বছর হওয়ার পরবর্তীতে বিচ্ছেদে মানসিক চাপ কমে বলা হয়। এতে দীর্ঘমেয়াদি যন্ত্রণা ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে এই গবেষণা ও তথ্য পশ্চিমা সমাজ প্রেক্ষাপট অনুযায়ী। যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কখনোই সামঞ্জস্য নয়।
বিচ্ছেদের কারণ: সাধারণত দীর্ঘ দাম্পত্যের পর বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, আর্থিক অভাব-অনটন ও টানাপোড়েন, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব, পারিবারিক সহিংসতা, যৌনজীবনে পূর্ণতার অভাব, সন্তানের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে মতামতের অমিল, জীবনে বড় কোনো দুর্ঘটনা, মানসিক রোগ ও মাদকাসক্তির কারণে বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। এছাড়া বাল্যবিয়ের কারণেই অনেক সময় বিচ্ছেদ হয়।
বিচ্ছেদ হলে করণীয়: বিয়েবিচ্ছেদ যে জন্যই হোক না কেন, দীর্ঘদিন সংসার করা বা দাম্পত্যজীবন কাটানোর পর বিচ্ছেদ হলে প্রথমেই আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। সম্পত্তি বা আর্থিক ব্যবস্থায় আইন ও নিয়মের বাইরে যাওয়া যাবে না। কাউকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কোনোভাবেই থমকে যাওয়া বা গুটিয়ে থকা যাবে না। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পুনরায় পরিচিত করে তুলুন নিজেকে। কর্মস্থল ও সামাজিক ক্ষেত্রে সবসময় সাবলীল থাকতে হবে। আর সন্তান থাকলে এ অবস্থায় আইনি ও নৈতিকতা মেনে চলুন। মনে রাখতে হবে, বিচ্ছেদ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়েছে, সন্তানদের সঙ্গে নয়। সন্তানকে স্নেহ-ভালোবাসার জায়গা থেকে কখনো বঞ্চিত করা উচিত হবে না।
এছাড়া বিচ্ছেদ পরবর্তীতে নতুন সম্পর্কে জড়ালে তা বিয়ে পর্যন্ত নেবেন কিনা, সেটি সার্বিকভাবে ভালো করে ভেবে দেখুন। এমনকি সন্তান এবং সাবেকের সঙ্গেও এ ব্যাপারে আলোচনা করতে পারেন। আগের বিচ্ছেদ যদি দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনের পর হয়ে থাকে, তাহলেও পরবর্তী মানুষকে নতুন করে ভাবতে থাকুন। এছাড়া সবসময় ইতিবাচক নিয়ে থাকুন এবং ইতিবাচক মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন।