২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

কাঁচ ভাঙা স্বপ্ন

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ || ০৮ এপ্রিল, ২০২৪, ০৬:৩০ পিএম
কাঁচ ভাঙা স্বপ্ন


আমার জেলা শহর মাদারীপুর থেকে সুনীল সাহিত্য কল্যাণ ট্রাস্ট ছোটগল্পের ওপর ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ ঘোষণা করবে। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের নোটিশ বোর্ডে বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়ল। তাই একটি ছোটগল্প লিখে জমা দিলাম। তারপর আর খোঁজ রাখিনি। কাঁচা হাতের লেখা বলে এতটা আশাও হৃদয়ে লালন করিনি। আমার মেজো ভাই জানতেন আমি লেখা জমা দিয়েছি। তিনি পত্রিকা পড়ে আমাকে ফোন দিয়ে জানালেন। আমি সুনীল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওই দিনের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকাটি খুঁজলাম। পত্রিকা পড়ে জানলাম মোট সাতজনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। প্রথম সারির তিনজন বাদে বাকি চারজনকে সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সান্ত্বনা পুরস্কারে চতুর্থ নামটি আমার। আমি হাতের মুঠোয় স্বর্গ পাওয়ার আনন্দ নিয়ে পরদিন সকালে ছুটলাম মাদারীপুরের উদ্দেশে।

মাদারীপুর এমএম হাফিজ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরিতে যোগাযোগ করে সুনীল সাহিত্য কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এটিএম কামালুজ্জামানের কাছ থেকে পুরস্কারটি বুঝে নিলাম। অনুষ্ঠানে থাকতে না পারায় খুব আক্ষেপ করলাম। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম আগামী বছরের জন্য। তিনজনকে ক্রেস্ট ও সনদপত্র দেওয়া হয়। চতুর্থ স্থান লাভ করায় ক্রেস্টটি পাওয়া গেল না। তাই বলে দমে যাওয়ার পাত্র আমি নই। এক প্রকার কাছা দিয়ে নেমে পড়লাম। 

 কিছুক্ষণের মধ্যে জেলার সদ্য গজে ওঠা এবং শীর্ষস্থানীয় কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা আসতে শুরু করলেন। 


ক্রেস্ট না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে পরের বছরও গল্প লিখে জম দিলাম। আগের চেয়ে এবারের গল্পটা খুব বেশি মনোযোগসহ মনের মাধুবী মিশিয়ে লিখলাম। দিন-রাত জল্পনা-কল্পনা করে গল্পের একটি ভিত্তি স্থাপন করা গেল। বন্ধুর কাছে শোনা এক পতিতার জীবন কাহিনি নিয়ে গল্পটি লিখে খুবই আশান্বিত ছিলাম। পুরস্কার ঘোষণার দিন যত ঘনিয়ে আসছে আমার হৃৎস্পন্দন তত বাড়তে থাকে। সারাক্ষণ ভাবি পুরস্কার পাওয়ার পর কী কী করতে হবে? কোন কোন পত্রিকায় আমার ছবিসহ জীবন-বৃত্তান্ত ছাঁপানো হবে। আগে থেকেই পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলে মানিব্যাগে রেখে দিলাম। স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তহিক পত্রিকার সম্পাদকদের সাথে পূর্ব পরিচয় থাকা সত্ত্বেও ঘন ঘন ফোন দিয়ে কুশলাদী জানতাম। তার পত্রিকার দীর্ঘায়ু ও উত্তরোত্তর সফলতা কামনার সাথে সাথে উচ্ছসিত প্রশংসা করতে থাকলাম। যাতে তারা আমাকে একটু হাইলাইট করেন।

ঘরে রাখা পাণ্ডুলিপিটি কাছের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব ডেকে পড়তে দিলাম। পাঠ শেষে তারা আমার পুরস্কার নিশ্চিত বলে ঘোষণা দিলো। মনে মনে পুরস্কারটি আমার হস্তগত রয়েছে বলে এক বুক আশা নিয়ে প্রহর গুনতে থাকলাম। কম্পোজ বাবদ যে দুই-আড়াইশ টাকা খরচ হয়েছে, তা তুচ্ছজ্ঞান করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি। অপরদিকে মানিব্যাগের অবস্থা শোচনীয়। হঠাৎ হঠাৎ পুরস্কারের কথা ভাবতে গিয়ে পুলকিত হইÑশিউরে উঠি মাঝে মাঝে।

আমার প্রতীক্ষিত দিনটি ঘনিয়ে এলো। পত্র মারফত পুরস্কার ঘোষণার তারিখটা জানার পর ক্যালেন্ডারের পাতায় গোল করে দাগ কেটে রাখলাম। মোবাইল সেটের রিমাইন্ডারে অ্যালার্ট টোন দিয়ে রেখেছি সর্তকতাবশত। যেন এবারের অনুষ্ঠানাটাও হাত ফসকে না যায়। তবে যে আমি স্বপ্ন থেকে পা পিছলে পড়ে খোঁড়া হয়ে যাবো একেবারে।

আমার বর্তমান বাসস্থান উপজেলা শহর কালকিনিতে। সেখান থেকে জেলা শহরে পৌঁছতে পাবলিক বাসে যেতে হবে। বিকাল পাঁচটায় অনুষ্ঠান শুরু হলে তিনটার মধ্যে তৈরি হয়ে রওয়ানা দিতে হবে। তাই আগের দিন বিকেলেই পোশকাদি গোছগাছ করে বালিশের নিচে রেখে দিলাম। নেপথেলিন সহযোগ তোরঙ্গের মধ্যে রাখার কারণে জামা- কাপড় থেকে সুবাসের পরিবর্তে একটা দরিদ্র ঘ্রাণ আসতে লাগলো। সে যা-ই হোক, তাবুও তো সর্বনাশী পিঁপড়ার হাত থেকে রক্ষা পেল। চটের ব্যাগটা ঝেড়ে-মুছে পরম যত্নে টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখলাম।

সন্ধ্যা থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই আড্ডা থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ নাড়াচাড়া করে তার গল্পের সাথে আমার গল্পের সামঞ্জস্য খুঁজলাম। তুলনামূলক উৎকৃষ্ট বিচার করে বৃষ্টির শীতল পরশে বিছানায় গা এগিয়ে দিলাম। অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে রাত বারোটার দিকে কল্পনায় শ্রান্তিতে দু’চোখ বুজে এলো। 

আজ আমার প্রতীক্ষিত দিন। দামি শ্যাম্পু কিনে চুলগুলো পরিপাটি করলাম। চুলগুলো কাজী নজরুল ইসলামের কেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কিছুটা ছোট ছিল। আমার কেশরাশি দেখে সবাই কবি বলেই জানতেন। মাঝে মাঝে অবশ্য কবিতাও লিখি। স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকে সেই কবিতা ছাপাও হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম রূপবতী মেয়েরা ‘কবি’ বলে সম্বোধন করতো। অজানা একটা আবেশ যেন ঘিরে রাখতো সর্বক্ষণ। সুগন্ধী সাবান দিয়ে ঘঁষে মেজে সময় নিয়ে গোসল সেরে নিলাম। একজন পুরোদস্তুর সাহিত্যিক হয়ে যাবো ভাবতেই অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করছিল। কবিতার পাশাপাশি গল্প লেখার সিদ্ধান্তে ঐকমত্য পোষণ করলাম। আস্তে আস্তে ভাবনাগুলো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। সব ভাবনা ঝেড়েঝুড়ে আজকের পুরস্কারের প্রতি মনোনিবেশ করলাম।

দুপুরের রান্নার বড্ড দেরী দেখে রুমমেট জাহিদের কাছ থেকে টাকা ধার করে নূরুর ভাতের হোটেলে খেয়ে নিলাম। বাসায় এসে ভাজ করে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে জাহিদের টেবিল থেকে সুগন্ধি ছিটিয়ে নিলাম। যাতে নেপথেলিনের ঝাঁঝালো গন্ধটা অন্য কারো নাকে না পৌঁছায়। পেছন থেকে ডাকার মতো কেউ ছিল না বলে বাধাহীন ভাবেই বাস ধরার জন্য ছুটলাম। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছি। কাল সন্ধ্যা থেকে ঝরে যাওয়া বৃষ্টিটা অনবরত ঝরতে থাকলো। ছাতার তেমন প্রয়োজন ছিল না। হোটেলের ঝাঁপের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। পরিচিত দু’একজন বলছিল, ‘এই বৃষ্টির মধ্যে কবি সাহেব কোথায় ছুটলেন?’ গর্বিত হাসি হেসে বললাম, ‘মাদারীপুরে একটা অনুষ্ঠান আছে।’ ততক্ষণে বাস এসে পড়ায় দ্রুত উঠে মধ্যবর্তী স্থানে খালি সিট দেখে চেপে বসলাম। ভাবতে ভাবতে বাস এসে জেলা শহরে পৌঁছল। ঝটপট রিকশা ডেকে ছুটলাম গন্তব্য স্থানে। পাবলিক লাইব্রেরিতে পৌঁছে টের পেলাম আমি এক ঘণ্টা পূর্বেই এসে পৌঁছেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে জেলার সদ্য গজে ওঠা এবং শীর্ষস্থানীয় কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা আসতে শুরু করলেন। সাংবাদিকের ক্যামেরার দিকে চকচকে দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।

যথাসময়ের আধঘণ্টা পর অনুষ্ঠান আরম্ভ হলো। মাইক্রোফোন হাতে ঘোষক যখন সুনীল সাহিত্য পুরস্কার-২০০৭ উচ্চারণ করলেন; তখন আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। আমি একটু নড়েচড়ে বসে বারকয়েক ঢোক গিললাম।

রাত পোহাবার এখনো কিছুটা সময় বাকি। আমার রুমমেট জাহিদ হায় হায় শব্দ করছে। বললাম, ‘কী হয়েছে জাহিদ?’

শুরু হলো আলেচানা পর্ব। পাশ্চাত্য ছোটগল্প তথা মোপাসাঁ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত আলোচনা করলেন আলোচকবৃন্দ। সুনীল সাহিত্য কল্যাণ  ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কামালুজ্জামান তার বক্তব্যে লেখা জমা দেওয়ার জন্য লেখকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন। গর্বে আমার বুকটা ভরে গেল। এবার পুরস্কার ঘোষণার পালা। যেহেতু তিনজনকে পুরস্কাকৃত করা হবে; সেহেতু আকর্ষণবশত তৃতীয় স্থান থেকে নাম ঘোষণা শুরু হলো। তৃতীয় স্থানে আমার নামটি নেই। যাক আশ্বস্ত হলাম। অপেক্ষা করছিলাম দ্বিতীয় স্থানের জন্য। সেখানেও ঘোষিত হলো অন্য একটি নাম। হৃৎস্পন্দন গেল আরও বেড়ে। ক্রমশই যেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ঘোষক একটু ভনিতা করে প্রথম স্থানে আমার নামটি ঘোষণা করলেন। শুনে আমি হলাম বাকরুদ্ধ। হাত-পাসহ সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করলো। কম্পমান পায়ে এগিয়ে গেলাম ঘোষণা মঞ্চের দিকে।

আমার কাঙ্ক্ষিত ধন সোনার হরিণ এখনই আমার হাতে এসে পৌঁছবে। দু’চোখে জল এসে গেল হঠাৎ। আনন্দে এবং আতিশয্যে। মান্যবর প্রধান অতিথি মাদারীপুরের কৃতি সন্তান কবি অসীম সাহা। তার হাত থেকে গ্রহণ করবো পুরস্কারটিÑভাবতেই কেমন যেন অন্য মনস্ক হয়ে গেলাম। পুরস্কারটি যখন আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে, আমি তখন মৃগী রোগীর মত কাঁপতে শুরু করলাম। কাঁচের বাঁধানো ক্রেস্টটা আমার হাতে এলো ঠিকই; কম্পমান হাত ফসলে তা পড়ে গেল নিচে। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে কাঁচ। নামফলকটি ছিটকে পড়ে গেল কিছুটা দূরে। আমি আশাহতের ন্যায় হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মিলনায়তনজুড়ে ‘হায় হায়’ রব উঠল। হায় হায় রব আর কাঁচ ভাঙা শব্দে আমার ঘুমটাও গেল ভেঙে। চেয়ে দেখি আমি আমার বাসায় মলিন বিছানায় শুয়ে আছি। ছেঁড়া কাথায় শুয়ে আকাশ ছোঁয়ার মতো মনে হলো স্বপ্নটাকে। রাত পোহাবার এখনো কিছুটা সময় বাকি। আমার রুমমেট জাহিদ হায় হায় শব্দ করছে। বললাম, ‘কী হয়েছে জাহিদ?’ জাহিদ জানালো, মরার বিড়ালটা ইঁদুর ধরতে গিয়ে আমাদের একমাত্র আয়নাটা টেবিলের ওপর থেকে ফেলে দিয়েছে। নিশ্চয়ই সেটি ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।



আরো পড়ুন