আর কয়েকদিন পরই পবিত্র ইদুল ফিতর। তারও মাত্র কয়েকদিন পরই বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ ‘বাংলা নববর্ষ’। এই দুই উৎসবে নারী-পুরুষ সবাই নতুন পোশাক পরে। যে-কোনো অনুষ্ঠানেই বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। এর মধ্যে আবার টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির প্রতি রয়েছে আলাদা টান। আর সেই নারীদের পছন্দের শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁত শ্রমিকরা। তবে, তারা বলছেন, মজুরি দিয়ে তাদের মনে অসন্তোষ রয়েছে
সরেজমিনে দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল তাঁত পল্লীতে দেখা গেছে, এই শিল্পে শুধু পুরুষরাই নয়, বাড়ির নারীরাও যথেষ্ট শ্রম দিচ্ছেন। বৈশাখের আগমন মুহূর্তে তাঁত পল্লীগুলোতে কাপড় তৈরির প্রচণ্ড ব্যস্ততায় নারী-পুরুষের সবাই সমানভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সুতি শাড়ি সবনিম্ন ৬০০ টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা, মার্সরাইজড কটন সবনিম্ন ১ হাজার ২৫০ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিল্ক, সফট সিল্ক, হাফ সিল্ক, মসলিন, অ্যান্ডি সিল্ক, জামদানি শাড়ি সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তাঁত শ্রমিকরা বলেন, ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। ব্যস্ততা বাড়লেও বর্তমানে তাদের মজুরি কম। কম মজুরি দিয়ে সংসার চলা কঠিন হয়ে উঠেছে।
তাঁত শ্রমিক মো. রশিদ বলেন, ‘আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে তাঁতের কাজ করছি। বর্তমানে তাঁতের সুতার দাম বেশি। কিন্ত কাপড়ের দাম কম। এতে করে মহাজনেরও কিছু থাকে না। আমাদেরও কিছু থাকে না। বর্তমানে এই মজুরি দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। তবু ঈদ ও বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা শাড়ি বুননের কাজ করছি।’
তাঁত শ্রমিক মুসলিম মিয়া বলেন, ‘একটা শাড়ি তৈরিতে প্রায় দুই দিন সময় লাগে। পেটের তাগিদে এই পেশা ধরে রেখেছি। মহাজনে ঠিকমতো কাপড় বিক্রি করতে পারলে আমাদের কাজ দেন। আর বিক্রি করতে না পারলে আমাদের কাজ দেন না।’
তাঁত শ্রমিক আরফান আলী বলেন, ‘আমাদের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি হয়। একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে তিন-চার দিন। বিক্রি হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। মজুরি পাই মাত্র এক হাজার টাকা। ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করে চলতে হয়।’ বেশিরভাগই এই পেশা থেকে চলে গেছে। আমি অন্য কোনো কাজ আর শিখি নাই। এজন্য আমি যেতে পারি নাই। আমাদের মজুরি বাড়ালে পরিবার নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারবো।’
দেশের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে ক্রেতারা শাড়ি কিনতে ভিড় করছেন টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী ও জেলা শহরের শোরুমগুলোতে। স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের জন্য এবং প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার জন্য পছন্দের শাড়ি কিনছেন ক্রেতারা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও শাড়ির ক্রেতা আসছেন টাঙ্গাইলের শাড়ির শোরুমগুলোতে।
ভারত থেকে আসা স্বপ্না বসাক বলেন, ‘নর্ববষ উপলক্ষে আমি স্বামীকে নিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি কিনতে এসেছি। টাঙ্গাইল শাড়ির মান ও দাম অনেক ভালো।’
ভারত থেকে আসা কিশোরী মন বসাক বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে শাড়ি কেনার জন্য এসেছি। শাড়ি দেখে আমাদের পছন্দ হয়েছে। সঙ্গে পাঞ্জাবিও কিনবো।’
ক্রেতা সুমাইয়া শিমু বলেন, ‘ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দুটি তাঁতের শাড়ি নিয়ে গেলাম। পরিবারের জন্যও তিনটি নিয়েছি। শাড়ির মান ও ডিজাইন অনেক ভালো। এজন্য প্রতি বছর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কিনতে আসি। আগের থেকে এবার দাম বেশি রাখছে। দাম একটু কম হলে ভালো হতো।’
পাথরাইল এলাকার তাঁতশিল্পের মালিক গোবিন্দ সূত্রধর বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। পাওয়ার লুমের কারণে হ্যান্ডলুমের তৈরি শাড়ি কম চলে। এদিকে হ্যান্ডলুমের শাড়ির দামও বেশি। পাওয়ার লুমের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে পাঁচশ’ থেকে সাতশ’ টাকায়। এদিকে হ্যান্ডলুমের শাড়ি তৈরি করতেই মজুরি দিতে হয় পাঁচশ’ থেকে সাতশ’ টাকা। এজন্য আমাদের শাড়ি কম চলে। তারপরও আশা করছি এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ পাশাপাশি হওয়ায় এবার বিক্রি ভালো হবে।’
টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক পলাশ চন্দ্র বসাক বলেন, ‘টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে এবার নতুনত্ব এসেছে। টাঙ্গাইল শাড়িতে যে কোনো সময়ে নতুনত্ব আনা সম্ভব। ইতোমধ্যে অনেক শাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। গরমকে বিবেচনা করে সুতির শাড়ি, মার্সরাইজড কটন এবং সফট সিল্ক শাড়িগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে।’
টাঙ্গাইল জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায় ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫ ভাগ বেশি টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হবে। ইতোমধ্যে অনেক শাড়িই বিক্রি হয়ে গেছে। ভারতের জিআই পণ্য পাওয়ায় টাঙ্গাইল শাড়িতে কোনো প্রভাব পড়েনি।’ তিনি আরও বলেন,‘তবে, বর্তমানে তাঁত ও তাঁতীর সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। জেলায় বর্তমানে ৭২ থেকে ৭৫ ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
রঘুনাথ বসাক আরও বলেন,‘এবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৭৫ লাখ পিস শাড়ি রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি আমাদের ধরে রাখতে হবে। কারণ শুধু আমাদের দেশের বাজার দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বিভিন্ন হাটের কারণে টাঙ্গাইল শাড়ির মান কিছুটা কমেছে।’
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘তাঁতীদের আমরা চলমান প্রক্রিয়ায় ঋণ দিয়ে থাকি। প্রণোদনামূলক ঋণ হিসেবে ৫ শতাংশ ঋণ সার্ভিস চার্জে আমরা তাঁতীদের সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা ঋণ দিতে পারি।’