দেশের বাজারে দিনে দিনে আলুর দাম বেড়েই চলেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন সাধারণা ক্রেতারা। তারা বলছেন, এক মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজিতে আলুর দাম ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে দাম। রোববার (২৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিন মৌসুমি ডায়মন্ডের আলু প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা দরে যা গত মাসে বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা দরে। বগুড়ার লাল আলু বিক্রি হয়েছে ৯০-১০০ টাকা দরে ও পুরাতন দেশি আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭০ টাকায় যা গত মাসেও বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকায়।
মিরপুর-১ নাম্বারের হযরত শাহ্ আলী কাঁচাবাজারে বাজার করতে এসেছেন জসীম। তিনি ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘গত মৌসুমেও আলু ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা প্রতি কেজি কিনেছি। এখন প্রতিকেজি কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকা থেকে ১০০ টাকায়। খেতে হবে তাই কিনছি। আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য এতো টাকা দিয়ে আলু কিনে খাওয়া অনেক কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
একই বাজারে এসেছেন মো. রুবেল। তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় প্রতিদিন-ই বাজার করি। গতকালকেও আমি দেশি ডায়মন্ড আলু ৬০ টাকা দিয়ে কিনেছি। একদিনের ব্যবধানে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা দাম বেড়েছে। একদিনের ব্যবধানে কেন এতো দাম বাড়লো তা বুঝতে পাচ্ছি না। এতো দামে কিনে খাওয়া মুশকিল ব্যাপার।’
ব্যবসায়ীরা জানান, গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে আলুর সার ও বীজের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে আলুর দামে। গত মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা ১৫ টাকা থেকে ১৬ টাকায় আলু কিনেছেন প্রতিকেজি। আর এবার কৃষকদের কাছ থেকে একই আলু ব্যবসায়ীরা কিনছেন ৫৬ টাকা কেজি দরে। এছাড়া, চলতি মৌসুমে প্রতিকেজি বীজ কৃষকরা ৮০ টাকা দিয়ে কিনেছে; যা গত বছর ছিল ২০ টাকা। চলতি মাসে শুরুর দিকে হঠাৎ অতি বৃষ্টির কারণে কৃষকরা আলুর বীজ লাগালেও সেই বীজের অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়। নতুন করে বীজ লাগাতে হয় তাদের। যেকারণে বর্তমানে আলুর দাম বাড়তি।
এছাড়া বাজারে এখনো সব জায়গা থেকে আলু বাজারে আসা শুরু করেনি। এখন শুধু উত্তরবঙ্গ থেকে আলু উঠছে বাজারে। এরপর জয়পুর হাট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দেশি আলু বাজারে উঠলে আলুর দাম আগামীতে কমে যাবে।
বাণিজ্যমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ থেকে ১৫ দিন আগেও আমদানি করা ভারতীয় আলু বাজারে ছিলো। তখন সব ধরনের আলু ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকায় পাওয়া গেছে। কিন্তু চলতি মাসের ১৫ তারিখে আলু আমদানি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অনেকে বলছেন, বিদেশ থেকে আলু আমদানি না হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা আলুর দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।’
রাজধানীর কাওরানবাজারের খুচরা আলু বিক্রেতা মিহির বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহ আগে আমরা দেশি ডায়মন্ড আলু ৫০ টাকা দরে প্রতিকেজি বিক্রি করেছি। বাজারে আলুর ঘাটতি রয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে দামে।’
দিনাজপুরের আলু ব্যাপারি শাহ-আলম ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে কয়েকগুণ বেশি দামে বীজ কিনে আলু উৎপাদন করছে কৃষকরা। এছাড়াও গতবার যারা ১০০ বিঘাতে আলু চাষ করেছে, তারা এবার ২৫ বিঘায় উৎপাদন করেছে। কারণ গত বছর তারা দাম ঠিকভাবে পায়নি। ফলে এবার তারা কম আলু লাগিয়েছে। যার প্রভাব আলুর দামে পড়েছে। তবে এখন শুধু উত্তরবঙ্গ থেকে আলু বাজারে যাচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যখন দেশের সব জায়গা থেকে আলু বাজারে আসবে তখন আলুর দাম কমে যাবে। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে ডায়মন্ড আলু প্রতিকেজি ৫৬ টাকায় কিনে ৫৭ টাকায় আড়ৎদারদের দিচ্ছি।’
রাজধানীর হযরত শাহ্আলী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মার্কেটের আড়ৎদার পবিত্র ভাণ্ডার-এর স্বত্বাধিকারী শিশির ঢাকা বিজনেসকে বলেন,‘আমরা দেশি ডায়মন্ড আলু ৬২ টাকায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছি। আমরা নিজেরাও ব্যাপারিদের কাছ থেকে আলু কিনে বিক্রি করি। আবার ব্যাপারিরা যে দাম দেন, সেই দামেও বিক্রি করে থাকি।’
একই মার্কেটের আড়ৎদার মেসার্স মজুমদার ট্রেডার্স-এর তত্ত্বাবধানে থাকা আবদুর রহমান বলেন, ‘কিছুদিন আগেও অনেকগুলো ট্রাক বিভিন্ন বাজারে আলু সরবরাহ করতো। কিন্তু এখন আলুর সরবরাহ কম থাকায় কম ট্রাক বাজারে ঢুকছে। ফলে একই ট্রাক একাধিক বাজারে গিয়ে আলুর সরবরাহ করছে। আলুর সরবরাহ কম থাকায় আলুর দাম বেড়েছে।’
পক্ষীফান্দা কেরানির হাট সদর, রংপুর-এর কোল্ড-স্টোরেজ গোল্ডেন বীজ হিমাগার লিমিটেড-এর ম্যানেজার জুয়েল চৌধুরী ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের কোল্ড-স্টোরেজে কোনো আলুর বীজ নেই। সব কৃষকরা নিয়ে গেছে। বৃষ্টি হওয়ায় অনেক কৃষকের জমিতে লাগানো আলুর বীজ নষ্ট হয়ে গেছে। কোল্ড-স্টোরেজে থাকা অবশিষ্ট বীজগুলো তারা নিয়ে গেছে। পাশাপাশি কোনো আলুও নেই কোল্ড-স্টোরেজে। তাই কোল্ড-স্টোরেজে রেখে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আলুর দাম বাড়ানোর কোনো অবস্থা নেই।’
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এর মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান ঢাকা বিজনেসকে বলেন,‘বর্তমানে আলুর যে দাম তা অবশ্যই অস্বাভাবিক। বর্তমানে আলু আমদানি বন্ধ রয়েছে। আমার মনে হয় আরও ১০দিন আলুর আমদানি অব্যাহত থাকলে ভোক্তাদের জন্য ভালো হতো।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘২০২১-২০২২ অর্থবছরে দেশে ১ কোটি ২ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন ও চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২০২৪) আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছর শেষে বোঝা যাবে আলুর উৎপাদনের পরিমাণ।চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৫ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন আলু বিদেশ থেকে আমদানি হয়েছে।’
বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা হায়দার আলি ঢাকা বিজনেসকে বলেন,‘বর্তমানে আলুর আমদানি বন্ধ রয়েছে। এখন আলুর মৌসুম। তাই এখন আলু আমদানি করা হবে না। তবে আলুর দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়া উচিত।’
ঢাকা বিজনেস/এমএ/