পদ্মা সেতু উদ্বোধনের একবছরের মধ্যেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মহাকর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সেতুর কল্যাণে রাজধানীর সবচেয়ে কাছের বন্দর হওয়ায় মোংলা হয়ে পোশাক শিল্পের বিভিন্ন পণ্যও যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বেড়েছে গাড়ি আমদানি। এছাড়া বন্দরের আশেপাশে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। চাপ সামাল দিতে মোংলাবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের উন্নয়ন, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন, কন্টেইনার ইয়ার্ড সংস্কার, বন্দরের পশুর চ্যানেলের ইনার বারে ২৩ কিলোমিটার ড্রেজিং ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নসহ নানা ধরনের অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ এগিয়ে চলছে। পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে অর্থনীতিতে সূচনা হয়েছে এক নতুন অধ্যায়ের। বিশেষ করে পাল্টে গেছে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনমান।
মোংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের উপ সচিব মো. মাকরুজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা সেতু উদ্বোধনের একবছরের মধ্যেই দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের গতি এসেছে। এখন রাজধানীর সবচেয়ে কাছের বন্দর হওয়ায় মোংলা হয়ে পোশাক শিল্পের বিভিন্ন পণ্যও যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এছাড়া এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর কল্যাণে মোংলা বন্দর থেকে গত বছরের ৬ জুন প্রথম গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয় ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে। এরপর ৭ জুলাই দ্বিতীয় চালান, চলতি বছরের ৫ মে তৃতীয় চালান, ৬ জুন চতুর্থ চালান গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়। এছাড়া ডেনমার্ক ও ব্রিটেনেও গার্মেন্টস পণ্য গেছে পদ্মা সেতু চালুর পর। পাশাপাশি ভারত, নেপাল ও ভূটানকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে মোংলা বন্দর।’
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর মোংলা বন্দরের আধুনিকায়নে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বন্দরের ড্রেজিং ব্যবস্থা উন্নয়নে ৭৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বান্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে বন্দররের পশুর চ্যানেলের ইনার বারে জয়মনি ঘোল থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হচ্ছে। চ্যানেলটির ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে ৯ দশমিক ৫০ মিটার থেকে ১০ মিটার গভীরতার কন্টেইনারবাহী জাহাজ সরাসরি জেটিতে ঢুকতে পারবে।’
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বন্দরে কন্টেইনার রাখার স্থান বাড়ানোর জন্য প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে কন্টেইনার ইয়ার্ড, যার ধারণক্ষমতা হবে ১ হাজার ৫০টি। এছাড়া মোংলা বন্দরে অবস্থান করা বিদেশি জাহাজে, বন্দর এলাকার শিল্প অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য জরুরি বার্তাসেবা কার্যক্রমের উন্নয়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বন্দর চ্যানেলে প্রবেশ করা প্রতিটি জাহাজ তদারকির পাশাপাশি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সহজ হবে।
এ ছাড়াও, ৪৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোংলা বন্দরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে বন্দরে চলাচলকারী বিভিন্ন বাল্ক, কন্টেইনার, ট্যাংকার ও অন্যান্য জলযান থেকে নিঃসৃত তেল ও পেট্রোলিয়াম বর্জ্যসহ অন্যান্য অর্বজনা সংগ্রহ করা সহজ হবে এবং একই সঙ্গে পশুর চ্যানেল ও বন্দরের আশেপাশের নদ-নদীতে বিভিন্ন জাহাজ থেকে নিঃসৃত তেল অপসারণ সহজ হবে। এর ফলে মোংলা বন্দর এলাকায় সামুদ্রিক দূষণ কমাসহ বন্দর ও চ্যানেল এলাকার পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর মোংলা বন্দরের ওপর চাপ বেড়েছে। এই চাপ সামাল দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বন্দর উন্নয়নে ৬ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার ১০টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের আওতায় ১২টি কম্পোনেন্টের মধ্যে রয়েছে, বন্দর জেটিতে ১ ও ২ নং কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মান, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ইয়ার্ড নির্মান, কন্টেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণ, ইয়ার্ড শেড, নিরাপত্তা দেয়াল অটোমেশন ও অন্যান্য অবকাঠামোসহ বন্দরের সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ, সার্ভিস ভেসেল জেটি শেড ও অফিস নির্মাণ, বন্দর প্রশাসনিক ভবন সম্প্রসারণ, এমপিএ টাওয়ার, পোর্ট রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্স কমিউনিটি সুবিধাদি নির্মাণ, ইকুইপমেন্ট ইয়ার্ড, ইকুইপমেন্ট শেড ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ এমটি পুল নির্মাণ, সিগনাল রেড ক্রসিং ও ওভারপাস নির্মাণ, বিনোদন ব্যবস্থাসহ বাঁধ নির্মাণ এবং ৫টি হারবার ক্রাফট কেনা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সময় ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা এখন মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বর্তমানে মোংলা বন্দরের নিজস্ব জমিতে ১১টি এলপিজি কারখানা, ৫টি সিমেন্ট কারখানাসহ আরও ১০টি শিল্পকারখানা রয়েছে। এছাড়া বন্দর এলাকায় ২৫৮ একর জমিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেপজা) রয়েছে। এসব শিল্প কারখানার কাঁচামাল মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে আসছে। ফলে বাণিজ্যিক স্বার্থেই বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পদ্মাসেতু ও খুলনা-মোংলা রেলসেতু এবং রামপাল মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ায় মোংলা বন্দর কেন্দ্রিক দেশের শিল্প-বাণিজ্যের অমিত সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সূচিত হয়েছে।’
ইতোমধ্যে এই বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে মোংলা বন্দরের প্রতি। এতে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে গোটা বন্দর এলাকা।
মোংলাবন্দর উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, ‘মোংলাবন্দরকে ঘিরে বর্তমান সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। পদ্মা সেতু থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬ লেন বিশিষ্ট সড়ক ও মোংলা বন্দরের সঙ্গে এ বছরই রেল যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে, মোংলা ইপিজেড সম্প্রসারণ, স্পেশাল ইকোনমি জোন স্থাপন, রূপসা নদী ও মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্যতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিগত জোট সরকারের আমলে মোংলা মৃত বন্দরে পরিণত হয়েছিল। সেখান থেকে বর্তমান সরকার এ বন্দরকে টেনে তুলেছে। বন্দর ঘিরে এখন শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন বন্দরে গতি এসেছে। এখন প্রতিদিনই ৪০ থেকে ৫০টি জাহাজ এ বন্দরে আসছে।’
মোংলাবন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী এইচ এম দুলাল বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের জন্য আর্শিবাদ হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব এখন ১৭০ কিলোমিটার। যেখানে ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার। এ ক্ষেত্রে তাদের সময় এবং অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়া মোংলা বন্দরে জাহাজ হ্যান্ডলিং দ্রুত ও নিরাপদ হওয়ায় বিদেশি ব্যবসায়ীরাও এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হওয়ায় এই বন্দরটিতে এখন চাপ বেড়েছে।’
ঢাকা বিজনেস/এইচ