২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



বিশেষ প্রতিবেদন
প্রিন্ট

সোনামসজিদ বন্দর: দরকার রাস্তার উন্নয়ন-ফায়ার স্টেশন-হাসপাতাল

উদয় হাকিম, সোনামসজিদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) থেকে ফিরে || ১৯ জুন, ২০২৩, ০৮:০৬ পিএম
সোনামসজিদ বন্দর: দরকার রাস্তার উন্নয়ন-ফায়ার স্টেশন-হাসপাতাল সোনামসজিদ স্থলবন্দরে প্রতিবেদক


সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক ঢুকছে বাংলাদেশে। অথচ বন্দর থেকে জেলা শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ কিস্বা রাজশাহী যাতায়াতের রাস্তা খুব সরু। বিশেষ করে বন্দর থেকে জেলা শহর পর্যন্ত রাস্তা স্থলবন্দরের উপযোগী নয়। এ রাস্তার উন্নয়ন প্রয়োজন। বন্দরে একটি ফায়ারসার্ভিস স্টেশন, বিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগার ও হাসপাতাল স্থাপন জরুরি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা শিবগঞ্জ। উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে ছোটসোনা মসজিদ সংলগ্ন সীমান্তে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনামসজিদ। সীমান্তের ভারতীয় অংশ পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায়। 

সরেজমিনে দেখা গেলো,  কর্মব্যস্ত একটি বন্দর। ভারত থেকে লাইন ধরে ঢুকছিল মালবোঝাই ট্রাক। পণ্য খালাস ও অন্য সব মিলিয়ে চলছিল কর্মযজ্ঞ। যাত্রী পারাপারও হচ্ছিল। ভারতীয় অংশ থেকে মালবোঝাই ট্রাকগুলো ছাড়পত্র নিয়ে অতিক্রম করছিল শূন্যরেখা। বাংলাদেশের চেকপোস্টের লোকজন ডকুমেন্ট চেক করে ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছিলেন। দ্রুততার সঙ্গেই কাজ হচ্ছিল। ট্রাকগুলো যাচ্ছিল পানামা সোনামসজিদ পোর্ট লিঙ্ক এরিয়াতে। সেখানে মালামাল খালাস করে ভারতীয় ট্রাক ফিরে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের ট্রাকে লোড হয়ে পণ্য চলে যাচ্ছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায়। 

বন্দরের ভারতীয় অংশে রাস্তা ভালো। তবে সেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো স্থাপনা নেই। অস্থায়ী ছাউনিতে চলছিল কার্যক্রম। জানা গেল, চারকোটি রুপি বরাদ্দ হয়েছে স্থাপনার জন্য। সমস্যা হলো জিরো পয়েন্টে একটি গেট রয়েছে। যাকে স্থানীয়রা ‘দখল গেট’ বলে। ওই গেটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি ১৭ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে ওই পথ দিয়ে পূর্ববাংলা দখল করতে এসেছিলেন। সেজন্য গেটের নাম ‘দখল গেট‘। ওই সরু গেট দিয়েই এখনো ট্রাকগুলো বাংলাদেশে আসে। ফলে ট্রাকের লাইন দীর্ঘ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রয়োজনে ওই গেট অক্ষত রেখে একটি বিকল্প পথ বা বাইপাস সড়ক তৈরি করে যান চলাচল সহজতর করা। সেজন্য প্রয়োজনীয় জায়গাও আছে।


সোনামসজিদ স্থলবন্দরের বাংলাদেশ অংশে ইমিগ্রেশন অফিস

জিরো পয়েন্ট থেকে দুই দেশের শূন্যরেখা কিছুটা উঁচুতে। এলাকাটি বরেন্দ্র অঞ্চল বলে পাহাড়ি ভূমিরূপ বিদ্যমান। সাইনবোর্ড দিয়ে চেকপোস্টে সরকারি লোকজন বসে। যাত্রী-পারাপারে ভিসা, পাসপোর্ট চেক করা হচ্ছিল। 

মধ্য জুনের তপ্ত রোদে অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছিল। গুগল দেখাচ্ছিল তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ফিলিং লাইক ৫১ ডিগ্রি। সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী জামাল ভাই, ভিসতা ইলেকট্রনিক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকমান হোসেন আকাশ ও স্কটল্যান্ডের সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর।

ইমিগ্রেশনে অফিসে গিয়ে দেখলাম যাত্রীর সংখ্যা কম। তবে ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো। যাত্রীদের বসা ও সেবার মান সন্তোষজনক। যাত্রী হয়রানির কোনো চিহ্ন চোখে পড়লো না। অন্যান্য স্থলবন্দরের চেয়ে এক্ষেত্রে সোনামসজিদ এগিয়ে। 

দিনটি ছিল শনিবার। অফিসিয়ালি ছুটির দিন। কাস্টমস কর্মকর্তা প্রভাত কুমার সিংহের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তার অফিসে। শুনলাম তিনি বিকেল তিনটার দিকে অফিসে আসবেন। মিস করলাম। 

এরপর গেলাম পানামা অফিসে। ২৫ বছরের জন্য বন্দরের কন্টেইনার বা মালামাল হ্যান্ডলের দায়িত্ব পেয়েছে পানামা সোনামসজিদ পোর্ট লিঙ্ক লিমিটেড। ২০০৬ সালে থেকে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কথা হলো পোর্ট ম্যানেজার মো. মইনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ১৯.১৩ একর জায়গা নিয়ে তারা বন্দরের পণ্য আমদানি-রপ্তানির কাজ করছেন। আরও ২২ একর জায়গার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি সরকার গ্রহণ করে ব্যবস্থা নিলে আমদানি-রপ্তানি ব্যাপক গতি পাবে। রাজস্ব বাড়বে। 

পোর্ট ম্যানেজার জানান, প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ ট্রাক পণ্য লোড-আনলোড হয়। ৬ শতাধিক শ্রমিক বন্দরে কাজ করেন। প্রস্তাবিত ২২ একর জায়গা পেলে প্রতিদিন হাজার খানেক ট্রাক লোড-আনলোড করা যাবে। বর্তমানে তাদের রাজস্ব আসে বছরে ৮০০ কোটি টাকার মতো। হাজার খানেক ট্রাক প্রতিদিন হ্যান্ডেল করা গেলে রাজস্ব বেড়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হতে পারে। 


সোনামসজিদ স্থলবন্দর। পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে আসছে, ভারতে যাচ্ছে

মইনুল ইসলাম চারটি সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। বন্দর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তা খুব সরু। মালবোঝাই দুটি ট্রাক ক্রস করতে সমস্যা হয়। লোড নিয়ে রাস্তায় চলায় এবড়ো-থেবড়ো হয়ে গেছে সড়ক। 

দ্বিতীয়ত, বিএসটিআইয়ের একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করা দরকার। এখন রাজশাহী যেতে হয় পণ্য পরীক্ষা করানোর জন্য। সময় নষ্ট হয়। খাদ্য ও খাদ্য পণ্য, ফিড ও পশুপাখীর খাবার পরীক্ষায় বিএসইটিআইয়ের সনদ লাগে।  

তৃতীয় সমস্যা হলো, এখানে একটি হাসপাতাল দরকার। শ্রমিক, ট্রাকচালকদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। সমস্যা হয় ভারতীয় ট্রাকচালক ও শ্রমিকদের নিয়ে। তারা ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া মালামাল খালাস করতে আসেন। বাংলাদেশের ভেতরে তারা কেউ অসুস্থ হলে শিবগঞ্জ উপজেলা ক্লিনিকে পর্যন্ত নেওয়া যায় না; যদি অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাদের আটক করা হয়- আইনগতভাবে কিছু করার থাকে না। 

চতুর্থ সমস্যা হলো, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন দরকার। একবার ব্লিচিং পাউডারের একটি গাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছিল। কোটি কোটি টাকার মালামাল-সব অরক্ষিত। ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে ২০ কিলোমিটার দূরে শিবগঞ্জে। 

সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে এখন আমদানি হয়, পাথর, কয়লা, ফল, কসমেটিকস, পেঁয়াজ, ভুট্টা, মশলাসহ কৃষিপণ্য, ভূষি, খৈল, ফেব্রিক্স, কসমেটিকস ইত্যাদি। আগে সিগারেট, নিউজপ্রিন্ট, গুঁড়োদুধ আমদানি হতো, এখন বন্ধ। ইলেকট্রনিক্স পণ্যও এই বন্দর দিয়ে আমদানি করতে কোনো বাধা নেই। এখান দিয়ে রপ্তানি হয় পাট ও মাছ। 

সোনামসজিদ বন্দরে ট্যাক্স আদায় কিছুটা কমে গেছে। আমদানি রপ্তানির ভলিউম এখন কিছুটা কম। জানা গেলো, ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে গেছে। 


শিবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পণ্যবোঝাই ট্রাক যাওয়া-আসা করছে


রাস্তার খারাপ অবস্থা নিজ চোখেই দেখছিলাম। আমরা যাওয়ার সময় দেখলাম, শিবগঞ্জে কিছু লোক রাস্তার পাশে জড়ো হয়েছিল। প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। কারণ, গরমে রাস্তার বিটুমিন গলে ট্রাকের চাপে এবড়ো-খেবড়ো। ওই রাস্তা দিয়ে স্থানীয় লোকজনের চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। দুর্ঘটনা ঘটছিল। মোটরসাইকেল চালক এবং অটো-ভ্যান চালকরা বেশি সমস্যায় পড়ছিলেন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ৪ লেন বা ৬ লেন রাস্তা তৈরি করা হোক। ২০০৪ সালে যেরকম দেখেছিলাম,  রাস্তার অবস্থা দৃশ্যত সেরকমই। খারাপ লাগলো সড়কের দুপাশে অসংখ্য গাছ কাটা হয়েছে। গাছের গুড়ি পড়ে ছিল রাস্তার পাশে। 

আমদানি-রপ্তানি পণ্যের পাশাপাশি আরেও দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো। সুস্বাদু আমের এলাকা হিসেবে সবাই রাজশাহীকে বুঝি। প্রকৃতপক্ষে আমের রাজধানী হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট। যা স্থলবন্দরের কাছেই। ওই রাস্তা দিয়ে আমবোঝাই ট্রাক চলে যায় দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। এছাড়া ওই এলাকায় প্রচুর ফসলও হয়। সেসব ফসল পরিবহনেও ভালো রাস্তা প্রয়োজন। 

ঢাকা বিজনেস/এনই




আরো পড়ুন