কৃষ্ণচূড়ার বুনো ঘ্রাণ, বকুলের সুগন্ধ নিয়ে বেড়ে ওঠা জীবন। শিউলি ফুল গায়ে মেখে, কাঠগোলাপের কুড়িয়ে মালা তৈরি করা জীবনে দোপাটি, সন্ধ্যামালতি নিয়ে সাঁঝবেলার রান্না বাটি পুতুল খেলা। লজ্জাবতিকে লজ্জা দিতে দিতে পথে পথে ল্যান্টেনা ফুল, পাতার, সবুজ আর পেঁকে ওঠা কাল বিচি পেড়ে নিয়ে আসা। কলাবতি ফুল ছিড়ে রঙিন পাপড়িতে স্বপ্ন প্রজাপতি প্রজাপতি খেলা।
রঙ্গনফুলের মধু খেয়ে বুনো ডুমুর, দেশি বড়ইয়ের জন্য দেয়াল টপকে নিজের বড় মামার বাংলোতে ঢুকতাম। চাইনিজ, দেশি জবাও ছিড়তাম। মূল ফটক দিয়ে কেন যেতাম না মনে নেই। দলবেঁধে চুরি করার মজাই আলাদা। সে হোক নিজের মামা। মাঝে মাঝে মামার মেয়েও যোগ দিতেন। দারোয়ান দৌড়াতে এসে আমাদের দেখে খিলখিল করে হাসতো।
লিলি ফুলে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম, ঘ্রাণ নিতাম। ওখানেও এক ধরনের মধু হয়। কোনো কোনো ল্যান্টেনাতেও মধু থাকতো। পাশে থাকা হাসনাহেনার কাছে কাটিয়ে দিতাম সময়। বর্ষায় মাঠে মাঠে জোঁক। আব্বু বলতেন, হাসনাহেনা গাছে সাপ থাকে। আমি গাছ ঘুরে ঘুরে খুব মনযোগ দিয়ে সাপের খোঁজ করেছি। আর পায়ে জোঁক ধরতো।
পাশের বাসার বদি আন্টির (বৌদি থেকে বদি। আম্মু আব্বু আন্টিকে বৌদি ডাকতো। সেখান থেকে আমি ডাকতাম বদি আন্টি) বাগানে থাকতো পূজার জন্য সাদা নয়নতারা। অপরাজিতার ঝোপ থেকে নীল নীল অপরাজিতা। অপরাজিতা সব সময় আমার ভালো লাগে।
আমার আরেকটি পছন্দ আকন্দ। এই ফুল নিয়ে যে কতবার রান্নাবাটি খেলেছি! ভাটফুলের বুনো গন্ধ এখনো মাতাল করে। কেশরাজ দিয়ে রান্নাবাটিতে ভাত রান্না করতাম। কুকশিম ফুল দিয়ে তরকারি। কখনো কখনো পাথরকুচি পাতা ছিড়ে আনা হতো! এর একটি পাতা মাটিতে রাখলে প্রতিটা কোণা থেকে চারাগাছ জন্ম নেয়। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগতো।
পুকুরের সাদা শাপলা, গাঢ় গোলাপি শাপলা ছাড়াও নীল শাপলা দেখেছি আব্বুর যখন, কুমিল্লা পোস্টিং ছিল তখন। শাপলা ফুলের মাঝখানটা আমাদের মধ্যে কেউ কেউ খেয়ে ফেলত। এরপর সারা এলাকা দৌড়ানো। সাতচারা খেলাতে সাতটি গাছের পাতা আনতে আনতে কখনো প্রেমে পড়েছি ঘাসফুলের।
আব্বুর অফিস বাসার রাস্তা পেরুলেই। বিশাল বাগানের কাছে গেলেই মালী এসে ফুল চেনাতেন। গন্ধরাজ, বেলী, কচমচ, রজনীগন্ধা, ক্রিসমাস ট্রি। গন্ধরাজ আমার খুবই প্রিয়। সুঘ্রাণের জন্য আসলেই সে রাজাধিরাজ! কচমচের রঙ দেখে প্রজাপতি আসে।
আমার মেয়েবেলার রঙিন ফুলের মেলায় নানা রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াতো। কখনো কখনো একরঙা হলুদ, সাদা প্রজাপতি ঘুরে বেড়াতো। ওদের আমার পরী মনে হতো। প্রজাপতিদের দেখে দেখে আমি রঙ শিখেছি।
গোলাপ ছিল বেশ দামি ফুল। কারও গাছে গোলাপ ফুটলে দেখতে যেতাম। আর গাদা ছিল একেবারে বোকা ফুল। ওর পাপড়ি ছিড়ে সমবয়সীদের মাথায় দিতাম যেন এটাই কোনো উৎসব।
শৈশবের ফুল নিয়ে লিখতে বসলে দাতরাঙ্গা (বন এলাচ), শ্বেতাদ্রোণ, কিংশুক মানে পলাশের ছবি মনে ভাসে। মৌলভী দাদার বাসায় ফুপুরা চাঁপাফুল বোতলে সুন্দর করে সংগ্রহ করতেন। চাঁপার ঘ্রাণে এখনো মন উতলা হয়ে আসে।
এতফুলের মাঝখানে হলুদ কলকে ফুলকে কখনো পাত্তাও দেইনি। ভাবতাম রূপ নেই, গরিব ফুল। এখন একে দেখলে শৈশবের কথায় স্মৃতিকাতর হই।