অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং পায়রা ও মোংলা সমুদ্র বন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবেলায় উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। কক্সবাজার- জেলায় ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবকরা লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য দুর্যোগ উপেক্ষা করেও কাজ করে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সকাল থেকে জেলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সকাল থেকে কক্সবাজার সদরের পৌর প্রিপারেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ে শহরের নিচু এলাকা সমিতি পাড়ার লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে চলে এসেছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গির আলম বলেন, সকাল থেকে উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসার কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে মহেশখালীর মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এবং সেন্টমার্টিনে লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে রান্না করা এবং শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান- কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মোবাইল নম্বর- ০১৮৭২৬১৫১৩২। এ ছাড়াও, সব উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে যারা আশ্রয় গ্রহণ করবেন তাদের খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হবে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৫ লাখের বেশি লোক আশ্রয় নিতে পারবে। জেলার উপকূলীয় এলাকায় রেড ক্রিসেন্টের ৮ হাজার ৬০০ স্বেচ্ছাসেবক ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তারা লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যানবাহন দিয়েও লোকজনকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
তিনি জানান- ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে অতি বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক জানান, সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। জেলা ও সব উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জরুরি ত্রাণ হিসেবে ১০ লাখ ৩০ হাজার নগদ টাকা, ৪৪০ টন চাল, ৭ টন শুকনো খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি ও ১৯৪ বান্ডিল ঢেউ টিন মজুত রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানান, চট্টগ্রাম শহর ও বিভিন্ন উপজেলা মিলিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে ১ হাজার ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা ৫ লাখ ১ হাজার ১১০ জন। জেলায় ৮ হাজার ৮৮০ জন সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তত রাখা হয়েছে। উপজেলা ও নগরীর উপকূলবর্তী ওয়ার্ড থেকে এবং পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী লোকজনকে সরিয়ে নিতে এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে বলা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়রের একান্ত সচিব আবুল হাশেম জানান, পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার ও পানিসহ আমাদের ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত। আরবান ১ হাজার ৫০০ ও রেডক্রিসেন্টের ২২০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা’য় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় চট্টগ্রাম বন্দরের সব ধরনের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব অ্যালার্ট-৪ জারি করায় ইয়ার্ড ও জেটির সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বন্দর ও মাদার ভেসেলের নিরাপত্তার স্বার্থে জেটিতে অবস্থানরত ২০টি ও বহির্নোঙ্গরের ৬০টি জাহাজকে গভীর সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চল তাদের পতেঙ্গা নৌঘাঁটিসহ সব স্থাপনা ও সরঞ্জামের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপশি ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী জরুরি অভিযানের জন্য ২টি হেলিকপ্টার ও ছোট-বড় ২১টি নৌযান প্রস্তুত রেখেছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে আজ সকাল থেকে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সকল ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী জানান, আমরা ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী তৎপরতা দ্রুত শুরু করার জন্য ২৮৪টি মেডিক্যাল টিম গঠন করেছি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার ১৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে ৫টি করে মোট ৭০টি, ২০০ ইউনিয়নে জন্য একটি করে, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ৯ আরবান ডিসপেনসারিতে ৯টি ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৫টি রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আকমল আলী ঘাট, রাসমনি ঘাট ও পতেঙ্গার উপকূলবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৪-৫ হাজার জেলে পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ ২১০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং প্রয়োজন অনুসারে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানকারী লোকজনের জন্য পর্যাপ্ত শুকনো খাদ্য, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ওরাল স্যালাইন মজুদ রেখেছে জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স তাদের ২৫ ফায়ার স্টেশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৫ জনের একটি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম শফিউল্লাহ বলেন, কেউ সমস্যায় পড়লে থানা অথবা জেলা পুলিশ কর্মকর্তাদের ফোন দেবেন। না হয় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দিলেও হবে। আমাদের টিম উদ্ধার তৎপরতা, জনসাধারণের চিকিৎসা সেবাসহ যেকোনো জরুরি সেবা দিতে তৎপর থাকবে। জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে একটি জরুরি সেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জেলার আওতাধীন লোকজনকে জরুরি সেবার জন্য ০১৩২০-১০৭৪০২, ০১৩২০-১০৮৩৯৮, ০১৩২০-১০৮৩৯৯ ও ০২-৪১৩৫৫৫৪৯ এই চারটি নম্বরে যোগাযোগ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। এসব নম্বর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। এদিকে ২৪ ঘন্টা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে সিএমপি। ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত নগরবাসীর ফোন রিসিভ করবে এবং সেই অনুযায়ী তাৎক্ষণিক সমাধানের ব্যবস্থা করবে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নম্বর সমূহ- ০১৬৭৬১২৩৪৫৬, ০১৩২০০৫৭৯৮৮, ৬৩০৩৫২, ৬৩০৩৭৫ ও ৬৩৯০২২।
ঢাকা বিজনেস/এইচ