২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার



তীব্র তাপদাহে কদর বেড়েছে হাতপাখার

সনতচক্রবর্ত্তী, ফরিদপুর || ২২ এপ্রিল, ২০২৩, ০৩:৩৪ এএম
তীব্র তাপদাহে কদর বেড়েছে হাতপাখার


ফরিদপুরসহ সারাদেশে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। টানা ১৮ দিন ধরে চলা প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। তীব্র গরমে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলছে লোডশেডিং। এতে জেলায় কদর বেড়েছে হাতপাখার। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঘুমও হারাম হয়ে গেছে পাখা তৈরির কারিগরদের। কারিগররা এখন দিনরাত সমান তালে পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত।

লোডশেডিং আর প্রচণ্ড গরমের কারণে শহর-গ্রাম সর্বত্রই হাতপাখার কদর বেড়েছে। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বেশি হওয়ায় গ্রাম-অঞ্চলে হাতপাখার কদর সবচেয়ে বেশি।

বোয়ালমারী উপজেলা সাতৈর ইউনিয়ন জয়নগর গ্রামে প্রায় ৩৫-৪০টি পরিবার তাল পাখা তৈরির টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছে। দরিদ্র এসব পরিবারের সদস্যরা হাতপাখা তৈরিকে এখন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সময়ের পরিক্রমায় গ্রামটি এখন ‘পাখা গ্রাম’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।

হাতপাখা তৈরি করে অনেকের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। আর এই পাখা শিল্পকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি দাদনচক্র। তাদের হাতে শেকলবন্দি হয়ে আছে পাখার কারিগররা। তবে স্বল্প সুদে ঋণ ও সরকারি সুযোগ সুবিধা পেলে আরও এগিয়ে যাবেন বলে মনে করছেন এসব কারিগররা।

পাখার কারিগররা জানান, গ্রীষ্মকালে বিশেষ করে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আশ্বিন, কার্তিক ও চৈত্রসহ কয়েকটি মাসে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ এবং ভ্যাপসা গরম পড়ে। এসময় তালপাতা দিয়ে তৈরি হাত পাখার চাহিদা বহু গুণ বেড়ে যায়। প্রতি বছরই জয়নগর গ্রাম থেকে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায়সহ পার্শবতী জেলা রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরসহ বেশ  কয়েকটি জেলার তালপাখা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পাখা তৈরির উপকরণ তালপাতা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে সংগ্রহ এবং পাখা বিক্রির কাজ মূলত পুরুষরাই করে থাকেন। পাতা রোদে শুকিয়ে পানিতে ভেজানোর পর পরিষ্কার করে পাখার রূপ দেয়া হয়। এরপর রঙ মিশ্রিত বাঁশের কাঠি, সুই-সুতা দিয়ে পাখা বাঁধার কাজটা করেন গৃহবধূরা। সংসারের কাজের পাশাপাশি তৈরি করা হয় এ পাখা। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। পড়াশোনার পাশাপাশি এ গ্রামের শিক্ষার্থীরা পাখা তৈরি করে বাবা-মাকে সহযোগিতা করছেন। পাখার কারিগররা অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে।

এ গ্রামের পুরুষরা সংসারের হাল টানেন আর নারীরা গৃহস্থালির পাশাপাশি তালপাখা তৈরি করে সংসারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তবে পাখা তৈরিতে যে পরিশ্রম ও খরচ হয়, সে তুলনায় দাম পান না কারিগররা। দাদনচক্র ও বিভিন্ন এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। স্বল্প পরিশ্রমে টাকা বিনিয়োগ করে বেশি লাভে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা।

২২ বছর আগে বেকার অবস্থায় জয়নগর গ্রামে মনির উদ্দিন তারপর স্ত্রীর সহযোগিতা পাখা তৈরির কাজ শেখেন। সেই থেকে পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। সংসারে ফিরিয়েছেন সচ্ছলতা।

তিনি বলেন, ‘আমি শুধু তালপাতা নিয়ে এসে শুকানোর পর পরিষ্কার করে দেই। এরপর সাংসারিক কাজের পাশাপাশি স্ত্রী সন্তানেরা পাখাকে সুই-সুতা দিয়ে সেলাই ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করে। একজন প্রতিদিন ৪০-৫০টা পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারে।’

রাজু শেখ নামে এক কারিগর বলেন, ‘গ্রামের ৩৫-৪০টি পরিবার পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন চক্রের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তাদের পাখা তৈরি করতে হয়। সুদ দিতে লাভের একটি অংশ চলে যায়। সরকার যদি স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতো, তাহলে কিছুটা লাভ হতো।’

হাট জয়নগর পাখার কারিগর মিজানুর বিশ্বাস বলেন, ২০ বছর থেকে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি পাখা বিক্রি করি। প্রতিটি তালপাতার দাম পড়ে পাঁচ টাকা, বাঁশের কাঠি ও সুতা শ্রমিকের বেতন দিয়ে খরচ হয় সাত টাকা। প্রতিটি পাখা তৈরিতে খরচ হয় সাড়ে ১২-১৫ টাকা। প্রতি পিস পাখা ২৫-৩০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করা হয়, কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীরা ৪০-৪৫ টাকা করে প্রতিটি পাখা বিক্রি করেন।’

ঢাকা বিজনেস/এইচ



আরো পড়ুন