ঝড়ের আভাস ছিল আবহাওয়াবার্তায়। কিন্তু ঝড় বয়ে গেলো শুধু স্টেডিয়ামে। সিলেট স্টেডিয়াম দেখলো মুশফিক-তাণ্ডব। মাত্র ৬০ বলে অপরাজিত সেঞ্চুরি করে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলো মুশফিক। যে মুশফিককে সবাই ভাবতো ফুরিয়ে গেছেন, সেই মুশফিকুর রহিম নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করলেন আবারও।
মুশফিকের অপরাজিত সেঞ্চুরির ওপর ভর করে ওয়ানডেতে ইহিতাস গড়া স্কোর পেলো বাংলাদেশ। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ উইকেট হারিয়ে ৩৪৯ রানের বিশাল স্কোর গড়লো টাইগাররা। ওয়ানডেতে এর আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৩৩৮ এই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে, মাত্র ২ দিন আগে, ১৮ মার্চ, ২০২৩। তারও আগে বাংলাদেশ ৩৩৩ রান করেছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, ২০১৯ সালের ২০ জুন ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামে। তারও আগে একই বছরের ২ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশ করেছিল ৩৩০ রান, ৬ উইকেটে।
সোমবার (২০ মার্চ) শুরু থেকেই মুশফিক ছিলেন ভিষণ মারকুটে মেজাজে। নষ্ট করেননি বল। শুরুতে মনে হচ্ছিল মেরে-কেটে খেলে কিছু রান করে বিদায় নিতে চান। দ্রুত রান তুলে লড়াকু একটা সংগ্রহ দিতে চান স্কোরবোর্ডে। কারণ শুরু দিকে রান তুলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল।
বাংলাদেশ ইনিংসের শেষ ওভারটা বলা চলে সবচেয়ে উপভোগ্য ছিল। তখন বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল ৩৩৯ রান, ৫ উইকেট হারিয়ে। মুশফিক তখন ৫৬ বলে অপরাজিত আছেন ৯১ রান নিয়ে। মনে হচ্ছিল মুশফিকের সেঞ্চুরি হবে না। ওদিকে ক্রিজে তখন আরেক ব্যাটসম্যান ইয়াসির। ৬ বলে তার সংগ্রহ ৭ রান। ৫০তম ওভারের প্রথম বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হন ইয়াসির রাব্বি, ধরা পড়েন পয়েন্টে।
আসেন নতুন ব্যাটসম্যান তাসকিন। উচিত ছিল বল হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দুই ব্যাটসম্যানের জায়গা পরিবর্তন করা। তাহলে মুশফিক স্ট্রাইক পেয়ে যেতেন। কেন যে সেটি হল না তা বোধগম্য নয়। ওভারের দ্বিতীয় বল মোকাবিলা করেন তাসকিন। জোরে চালিয়েছিলেন। চার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, হয়নি। দুই রান হতে পারতো। সেটিও হয়নি। সেসব হলে মুশফিকের আফসোস থাকতো। মাত্র এক রান নিয়ে জায়গা বদল।
ওভারের তৃতীয় বলে দ্রুততার সাথে স্কয়ার লেগে খেলে এক রানকে দুই রান বানান এই দুই ব্যাটার। মুশফিক তখন ৯৩ রানে। চতুর্থ বলে চিকি শট খেলেন মুশফিক। উইকেটের পেছন দিক দিয়ে চার। ৯৭ এ মুশফিক। পঞ্চম বলে লং অনে ঠেলে দিয়ে আবারো দুই রান নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রাখেন মুশফিক। ৫৯ বলে ৯৯ রানে তিনি। বাকি একটা বল। ব্যাটে-বলে না হলে সেঞ্চুরি হবে না। আউট হলে সেটা আরো আক্ষেপের। পুরো মাঠ তার দিকে তাকিয়ে। ডাগ আউটে সহ খেলোয়াড়েরা দাঁড়িয়ে। টিভির পর্দায় সবাই উন্মুখ, কি হয়, কি হয়। কিন্তু কোনো ঝুঁকি না নিয়ে শেষ বলটা মিড উইকেটে ঠেলে এক রান নিলেন মুশফিক। পেয়ে গেলেন কাঙ্খিত সেঞ্চুরি। ব্যাট উঁচিয়ে মুশফিকের উচ্ছ্বাস। তারপর তিনি গেলেন সেজদায়।
১৪টি চার এবং দুটি ৬ দিয়ে সাজানো মুশফিকের অপরাজিত ১০০ রান। স্ট্রাইক রেট ১৬৬.৬। এ নিয়ে মুশফিকের সেঞ্চুরি ৯টি। হাফ সেঞ্চুরি ৪৩ টি।
এমন সময় মুশফিক এই সেঞ্চুরি করলেন যখন তাকে মনে করা হচ্ছে তিনি ফুরিয়ে গেছেন। টি টুয়েন্টি ফরমেটে তিনি রান পাচ্ছেন না। ওয়ানডেতেও বড় স্কোরের দেখা নেই। টেস্টেও একই অবস্থা। বুড়োর খাতায় ফেলে দিচ্ছেন ভক্ত এবং সিলেক্টররা। এমনকি এই সিরিজের ওয়ানডে শেষে চট্টগ্রামে হবে টি-টোয়েন্টি সিরিজ, সেখানেও বলা চলে ঝূঁকির মধ্যে ছিলেন তিনি। এখন নিশ্চয় সিলেক্টরগণ নড়েচড়ে বসবেন।
মুশফিকের এই সেঞ্চুরি ছিল মনোমুগ্ধকর। শুরু থেকে শেষ অবদি তিনি যেভাবে খেলেছেন এক কথায় অনিন্দ্য সুন্দর। এমন ইনিং মুশফিকুর রহিমকে কখনো টি-টোয়েন্টিতেও খেলতে দেখা যায়নি। যে স্ট্রাইক রেটে তিনি ওডিআই সেঞ্চুরি করলেন এমন স্ট্রাইক রেটে তিনি টি-টোয়েন্টিতেও ব্যাট করতে পারেন নি। খেলা দেখে মনে হচ্ছিল কেউ হয়তো তাতিতে দিয়েছেন তাকে।
এর আগে গত বিপিএলে আমরা দেখেছি রনি তালুকদার মেরে কেটে খেলেছেন। ফলস্বরূপ দীর্ঘদিন পর তিনি জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন। তৌহিদ হৃদয়ও তাই। পিঞ্চহিটার হিসেবে যোগ্য পুরস্কারও পেয়েছেন। তিনিও এখন জাতীয় দলে। হতে পারে তরুণদের দেখে মুশফিক উজ্জ্বীবীত হয়েছেন। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে এখন তিনি নিশ্চয় ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টির জন্য আবারো দেশের সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবেন। মুশফিক জেগে উঠলে, জেগে থাকলে লাভ বাংলাদেশেরই।
ঢাকা বিজনেস/এনই/ই/