‘নারী’ ‘উদ্যোক্তা’ – এই দুটি শব্দ আমাদের কাছে এখন বহুল পরিচিত। ‘নারী’ শব্দটির একটি প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ হলো অপরাজিতা।
আর কোনো উদ্যোগ গ্রহণকারীকে আমরা বলি উদ্যোক্তা। নিজে থেকে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
স্থাপন করে নিজের কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করা নারীদের বলি ‘নারী উদ্যোক্তা’। বাংলাদেশ সরকারের শিল্পনীতি অনুযায়ী ‘যদি কোনো নারী ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের একক স্বত্বাধিকারী হয় বা অংশীদারী
ব্যবসা বা কোম্পানির ৫১% শেয়ারের মালিক হয়, তবেই তিনি নারী উদ্যোক্তা বলে গণ্য হবেন।’
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা
শব্দটি শুনলেই অনেকে নাক সিটকানো শুরু করেন। কারণ আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারী
উদ্যোক্তা মানে হলো নারীদের বখে যাওয়া। আমাদের সমাজে নারীদের জন্য বরাদ্দ কেবল গৃহস্থালি
কাজ-কর্ম। অথচ একজন নারী উদ্যোক্তা আর একজন পুরুষ উদ্যোক্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
সামাজিক বাধা কাটিয়ে অনেক নারী উদ্যোক্তা তাদের কাজ দিয়ে সফলতার অনেক উচ্চ শিখরে পৌঁছে
গেছেন। এখন মানুষের মন থেকে নারী উদ্যোক্তার প্রতি অবজ্ঞা অনেকটা কেটেছে। পুরুষের পাশাপাশি
নারী উদ্যোক্তাগণ এগিয়ে যাচ্ছে তাদের কাজ দিয়ে, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।
দেশের অর্থনীতিতে নারীর
অবদান অসামান্য হলেও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও উন্নয়নে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে
হয় তাদের। নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে রয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি। এ কারণে চেষ্টা সত্ত্বেও
নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড় করাতে পারছে না অনেক নারী। এগিয়ে যাওয়ার পথে চিহ্নিত
বাধাগুলো হচ্ছে, বড় অঙ্কের ঋণ না পাওয়া, ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা, পণ্য রপ্তানিতে
বাধা, নতুন বাজার সম্পর্কে তথ্যের ঘাটতি, নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের দক্ষতার
অভাব এবং পরিবার ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে দ্বিমুখী কাজের চাপ। এছাড়া, আরও কিছু বাধা নারীদের
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
যথেষ্ট মূলধনের অভাব
নারী উদ্যোক্তার জন্য এটি
একটি বড় সমস্যা। যথেষ্ট মূলধনের অভাব যতটা না একজন পুরুষ পড়ে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি
সংকটে পড়তে হয় নারীদের। প্রথমত, নারীদের নিজেদের নামে সম্পত্তি থাকে না বা যতটুকু থাকে,
তা মর্টগেজ রেখে ঋণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে একধাপ পিছিয়ে যায় নারীরা।
দ্বিতীয়ত, ব্যাংকঋণে নারীরা
যতটুকু টাকা পায়, তা দিয়ে একটি ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। শেষ ভরসা থাকে তাদের হাতে
জমানো কিছু টাকা বা পরিবার থেকে পাওয়া কিছু টাকা। যার ফলে, একজন উদ্যোক্তা হিসেবে খুব
কম নারী নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। মূলধনের অভাব মূলধন দিয়ে সমাধান করা ছাড়া উপায়
নেই। এক্ষেত্রে, জমানো টাকা ও পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে
হবে। ব্যবসা শুরু করার পর বাংকঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়ানো যাবে।
পারিবারিক বন্ধন
আমাদের সমাজে একজন নারীর
বিয়ের পরে প্রধান কাজ হিসেবে স্বামী ও সন্তানের দেখাশোনা করাকেই বিবেচনা করা হয়। যদিও
বর্তমানে অনেকেই এই ধারণা থেকে বের হতে পেরেছে। তারা এই ধারণা থেকে বের হয়েও
চাকরিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফলে নারী উদ্যোক্তা হওয়া আর হয়ে ওঠে না। এই ক্ষেত্রে
উদ্যোক্তা হতে হলে নারীকে বিয়ের আগেই জানান দিতে হবে। বিয়ের পর উদ্যোক্তা হতে গেলে
স্বামীর পরিবারকে নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাতে হবে। তাদের সমর্থন পাওয়ার
চেষ্টা করতে হবে।
সর্বোপরি, একজন নারী উদ্যোক্তা রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলে তাকে পেরোতে হবে অনেক বাধা-বিপত্তি। ঠিক রূপকথার সেই রাজকুমারের মতো, যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে।
সীমিত গতিশীলতা
একজন পুরুষ যখন যেখানে
মন চায় যেতে পারে, যে কারও সঙ্গে সহজেই মিশতে পারে। কিন্তু একজন নারী উদ্যোক্তার জন্য
এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জের কাজ। সমাধান হিসেবে আপনি আপনার পরিবারের সদস্যদের সাহায্য
নিতে পারেন। আপনার ভাই কিংবা স্বামী হতে পারে আপনার ব্যবসার পার্টনার। আশার কথা বর্তমানে
অনেক নারী উদ্যোক্তা এটিকে আর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করছে না।
উদ্যোক্তা হতে হলে আপনাকে
অনেক শিক্ষিত হতে হবে, এই কথা ঠিক নয়। কিন্তু ন্যূনতম শিক্ষা ছাড়া একজন নারীর উদ্যোক্তা
হওয়া অনেক কঠিন। নারী যতটুকু পড়াশোনা করেছে, ততটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু ওই নারী
যে বিষয়ের ওপর উদ্যোক্তা হতে চায়, সে বিষয়ে ভালোভাবে জেনে-বুঝে নিতে হবে।
ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কম
আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত
অর্থ সংস্থানের উপায় হিসেবে একটি নির্দিষ্ট আয়ের চাকরি খুঁজে থাকেন। উদ্যোক্তা হতে
হলে যে ঝুঁকি নিতে হয়, তা তারা নিতে চায় না। এর যথেষ্ট কারণও আছে। এরপরও যদি কোনো নারী
উদ্যোক্তা হতে চায়, তাহলে ঝুঁকি নিতেই হবে। এক্ষেত্রে কম ঝুঁকির ব্যবসায় মনোনিবেশ
করা যেতে পারে।
একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে
সফলভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে তাকে বেশ কিছু ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। আমাদের সমাজে সফল
ব্যবসায়ীর তালিকায় নারীর সংখ্যা খুব একটা নেই বললেই চলে। তাই আত্মবিশ্বাসকেই
হাতিয়ার হিসেবে নিতে হবে। কারও যদি আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে, তাহলে তার পণ্য
বা পরিষেবাকেও কেউ বিশ্বাস করবে না। বিনিয়োগকারীরা তার সঙ্গে বিনিয়োগ করবে না। এমনকি
তার অধীন কর্মীরাও তার সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না। তাই উদ্যোক্তা
নারীকে হতে হবে প্রবল আত্মবিশ্বাসী।
নারী উদ্যোক্তাদের কাজ
অনেকাংশেই সহজ করেছে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। ২০১৭ সাল থেকেই অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তা
কার্যক্রম পরিচালনা করছে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে
তাদের সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১২ লাখ। তবে সংগঠনটিতে প্রায় চার লাখ নারী উদ্যোক্তা ই-কমার্সের
মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
অনেকেই হয়তো বা সরকারের
নিবন্ধন কাঠামোর মধ্যে নেই। কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে এসব
উদ্যোক্তা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। গ্রাম পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর
ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে উই। সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্যকেন্দ্রিক উদ্যোক্তাদের
এ প্ল্যাটফর্ম এখন সারা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয়।
সর্বোপরি, একজন নারী উদ্যোক্তা
রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলে তাকে পেরোতে হবে অনেক বাধা-বিপত্তি। ঠিক রূপকথার সেই
রাজকুমারের মতো, যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে।
লেখক: আর জে, শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মী