নাফিসের, কাকলীর জন্মও সেখানে। ছেলে এখন বিশাল বড় ব্যাংক কর্মকর্তা। নিজের গাড়ি, ফ্ল্যাট সব হয়েছে। নিজের মতো করে স্বজনদের নিয়ে থাকার অধিকার তার থাকা উচিৎ। আজফর আলী কোনোদিনও সে অধিকারে ভাগ বসায়নি। বসাতো না। কিন্তু বিপত্তিটা বাধালো লুৎফা। ছেলে চাকরি হওয়ার পর ঢাকায় স্থায়ী হয়। তারপর বিয়ে করে সংসার শুরু করে। আজফর আলী দোয়া করেছে। গ্রাম থেকে এটা ওটা এনে ছেলেকে দিয়ে গেছে। কখনো ছেলের সংসারে এসে ঠাঁই খোঁজার চিন্তা করেনি। গ্রামের খোলা হাওয়ায় বেড়ে উঠা মানুষ। শহরের কৈতরের খুপের জীবনে তার রুচে না। পোষায়ও না। এখানকার মাছে আষ্টের গন্ধ আছে, মায়াময় স্বাদ নেই। এখানকার সবকিছুই মেকি। বড্ড কৃত্তিম। এখানে মানুষ হাসে কেবল হাসার নিয়মে। এসবে সে মানিয়ে নিতে পারে না। নিতে পারার প্রশ্নও হয়তো উঠত না কোনোদিন। সে নিজেও চায়নি।
কিন্তু লুৎফা বেগম মরে গিয়ে তাকে বড্ড একা করে দিয়ে গেল। বয়সের সাথে সাথে নানা অসুখ বিসুখ দানা বাঁধল। সময় একসময় টেনে এনে ছেলের সংসারে আশ্রিত বানালো। সে কখনো এ জীবন চায়নি। একা চলতে পারে না বলে বাধ্য হয়ে ছেলের কাছে চলে আসতে হলো। ছেলের ঘরের এ আশ্রয় বড় নড়বড়ে। পরিত্যাক্ত খাস জমিতে বানানো প্লাস্টিকের ছাওনির মতো। আজ এই মেহমান আসেতো আজফর আলীকে বাসা ছাড়তে হয়। কাল সেই উৎসবে ছেলে বেড়াতে চলে গেলে তাকে একা বাসায় না খেয়ে থাকতে হয়। ঈদ, পূজা পার্বণের ছুটিতে তার সে কষ্ট আরও বেড়ে যায়। ছেলে বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ী বেড়াতে যায়। আজফর আলীর না আছে যাওয়ার কোনো যায়গা, না নিজে নিজে কিছু রেধে খেয়ে বেঁচে থাকার মুরোদ। তবু ছেলেকে কখনো বলে না, আমাকেও সাথে নিয়ে যা। বলে না, আমার কষ্ট হয়। এতটুকু কষ্ট তবু হয়ে থাকুক পৌরষের সম্ভ্রম। তিনি অনাগত অতিথি হয়ে কোথাও যেতে চান না।
নিজে ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না। কোন অষুধ কখন খাবেন তা ঠিক রাখতে পারেন না। তবু তাকে মাথা গুঁজার জন্য যেতে হয় এক হোটেলে। সেখানে অবশ্য থাকার খাওয়াটা নিয়মিত পাওয়া যায়। একটা ছেলে এসে দিয়ে যায়। সেখানে কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে আসতে হয় চোরের মতো। আসতে আসতে প্রার্থণা করেন যেন এসেই ছেলের বউ এর মুখ দেখতে না হয়। লাল চোখে কটমট করে তাকায় বেটি। যেন দরজার সামনে উপদ্রব এসে হাজির। এখনি তাড়ানো গেলে বেঁচে যায়।
ছেলের বউ আজকাল আর তাকে আব্বা ডাকে না। ভদ্রতা করেও না। কখনো কথা বলার দরকার হলে আরেক দিকে তাকিয়ে নাম পুরুষ সম্বোধনে কথা সারে।
আজফর আলী মেয়েটার এমন আচরণ দেখে অবাক হয়। এই মেয়ের তার ছেলের বউ হওয়ার কথা ছিল না। তাদের বাড়ির বউ এমন বাড়ি থেকে এর আগে কখনো আসেনি। ছেলে প্রেমে পড়ে দিওয়ানা হয়েছে বলে বাবা হয়ে বাধা দেননি। ছেলের সুখকেই বড় করে দেখেছেন। আজ এই মেয়েই সংসারের মূল। যে সংসারে আজফর আলী অনাহূত আগন্তুক। অথচ তার আরও কিছুটা সম্মান প্রাপ্য ছিল। প্রাপ্য ছিল আরেকটু স্বাভাবিক আচরণ। মেয়েটার ভদ্রতাবোধ দিন কি দিন লোপ পাচ্ছে। আজকাল আর মুখেও কিছু আটকায় না।
চলবে...