১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, বুধবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

ঈশ্বর কেন মানুষ সৃষ্টি করলেন

আবু মকসুদ || ০১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০১:০২ এএম
ঈশ্বর কেন মানুষ সৃষ্টি করলেন



মানুষ কেন জন্ম নেয়? কেবল বড় হয়ে মারা যাওয়ার জন্য? না কি তার অস্তিত্বের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীরতর সত্য? ঈশ্বর কি নিঃসঙ্গতা কাটাতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, না কি মানুষ তাঁর সৃষ্টির এক অনিবার্য প্রকাশ?

বলা হয়, ঈশ্বরের অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে মানুষের সঙ্গই তাঁর নিকটতম। কিন্তু কেন? ঈশ্বর কি কেবল কাছ থেকে ভালোবাসা ও বন্দনা প্রত্যাশা করেন, না কি মানুষের মধ্যে এমন কিছু সঞ্চার করেছেন যা তাঁকেই প্রতিফলিত করে? 

যদি মানুষের প্রকৃত কাজ শুধু ঈশ্বরের বন্দনায় সীমাবদ্ধ হতো, তবে তার জীবন এত বহুমাত্রিক হতো না। বরং মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক সৃষ্টিশীল অভিযাত্রার অংশ, যেখানে সে চিন্তা করে, গঠন করে, পরিবর্তন আনে।

মানুষ কি কেবল বংশবিস্তারের জন্য জন্মায়? সমাজ কি কেবল ধর্ম, বিবাহ ও সন্তান প্রতিপালনের অনিবার্য নিয়ম মেনে চলে? না, এগুলো জীবনের একটি অংশমাত্র। মানুষ তার সত্তার গভীরে সৃষ্টিশীলতা বহন করে, নতুন কিছু গড়ে তোলে, সত্যের সন্ধানে অজানাকে জানার চেষ্টা করে। সমাজ বিনির্মাণ, কল্যাণের জন্য সংগ্রাম, ন্যায়বিচারের সন্ধান—এসবই মানুষের প্রকৃত কাজের অংশ। মানুষ যদি কেবল সংসারধর্মে আবদ্ধ থাকতো, তবে সভ্যতা এগোতো না, সাহিত্য-শিল্পের জন্ম হতো না, দর্শন ও জ্ঞানের বিকাশ ঘটতো না।

মানুষ ঈশ্বরের অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে নতুন কিছু সৃষ্টি করে। শিল্প, সংগীত, বিজ্ঞান, আবিষ্কার এসব তার অস্তিত্বের প্রকাশ। সে দুর্ভাগ্য ও সীমাবদ্ধতা ভেদ করে সামনে এগোয়। সে শুধু ঈশ্বরকে খোঁজে না, বরং নিজের ও সমাজের অর্থও খুঁজে পেতে চায়।

মানুষ বিদ্রোহী হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সংগ্রাম করে, বিপ্লব ঘটায়। তার অস্তিত্ব শুধুই ধর্ম, সংসার, সন্তান-লালনপালন বা মৃত্যুতে সীমাবদ্ধ নয়। সে সম্পর্ক গড়ে তোলে—প্রেম, বন্ধুত্ব, সহানুভূতি ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। সে ভুল স্বীকার করে, আত্মসংশোধন করে, পূর্বপুরুষের শিক্ষাকে ধারণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত পৃথিবী রেখে যেতে চায়।

তবে এই সত্যের বিপরীত দিকও আছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই কোনো গভীর অর্থে সৃষ্টিশীল নয়। ৯৯% মানুষ কোনো নতুন কিছু তৈরি করে না, জ্ঞানের সন্ধানে যায় না, সংগ্রাম কিংবা প্রতিরোধে সামিল হয় না। তারা কেবল নির্দিষ্ট এক ছকে বাধা জীবনযাপন করে—শিক্ষা নেয়, চাকরি করে, সংসার গড়ে, সন্তান প্রতিপালন করে, তারপর একদিন মরে যায়।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, যদি অধিকাংশ মানুষের জীবন এমন নিরর্থক ছন্দে আবদ্ধ থাকে, তবে জন্মের প্রয়োজন কী?

উত্তর হলো জীবন কখনো মূল্যহীন নয়। কারণ জীবন শুধু বিশাল কিছু অর্জনের জন্য নয়, বরং যেভাবে বেঁচে থাকা হয় সেটাই আসল। সমাজ বদলানোর জন্য বা ইতিহাস রচনার জন্য সবাই জন্মায় না, কিন্তু যারা নতুন কিছু সৃষ্টি করে, তারা বাকি ৯৯% মানুষের জীবনকে বদলে দেয়। বড় কিছু করা বাধ্যতামূলক নয়, জীবনের প্রকৃত অর্থ হলো—নিজের মতো করে বাঁচা, সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অর্থপূর্ণ কিছু করা।

একজন ছোট দোকানদার, যে দিনের শেষে পরিবারের জন্য হাসিমুখে খাবার নিয়ে ফেরে, তার জীবন কোনোভাবেই মূল্যহীন নয়। যে বাবা-মা সন্তানের জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দেয়, তার জীবনও তাৎপর্যহীন নয়। কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, সৈনিক প্রত্যেকেরই এক অনন্য ভূমিকা আছে। সবাই যদি শুধু দার্শনিক বা বিপ্লবী হতে চাইতো, তাহলে পৃথিবী চলতো না। সৃষ্টিশীলতা যেমন জরুরি, তেমনই সংসারধর্ম, প্রতিদিনের দায়িত্ব ও সংগ্রামও অপরিহার্য।

এবার ঈশ্বরের দিকে ফিরে তাকাই। কেন তিনি মানুষ সৃষ্টি করলেন?

প্রত্যেক ধর্ম ও দর্শন এই প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়। ইসলাম বলে, মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র ঈশ্বরের ইবাদতের জন্য। তবে ইবাদত মানে কি কেবল নামাজ-উপাসনা? না, এর মধ্যে ন্যায়বিচার, সৎকর্ম, দয়া ও জ্ঞানচর্চাও অন্তর্ভুক্ত। খ্রিস্টধর্ম বলে, ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর মহিমা ও প্রেম প্রকাশের জন্য। হিন্দুধর্মে সৃষ্টিকে বলা হয় লীলা ঈশ্বরের খেলা বা প্রকাশ। সেখানে মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য মুক্তি। বৌদ্ধধর্ম বলে, অস্তিত্বই কর্মফল ও কামনার ফলাফল, এবং চূড়ান্ত মুক্তিই জীবনযাত্রার উদ্দেশ্য।

কিন্তু ঈশ্বর কি কেবল বন্দনার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন? যদি তাই হতো, তবে এই সৃষ্টি এত জটিল ও বহুমাত্রিক হতো না। তাহলে প্রশ্ন আসে—তিনি কি মানুষের বন্দনা চান? যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হন, তবে কি তিনি মানুষের বন্দনা ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবেন? ঈশ্বর কি মানুষের কাছ থেকে কেবলই প্রশংসা প্রত্যাশা করেন, নাকি তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে ভালোবাসতে শেখে, অভিজ্ঞতা অর্জন করে, এবং নিজের সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করে?

অনেক দর্শন বলে, মানুষ সৃষ্টি হয়েছে জ্ঞান অর্জনের জন্য, নৈতিকতার পরীক্ষার জন্য। এই বিশ্ব এক পরীক্ষাগার, যেখানে ঈশ্বর চেয়েছেন মানুষ ভালো ও মন্দের পার্থক্য বুঝে সঠিক পথ বেছে নিক। ঈশ্বর যদি সত্যিই সৃষ্টিশীল হন, তবে তাঁর সৃষ্টিও সৃষ্টিশীল হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। মানুষ সেই সৃষ্টিশীলতারই অংশ, যে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু সৃষ্টি করে, আবিষ্কার করে, বিকশিত হয়।

তবে কেউ কেউ বলে, মানুষের সৃষ্টি কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের ফল নয়, বরং এটি প্রকৃতিগত প্রক্রিয়ার অংশ। মানুষ নিজেই নিজের অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে নেয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ঈশ্বর মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য দিয়ে তৈরি করেননি; বরং তিনি মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, যাতে সে নিজের পথ নিজেই নির্ধারণ করতে পারে।

এখন একটি মৌলিক প্রশ্ন তোলা যায়—ঈশ্বরের এই সৃষ্টিতে ফায়দা কী? যদি ঈশ্বর পরিপূর্ণ ও চিরন্তন হন, তবে তাঁর কোনো লাভ বা প্রয়োজন থাকার কথা নয়। কারণ প্রয়োজন তো সীমাবদ্ধ সত্তার জন্য প্রযোজ্য। আমরা যখন কিছু করি, তার পেছনে উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন থাকে, কিন্তু ঈশ্বর যদি চিরন্তন হন, তাহলে কি তাঁরও কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে?

তাহলে ঈশ্বর কেন সৃষ্টি করলেন?

উত্তর হতে পারে সৃষ্টি নিজেই একটি কারণ। অনেক কবি, শিল্পী বা লেখক কোনো সুস্পষ্ট লাভের আশায় সৃষ্টি করেন না, বরং সৃষ্টির আনন্দেই মগ্ন থাকেন। ঈশ্বরও হয়তো তেমনই তিনি সৃষ্টির আনন্দে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।

কিন্তু আমরা যেহেতু সময় ও কারণের সীমানার মধ্যে বাস করি, তাই আমাদের পক্ষে ঈশ্বরের "লাভ" বা উদ্দেশ্য পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। ঈশ্বর যদি সত্যিই চিরন্তন ও অনন্ত হন, তবে এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমাদের কখনোই ধরা দেবে না। হয়তো ঈশ্বরের লাভের প্রশ্নই ভুল, কারণ লাভ-ক্ষতির ধারণা কেবল মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে আসে।

মানুষ কি শুধুই ঈশ্বরের বন্দনার জন্য, নাকি তার অস্তিত্বের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি? এই প্রশ্নের উত্তর চূড়ান্ত নয়। কেউ জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সংসারের গতানুগতিক চক্রেই আবর্তিত হয়, আবার কেউ নতুন কিছু সৃষ্টি করে, সত্যের সন্ধানে বের হয়।

সবাইকে বিপ্লবী হতে হয় না, সবাইকে সমাজ পরিবর্তনের জন্য জন্মাতে হয় না। কিন্তু জীবনের প্রকৃত মানে হলো—নিজের মতো করে বেঁচে থাকা, নিজের অবস্থানের মধ্যেও কিছু অর্থপূর্ণ সৃষ্টি করা। ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন, তবে তিনি হয়তো শুধু বন্দনার জন্য নয়, বরং মানুষের আত্মবিকাশ ও সৃষ্টিশীলতার জন্যই এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।



আরো পড়ুন