আমি সবসময় জানতাম, মেরুদণ্ড থাকলেই প্রাণীরা সাধারণত জোট বাঁধে, একাত্ম হয়। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, প্রতিবাদ করে, প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন প্রাণীদের মধ্যে যেমন জেলিফিশ আছে, তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা না থাকায়, তারা একাত্ম হয় কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলতে পারবো না। তবে ধারণা করতে পারি, অন্যায় দেখলে তারাও প্রতিহত করার চেষ্টা করে।
গত কয়েকদিন ধরে আমি এক ধরনের প্রাণীর মেরুদণ্ড নিয়ে ভাবছিলাম। একসময় এই প্রাণীরা সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত ছিল, তাদের সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা হতো। কিন্তু এখন আমি গভীরভাবে সন্দিহান হয়ে গেছি, তাদের মেরুদণ্ড আদৌ আছে কি না। আজ দেখলাম, ডাক্তাররা তাদের কোনো এক সহকর্মীর নাজেহালের খবর শুনে গর্জে উঠেছে। প্রতিবাদ করছে, প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যে হয়তো মেরুদণ্ড কিছুটা অবশিষ্ট আছে।
কিন্তু শিক্ষকদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছাত্রজাগরণের পরে, ছাত্ররা যেভাবে শিক্ষকদের নাজেহাল করছে, অপমান করছে, কান ধরে উঠবস করাচ্ছে, সেই অপমানের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের মধ্যে কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। তাদের সমাজের কারিগর বলা হয়, অথচ কেঁচো সম্প্রদায়ের চেয়েও বেশি তারা মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছে—এটা আগে বুঝতে পারিনি।
শিক্ষকদের সম্মান রক্ষায় আমি গত কয়েকদিন ধরে বেশ কিছু লেখা লিখেছি। আমার মনে হয়েছে, শিক্ষকদের অপমান মানেই আমার নিজের অপমান। শিক্ষক যত নিচু স্তরেরই হোক না কেন, কোনো ছাত্র তাকে অপমান করতে পারে না। শিক্ষকদের নিম্নমান নির্ধারণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। ছাত্রদের কাজ শিক্ষকদের অপমান করা নয়। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, শিক্ষকদের সমর্থনে আমার এই প্রতিবাদমূলক লেখাগুলো আদতে কোনো কাজে আসেনি। এখন মনে হচ্ছে, শিক্ষকদের পক্ষে দাঁড়ানোটা হয়তো একটা বড় ভুল ছিল। যারা নিজেদের সম্মান রক্ষা করতে পারে না, অন্য কেউ কি তাদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে?
ছাত্ররা যখন শিক্ষকদের নাজেহাল করছে, তখন মনে হচ্ছে, এই শিক্ষকরাই হয়তো সেই অপমানের যোগ্য। মেরুদণ্ডহীন এসব প্রাণী যেন পায়ের নিচে গড়াগড়ি খায়। কিছু শিক্ষক হয়তো খারাপ, চরিত্রহীন, লোভী বা দলবাজ হতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক নিশ্চয়ই ছাত্রদের সঠিক পথে চলার পরামর্শ দেন। এই অধিকাংশ শিক্ষকের এখন প্রতিবাদে গর্জে ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা দেখছি, কুকুরও তার সম্প্রদায়ের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে, অথচ শিক্ষকেরা এত নিচে নেমে গেছে যে, তারা নিজের সম্প্রদায়ের সহকর্মীদের নাজেহাল হতে দেখেও নিশ্চুপ থাকছে।
আমি ভেবে পাচ্ছি না, বাংলাদেশের শিক্ষকদের এমন করুণ অবস্থা কেন হলো। কেন প্রতিটি শিক্ষক জীবন্ত লাশে পরিণত হলো। মেরুদণ্ড ছাড়াও কিছু প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে, যেমন কেঁচো, শামুক, মাকড়সা। শিক্ষকেরাও হয়তো মেরুদণ্ড ছাড়া বেঁচে থাকবে, কিন্তু তাদেরকে আর মানুষ ভাবতে পারছি না। এদেরকে এখন নর্দমার কীট ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না।
শিক্ষকদের এই নীরবতা কি শুধু ব্যক্তিগত দীনতার কারণে? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ? বাস্তবতা হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনৈতিকীকরণ, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শিক্ষকদের মেরুদণ্ডহীনতার মূল কারণ। শিক্ষকদের মর্যাদা ও স্বাধীনতা আজ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও স্থিতি রক্ষার জন্য বারবার নতি স্বীকার করছেন। শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা এখন এতটাই নিচে নেমে গেছে যে, নৈতিকতা ও সাহসিকতার মতো গুণাবলি তাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। এই বাস্তবতার আলোকে, শিক্ষকদের কাছে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর আশা করা এখন সম্পূর্ণ অর্থহীন।
শিক্ষকদের এই মেরুদণ্ডহীনতা এবং নৈতিকতার অভাবে, তাদের পক্ষে কারো দাঁড়ানো উচিত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যারা নিজেরাই নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে না, তাদের জন্য অন্যদের দাঁড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত? একদিকে তাদের নীরবতা আর অন্যদিকে তাদের সম্মানহীন অবস্থান—এতে করে তারা নিজেরাই সমাজে নিজেদের মর্যাদা হারিয়েছে। তাই, এমন শিক্ষকদের পক্ষে দাঁড়ানো অর্থহীন হতে পারে, বিশেষত যখন তারা নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগই নেয় না। তাদের পক্ষে দাঁড়ানো মানে হয়তো আরও বেশি করে তাদের মেরুদণ্ডহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া।
লেখক: কবি-চিন্তক