১৯ মে ২০২৪, রবিবার



টাঙ্গাইলের চমচমের জিআই স্বীকৃতি: যা বলছেন ব্যবসায়ী-কারিগররা

আব্দুল্লাহ আল নোমান, টাঙ্গাইল || ২৪ জানুয়ারী, ২০২৪, ০৬:০১ পিএম
টাঙ্গাইলের চমচমের জিআই স্বীকৃতি: যা বলছেন ব্যবসায়ী-কারিগররা


ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতি ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। ঐতিহ্যবাহী এ জনপদের লোক-ঐতিহ্য নিয়ে প্রবাদে বলা হয়, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’ টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো জানে সবাই। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। বিশ্ব দরবারে টাঙ্গাইল জেলাকে তুলে ধরার জন্য যতগুলো ঐতিহ্য রয়েছে তার মধ্যে পোড়াবাড়ির চমচম অন্যতম। এই চমচমের রয়েছে বিশ্বজুড়ে সুনাম। তাই পোড়াবাড়ির চমচমকে বলা হয় ‘মিষ্টির রাজা’। এই চমচম পেয়েছে জিআই স্বীকৃতি। এতে আনন্দিত ব্যবসায়ী ও চমচমপ্রেমীরা। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরনো ইতিহাস। ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন আর পোড়াবাড়ীর সে জৌলুস আর নেই। বর্তমানে টাঙ্গাইল মিষ্টি পট্রি হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনী বাজারের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়। 

মিষ্টি ব্যবসায়ীরা বলেন, পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার ঘ্রাণমাখা  এই মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। চমচম ছাড়াও রসগোল্লা, সন্দেশ, পানতোয়া, রসমালাই, ক্ষিরমোহনসহ নানা জাতের মিষ্টি বিক্রি হয়। 

চমচম একটি উপাদেয় মিষ্টান্ন, যা যে-কোনো বয়সের লোকের কাছে লোভনীয়। বিয়ের অনুষ্ঠান, পূজা, জন্মদিনে, পরীক্ষার ফল, চাকরির প্রমোশন, নির্বাচনে জয়ী, নতুন চাকরি, শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয় বাড়ি যাওয়ার সময় এই চমচম দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় এখনো সর্বমহলে প্রচলিত রয়েছে। মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন তৈরি হয় পোড়াবাড়ির চমচম। বেশিরভাগ দোকানের মালিক নিজেরাই এ চমচম তৈরি করেন। আবার তাদের কাজের সহায়তার জন্য রয়েছে একাধিক সহযোগী। চরাঞ্চল থেকে যে সমস্ত গাভীর দুধ আসে, সেগুলো অনেক ভালো। আর পানিরও একটা বিষয় আছে। দুধ, পানি ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয়। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। এসব কারণেই চমচম বিখ্যাত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। 

কয়েকজন মিষ্টির ব্যবসায়ী বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা। তারা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন, এর ফলে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম আরও প্রসারিত হবে। খাঁটি দুধ এবং বিশুদ্ধ নদীর পানি ব্যবহারের কারণেই টাঙ্গাইলের চমচম স্বাদ ও মানে বিখ্যাত। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণেই বেচা-কেনা আগের তুলনায় কম বলে অনেক ব্যবসায়ী জানান।  

চমচম তৈরীর কারিগর হরিলাল ঘোষ চন্দন ঘোষ বলেন, ‘ভেজাল ছাড়াই আমরা চমচম তৈরি করি। সুস্বাদু চমচম তৈরি করতে দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা লাগে। আমাদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি। এতে আমাদের আরও কাজ বেড়ে যাবে। ভেজালমুক্ত মিষ্টি বানানোর জন্য সুনাম ছড়িয়েছে দেশজুড়েই।’ 

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে মান ভেদে তিন শত থেকে চার শত টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে। মিষ্টি খেতে আসা কয়েজন ক্রেতা বলেন, পোড়াবাড়ীর চমমের স্বাদ অন্য কোনো মিষ্টির সঙ্গে তুলনা হয়। যে-কোনো টাঙ্গাইলের চমচম খেলে মুগ্ধ হয়ে যাবে।’ 

দেশের মানুষ ছাড়াও বিদেশিরাও টাঙ্গাইলের চমচম খেয়ে থাকেন। টাঙ্গাইল পাচঁআনী বাজারের চমচম খেতে দেখা মিললো ভারতীয় এক নাগরিকের। তিনি টাঙ্গাইলের চমচম খেয়ে প্রশংসা করেছেন। 

টাঙ্গাইল জেলা মিষ্টি মালিক সমিতি সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে চমচম তৈরি করায় এর স্বাদ ও মান খুবই ভালো। যার কারণে সুনাম ছড়িয়ে দেশজুড়ে। বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা টাঙ্গাইল চমচমের গুণগত মান ধরে রাখার চেষ্টা করছি। জেলায় প্রায় ৭০০-৮০০ মিষ্টির দোকান রয়েছে।’

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে টাঙ্গাইলের পোড়াড়ীর চমচমকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই শিল্পটিকে আরও সমৃদ্ধ করতে কারিগরদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্ম-পরিকল্পনার উদ্যাগ নেওয়া হয়েছে।’ 



আরো পড়ুন