ভারতবর্ষের
জাতীয় জাগরণের একটি বিশেষ সময়কে চিত্রিত করার মুহূর্তে বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক
ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) সে-যুগের প্রতীকরূপে শিক্ষাসংগঠক
ও বাঙালি সমাজসংস্কারক রামতনু লাহিড়ি (১৮১৩-১৮৯৮)কে নির্বাচন করেন। সে সময় বাগ্মিতায়,
রচনাশৈলীতে, মননের উৎকর্ষে আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তারপরও রামতনু লাহিড়িকে
কেন তিনি সে-যুগের প্রতীকরূপে অভিহিত করেছিলেন, তাঁর কারণ হলো, তাঁর চরিত্রে বাংলার
তাজা প্রাণ ও পরিশীলিত বুদ্ধির যে সমন্বয় ঘটেছিল তা ছিল অভাবনীয়। এ কারণেই অন্যদের
থেকে রামতনু লাহিড়ি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
কয়েক
দশক পরে সেই জাগরণ রীতিমতো অভ্যুত্থানে পরিণত হয়, যার প্রধান পুরুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩–১৯০২) ও শ্রী অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২–১৯৫০)-এর
মতো বিস্ময় প্রতিভা। কিন্তু সমগ্র আন্দোলনটির প্রতীকরূপে অনেকেই চিহ্নিত করেছেন বাঘা
যতীন (১৮৭৯–১৯১৫)কে– তাঁর মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর
পর্যন্ত প্রায় একটি যুগ বাংলার বিপ্লবী সংগঠনকে তিনি প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে, ব্রিটিশবাহিনীর
সঙ্গে প্রথম সংঘবদ্ধ সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধ করে আত্মাহুতি দেন, সেই মৃত্যুর ভেতর দিয়ে
স্বাধীনতা লাভের প্রকৃত মন্ত্র তিনি উচ্চারণ করেন। তাঁর সেই প্রেরণা অব্যাহত ছিল স্বাধীনতা
লাভের পূর্ব পর্যন্ত। দেশের মুক্তির অনিবার্য পথ হিসেবে বাঘা যতীনের প্রবর্তিত বিপ্লবী
সশস্ত্র কর্মপন্থাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। বাঘা যতীন এ কারণেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের
মহানায়ক হয়ে-উঠতে পেরেছিলেন।
দুঃখজনক
হলো, বর্তমান প্রজন্মের কাছে মহান বিপ্লবী বাঘা যতীন বিস্মৃত হয়ে গেছেন। যেসব বিপ্লবী
জীবন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য অদম্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের নেতা
ছিলেন বাঘা যতীন। বিশেষ করে অগ্নিযুগের দ্বিতীয় পর্বে। তাঁর নেতৃত্বে ও নির্দেশিত বিপ্লবী
পথ যুগ যুগ ধরে গণমানুষের মনে চির ভাস্মর হয়ে থাকলেও, সে তুলনায় বাঘা যতীন অনেক কম
পরিচিত ও অবহেলিত একটি নাম বর্তমানে। অবস্থাদৃষ্টে ব্যাপারটা এরকম হয়ে গেছে, পাশর্^বর্তী
নায়করাই প্রধান নায়ক হয়ে গেছেন, প্রধান নায়ক হয়ে গেছেন পার্শ্ববর্তী নায়ক–নির্মম বাস্তবতা।
বাঘা যতীনকে নিয়ে একসময় বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হলেও, তাঁকে নিয়ে নাটক-চলচ্চিত্র নির্মিত
হলেও, বর্তমানে সেগুলো দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬) তাঁকে নিয়ে
কবিতা রচনা করেছেন, উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাঘা যতীনকে নিয়ে আলোচনা
হয়েছে তুলনামূলক অনেক কম, তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সেভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপস্থাপিত
হয়নি। তাঁকে নিয়ে গান-কবিতা-নাটক উল্লেখযোগ্যভাবে সৃষ্টি হয়নি। তাঁকে নিয়ে গ্রন্থ রচিত
হয়েছে সামান্য। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর অবিশ্বাস্য দেশপ্রেম তুলে ধরার জন্য বিশেষ
কোনো উদ্যোগ বা বিশেষ কোনো পরিকল্পনা সেভাবে পরিলক্ষিত হয় না। বর্তমান সময়কালে তাঁর
বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নিয়ে নাটক-চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি।
ভারতবর্ষের
শাসন-শোষণকারীদের নাম বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবী
উপেক্ষিত রয়ে গেছেন। বর্তমান প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার জন্য বাঘা যতীনের মতো
বিপ্লবীদের জীবনাদর্শ ও কর্মকাণ্ড বিভিন্নভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনের দীর্ঘস্থায়ী
কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। যে কারণে যাঁদের রক্তে ও আত্মদানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীনতা,
তাঁদের নাম হারিয়ে যাচ্ছে, বর্তমান প্রজন্ম তাঁদের দীর্ঘকালের ইতিহাসের গভীর তেজস্বীতা
কখনোই অনুভব করতে পারছে না। এভাবেই কালে কালে জন্ম নেয়া বহু সূর্যসন্তান হারিয়ে যাচ্ছে
দেশের ইতিহাস থেকে, ইতিহাস সৃষ্টি করেও ইতিহাসে থাকছে না তাঁদের নাম। যাদের জন্য তাঁদের
জীবন দান, তারা জানছে না সেই সব মহাপুরুষদের নাম। বাঘা যতীনের ক্ষেত্রেও সেই ট্রাজিক
পরিণতিই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। বাঘা যতীনের অবিশ্বাস্য
দেশপ্রেম ছিল, অমিততেজ শক্তি ছিল, দেশের মুক্তিই ছিল তাঁর একমাত্র স্বার্থ এবং সবচেয়ে
বড় স্বার্থ। যে কারণে বাঘা যতীন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সহযোদ্ধাদের বলতে পেরেছিলেন, ‘মরব। মরে দেশের লোককে
শিখিয়ে যাব বাঁচবার মত বাঁচতে হয় কি করে! এই মৃত্যুর চেয়ে সফলতর কাম্যতর আর-কোনও সমাপ্তি
আমাদের জীবনে হত না রে!’ (পৃথ্বীন্দ্রনাথ, সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, ১৯৯০: ৪০৮) তিনি
অবিশ্বাস্য দেশপ্রেম, সুপরিকল্পিত বিপ্লব-কর্মপন্থা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে ভারতবর্ষের
ইতিহাসে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
যতীন্দ্রনাথ যেন একজন মানুষই ছিলেন তা নয়, তিনি একটি
আন্দোলনের প্রতীক ছিলেন।.. যতীন্দ্রনাথকে ব্যক্তিবিশেষ মনে করা ভুল হবে। রামমোহন হতে
বিবেকানন্দ পর্যন্ত বাঙালী জীবনে যে ভাবধারা প্রবাহিত হয়েছিল, যতীন্দ্রনাথ ছিলেন তারই
প্রতীক। (মুখোপাধ্যায়; আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ ভাদ্র, ১৩৪৪, পৃ. ১০৫ )
বাঘা
যতীনের বিপ্লব-কর্মপন্থার মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে কোন আপসরফা নয়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে
থাকা বিপ্লবীদের সংঘবদ্ধ করে সংগঠিতভাবে বিপ্লব ঘটানো। এজন্য তিনি অনুধাবন করেন বিদেশি
সাহায্য-সহযোগিতায় অস্ত্র ও অর্থ প্রয়োজন। তা বাস্তবায়নের লক্ষে তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ
করেন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিভিন্ন কর্মপন্থা
নির্ধারণ করে তা কার্যকরী করার জন্য নিজে অবিশ্বাস্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বদেশিশী
যুগের বিখ্যাত বিপ্লবী-দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায় (নরেন্দ্র ভট্টাচার্য), সান্ ইয়াৎ
সেন, লেনিন, ট্রটস্কি প্রমুখ মহামানবের সংস্পর্শে এসেও ভুলতে পারেন নি তাঁর প্রথম জীবনের
দীক্ষাগুরু যতীন্দ্রনাথকে: এঁরা সবাই মহামানব (great men); যতীনদা ছিলেন ভাল মানুষ (good
man) এবং তাঁর চেয়ে ভালো মানুষ (a
better man) আমি এখনো খুঁজে পাইনি।
মহামানবদের চাঁদের হাঁটে ক্বচিৎ আমরা ভালো মানুষদের আসন দিই। এই রেওয়াজই চালু থাকবে
যতদিন না সততা (goodness ) স্বীকৃতি পাচ্ছে সত্যকার মহত্ত্বের পরিমাপ রূপে। .. কোনও একটা যুগের গণ্ডীতে বাঁধা যায় না যতীনদাকে; তাঁর অন্তরের মূল্যবোধ
ছিল ষোল আনাই মানবীয় এবং ফল, দেশ-কালের সীমানার উর্দ্ধে। যেমন তিনি দয়ালু ও সত্যনিষ্ঠ
তেমনি ছিলেন অসমসাহসিক সন্ধিবিমুখ (uncompromising)। তাঁর সাহসিকতা হৃদয়হীন ছিল না, আর তাঁর সন্ধির
অনীহা ছিল না ক্ষমাবর্জিত। ..নিজেকে তিনি কর্মযোগী বলে জানতেন এবং সেই আদর্শই আমাদের
সকলের পক্ষে শুভঙ্কর বলতেন। ..কর্মযোগী অর্থাৎ মানবতাবাদী; যিনি বিশ্বাস করেন যে মানুষের
কর্মের মধ্য দিয়েই আত্মসিদ্ধি সম্ভব, তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করা স্বাভাবিক
যে মানুষই তার নিয়মিত স্রষ্টা।.. যতীনদা ছিলেন মানবতাবাদী, সম্ভবত বর্তমান ভারতবর্ষের
প্রথম মানবতাবাদী। (‘যতীন মুখার্জী’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ Independent
India, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯।)
বাঘা
যতীনের পারিবারিক বিপ্লববাদ চেতনা, বিপ্লবী কর্মপন্থা ও উড়িষ্যার বালেশ্বরে ব্রিটিশ-সৈন্যবাহিনীর
সঙ্গে অবিশ্বাস্য সম্মুখযুদ্ধ ও আত্মাহুতি বাঙালির জীবনে এক বিস্ময়কর ঘটনা। জাতির জীবনে
বাঘা যতীন সত্যিকার অর্থেই আশীর্বাদ ছিলেন। যখন ব্রিটিশরা এদেশকে দীর্ঘ শাসন-শোষনে
রেখে এদেশের সম্পদ নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন
বিপ্লবী সংগঠন বিপ্লব ঘটালেও মহাশক্তিধর ব্রিটিশকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য এসব
উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না। এ জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একজন বিপ্লবী নেতা, যিনি বাংলায় ছড়িয়ে
থাকা বিভিন্ন সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে সংগঠিতভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ঠিক করে সশস্ত্র
বিপ্লব ঘটাতে পারেন। পরাধীন ভারতের কাক্সিক্ষত সেই বিপ্লবী নেতা ছিলেন বাঘা যতীন। যিনি
আপাদমস্তক বাঙালি ছিলেন।
রামমোহনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আবির্ভূত হলেন এদেশের
‘আভ্যন্তরীণ ইতিবৃত্ত গঠনের সর্বপ্রধান যুগপুরুষ’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর–‘উগ্র উৎকট
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তেজীয়ান পুরুষ’। এলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঋষী বঙ্কিমচন্দ্র, রাজনারায়ণ
বসু, মাইকেল মধুসূদন, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন। এলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
এলেনবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী আর স্বামী বিবেকানন্দ। এই যে ক্ষণজন্মা পুরুষেরা একের পর এক
এসে আমাদের দিয়ে গেলেন আলোর বার্তা, এঁদেও জন্মস্থানের কোথায় কটাই বা মর্মর-ফলক পাব
আমরা, কোথায় পাব গাইড? জাতির চেতনায় নিভৃততম মহলে চির অক্ষয় এঁদের আসন। এই সাবেকী আমলের
বাড়ীতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহান বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। সেদিন ছিল অগ্রহায়ণ
মাসের একুশ; বাংলায় বারো-শ’ ছিয়াশি সাল। ইংরেজি মতে আঠারো-শ’ ঊনআশি সালের ৮ই ডিসেম্বর।
(পৃথ্বীন্দ্রনাথ, সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, ১৯৯০: ২)
বিপ্লবী
বাঘা যতীন মনে-প্রাণে ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। খেলাধুলার প্রতি ছিল সমান
আগ্রহ। বেশ অর্থ ব্যয় করে তিনি ‘কয়া থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের
ছেলেরা এখানে যেন নিয়মিত ভালো ভালো নাটক করতে পারে। ‘যে-সব নাটকে উদ্দীপ্ত হবে দেশপ্রেম,
উদ্দীপ্ত হবে তরুণদের মনের অতলে সুপ্ত বহ্নিশিখা, যে-সব নাটক গড়ে তুলবে তাদের চরিত্র।’(পৃত্থীন্দ্রনাথ,
সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, ১৯৯০: ৫৫) তিনি নিজে এসব তরুণদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার
দায়িত্ব গ্রহণ করেন। থিয়েটারের পাশাপাশি তিনি ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিদ্যাভূষণের
জাতীয়তাবাদী লেখা, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ,
স্বামী বিবেকানন্দের লেখা, বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস– এসব পাঠ করে তিনি তরুণদের
শোনাতেন। যাতে, তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। লেখালেখি করতেন খুবই কম, কিন্তু লিখতেন।
লেখার হাত ছিল। কবিতা লিখতে পারতেন। গল্পও লিখেছেন। সম্পাদনা করেছেন পত্রিকা। তাঁর
পত্রিকার নাম ‘গ্রহতারা’। প্রতি সপ্তাহে বুধবার করে বের হতো। বেশ কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়েছিল।
প্রথম সংখ্যার ভূমিকায় ছোটমামা ললিতকুমার কাগজের উদ্দেশ্যে প্রভৃতি ব্যক্ত করেছিলেন;
তিনি নিজে ভালো সাহিত্যিক ছিলেন। আর প্রথম সংখ্যার প্রথম রচনাই ছিল যতীন্দ্রনাথের ছোটগল্পটি।’
(পৃত্থীন্দ্রনাথ, সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ, ১৯৯০: ৭১)
তিনি
আন্দোলনে পুরোপুরি জড়িত হওয়ার পর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়মিত খোঁজ-খবর করতে পারতেন না।
কারণ তখন তাঁর খোঁজে ব্রিটিশ-বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যতীন তখন তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে
গোপন-অবস্থানে থেকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। ব্রিটিশ সৈন্যরা যতীনের খোঁজে
তাঁর কয়ার বাড়িতে অসংখ্যবার তল্লাশি করেছিল। তখন তাঁর সংসারের পুরো দায়িত্ব পালন করতেন
বড় বোন বিনোদবালা। ব্রিটিশ সৈন্যদের তিনি কখনো ছেড়ে কথা বলেন নি। ভয় কাকে বলে তিনি
জানতেন না। যোগ্য ভাইয়ের যোগ্য বোনই ছিলেন বিনোদবালা। যতীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে
গর্ব ও গৌরবের সূর্যোজ্জ্বল একটি নাম। যখন ভারতবর্ষে সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের
সূচনা হয়নি, তখন এ-বাংলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের সন্তান স্বাধীনতার উদগ্র কামনায় নিজে
বিপ্লবী মদলগুলোকে একত্রে সংগঠিত করে সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি
গ্রহণ শুরু করেন।
তিনি
১৯০৬ সালের ১১ এপ্রিল কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে আসেন। এটি তাঁর নিজের গ্রাম। এর আগের দিন
তিনি অফিসের কাজ সেরে রাতেই ট্রেনে কুষ্টিয়া আসেন। চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে গড়াই নদী
সাঁতরিয়ে কয়ায় আসেন। এ দিন যে তাঁর জন্য জীবন-মৃত্যুর এক সন্ধিক্ষণ অপেক্ষা করছিল তা
নিজেও জানতেন না। তিনি বাড়িতে এসেছেন জেনে পাশের রাধারপাড়া গ্রামের দুজন চাষী এসে তাঁর
সঙ্গে দেখা করে জানায় তাদের গ্রামে বাঘের অত্যাচার আর উৎপাতের কথা। তিনি সব শুনে মুহূর্ত
দেরি না করে ধুতিটা মালকোচা মেরে ঘর থেকে একটা ভোজালি নিয়ে বের হয়ে যান। রাধারপাড়া
গ্রামের মাঠ তখন আখের খেতে ভরা। বাঘ খুঁজতে খুঁজতে তিনি গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে
চলে যান। তারপর লক্ষ্য করেন আখের খেতে একটা ঝোপের আড়ালে বিরাট এক রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
বাঘ দেখেই তিনি চাপাস্বরে বাঘের কথা জানান দিতেই তাঁর মামাতো ভাই অমূল্য চট্টোপাধ্যায়
পাখিমারা বন্দুকে ট্রিগার টিপে দেন। বাঘ ক্রুদ্ধ
গর্জনে অমূল্য চট্টোপাধ্যায়ের ওপর লাফিয়ে পড়তেই বাঘা যতীন ত্বড়িৎবেগে তাকে ধাক্কা মেরে
সরিয়ে ফেলে নিজেই বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সামান্য এক ভোজালি দিয়ে একা লড়াই করে বাঘ
মেরে গোটা ভারতে তিনি রীতিমতো বিস্ময়কর খবরে পরিণত হন। বাঘ মারার এই ঘটনা স্বদেশী বিপ্লবীদের
দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল। তাঁর এ-কীর্তি ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে
তিনি প্রচণ্ড আহত হন। এজন্য তাঁকে কলকাতায় তাঁর মেজো মামা ডা. হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়
ও বিশিষ্ট ডাক্তার সুরেশচন্দ্র সর্বাধিকারীর চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। তাঁর ডান পায়ের অবস্থা
এতো খারাপ হয়ে পড়েছিল যে ডা. সুরেশচন্দ্র সর্বাধিকারী পা-টি কেটে একদম বাদ দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু মেজো মামা ডা. হেমন্তকুমার পা না-কেটে যথাসাধ্য চিকিৎসা করার কথা বলেন ডা. সুরেশকে।
কারণ তিনি জানতেন অসম্ভব মনোবলের অধিকারী তাঁর এই ভাগ্নে। যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করার
ক্ষমতা তাঁর আছে। ডা. হেমন্তকুমারের কথামতোই চিকিৎসা করেছিলেন ডা. সুরেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
ছয় মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, এরপরও কিছুদিন বাঘা যতীন ক্র্যাচে ভর করে হাঁটতেন। তারপর
তিনি পুরোপুরি সুস্থ হন। এ প্রসঙ্গে বাঘা যতীনের ছোটমামা ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের
বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য:
বিপদে পলায়ন করা যতীন্দ্রনাথের প্রকৃতিতে ছিল না–তাই
তিনি সরিয়া না গিয়া বাঘের গলা তাঁহার বাম বগলের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া বাঘের মাথায় ভোজালি
দিয়া মারিতে লাগিলেন। বাঘ আহত হইয়া যতীন্দ্রনাথকে কামড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল, তাঁহার
সহিত বাঘের রীতিমত লড়াই আরম্ভ হইল। অবশেষে তিনি মাটিতে পড়িয়া গেলেন। বাঘা সেই অবসরে
তাঁহার দুই হাঁটুতে কামড়াইয়া ও সর্বাঙ্গে নখ বসাইয়া তাঁহাকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়া দিল।
তিনি নিজের দেহের আঘাত অগ্রাহ্য করিয়া বাঘকে মাটিতে চাপিয়া ধরিয়া ছোরার আঘাতে বাঘকে
মারিয়া ফেলিলেন, কিন্তু নিজেও মৃতপ্রায় হইয়া গেলেন। তাঁহাকে তুলিয়া বাড়ী আনা হইল, ও
কলিকাতায় তাঁহার মেজমামার নিকট পাঠান হইল। সেখানে বিখ্যাত সার্জন ডাক্তার সুরেশ সর্বাধিকারী
তাঁহার চিকিৎসা করিয়া বাঘের কামড়ের ক্ষত ও বিষ হইতে তাঁহাকে বাঁচাইয়া দেন। তাঁহার দু’খানা
পা-ই কাটিয়া ফেলিবার কথা হইয়াছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহা করিতে হয় নাই।
তিনি ছ-মাস ধরিয়া শয্যাগত ছিলেন এবং ভাল হইয়াও বহুদিন
ধরিয়া তাঁহাকে স্ক্রাচের সাহায্যে চলিতে হইয়াছিল। যতীন্দ্রনাথ পরে তাঁহার মারা ঐ বাঘের
চামড়াখানি কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ তাঁহার জীবনদাতা ডাক্তার সর্বাধিকারীকে উপহার দিয়াছিলেন।
(ললিতকুমার, বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ ১৩৫৪: ৩২)।