২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার



যে কারণে হাওরে হাইব্রিড-উফশী ধানের চাষ বাড়ছে

জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া, সুনামগঞ্জ || ২৬ মে, ২০২৩, ০৭:৩৫ এএম
যে কারণে হাওরে হাইব্রিড-উফশী ধানের চাষ বাড়ছে


বোরো ফসলের ভাণ্ডারখ্যাত সুনামগঞ্জের হাওরজুড়ে এক সময় চাষ হতো  বিভিন্ন দেশি জাতের ধান।  কৃষিবিদরা বলছেন, এখন আর সেই দিন নেই। দিনে দিনে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ধানের চাহিদাও। ফলে বাধ্য হয়েই কৃষকেরা কম জমিতে বেশি ধান উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন।  তাই  এখন দেশি ধানের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ও হাইব্রিড ধানের চাষ করছেন তারা। ফলে হাওর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের ধান। 

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, এবার ছোট-বড় ১৩৫ হাওরে বোরো মৌসুমে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমি চাষ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড ৬০ হাজার ৮৬০ হেক্টর, উফশী ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৫ হেক্টর ও ১ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে দেশি জাতের ধান চাষাবাদ হয়েছে। এই হিসাবে শতকরা ২৮ ভাগ হাইব্রিড, ৭১ ভাগ উফশী ধানের চাষ হয়েছে। আর মাত্র  ১ ভাগ জমিতে দেশি জাতের ধানের আবাদ হয়েছে।

হাওরাঞ্চলের সচেতন মহল বলছে,দেশিয় জাতের ধান উৎপাদনব্যয় কম,কম সময়ে পাকে,পর্যাপ্ত পরিমাণ জিংক আছে,খেতেও সুস্বাদু,রোগ প্রতিরোধী,সার-কীটনাশক লাগে না,ভালো দাম পাওয়া যায়। তবে দেশি ধানের ফলন কম হয়।  এই কারণে কৃষকেরা কৃষি অফিসের পরামর্শে হাইব্রিড ধানচাষে ঝুঁকছেন। 

জেলার বিভিন্ন হাওর পাড়ের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে যে সব দেশীয় প্রজাতির ধানের নাম পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো: বোরো, গচি, বেগুন বিচি, বোনাভাতা, লিচুবিরণ, লাকাই,বগলা বোরো, কইয়া বোরো, জিরা শাইল,খাসখানী, বইয়াখাউরি, পাইজং, বেগম পেচি,কান্দি বোরো, জগলি বোরো, লতা বোরো, গাচমল, মাশিন, বাঁশফুল, তুলসীমালা, ঠাকরি, লাল ডেঙ্গি, চিনিগুঁড়া, সাদাগুঁড়া, কালিজিরা, কচু শাইল, দুর্বা শাইল, গবি শাইল, চিনি শাইল, দুধ শাইল, কালপাখরী, কাউলি, তায়েফ, রায়েন, আয়না মতি, গিজা বেরো, খইয়া, রাতা, সোনারাতা, বিচিবারই, বানাজিরা, টেপি, রঙ্গিলা, রঙ্গিলা টেপি, সাধু টেপি, সাদাবিরণ, কালাবিরণ, নলবিরণ,চন্দ্রী, শাইলসহ বিভিন্ন দেশি প্রজাতির বোরো জাতের ধান চাষ হতো।

আমন সৌসুমে মধুবিরণ, মধুমাধব, মালতি, ফুলমালতি, খাসিয়াবিন্নি,পুরাবিন্নি, নুনিয়া, জোয়াল কোট, মাতিয়ারি, আইকর শাইল, ময়না শাইল, গোয়াই, মুগবাদল, কলামাকনি, ধলামাকনি, যদুবিরণ, সোনাঝুরি, হাতকোড়া, ঘোটক, চেংরামুরি, পুনিয়া, কামিনীসরু, দুধজ্বর, বাজলা, মুগি, আশানিয়া, দেপা, বিরল, মোটংগা, আশা, গাজী, খামা, গুতি, কলামখনিয়া, খুকনি শাইল, কইতাখামা, জোয়ালভাঙা,তেরব আলী, ময়নামতি, চাপলাশ, পুঁথিবিরণ, ঝরাবাদল,  জিরাভোগ, কাটারিভোগ, নাগা ঠাকুরভোগ, বাদশাভোগসহ নানান জাতের ধান চাষ হতো।

আউশ মৌসুমে কিছু এলাকায় কাচিলুইন,জালি,শিয়াইন মুরান,মুরালি,দুমাই, মারকা,বোয়ালিয়া, জমির শাইল, গোয়ালমুড়ি, সূর্যমুখী,চেংরিমুরালী, মোরালি, বগি,দোয়ালিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ধান চাষ হতো।

জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাক ইউনিয়ন কৃষক শফিক মিয়া বলেন,  ‘৩ কিয়ার জমিতে রাতা ধান চাষ করে ৩৬ মণ পেয়েছি। এসব জাতের ধানের দাম বেশি। একই জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ করলে অন্তত ৬০-৬৫মণ ধান পাওয়া যেতো। আর বর্তমানে বাজারে ভালো মানের দেশি জাতের ধানের বীজ পাওয়া যায় না।  এছাড়া দেশি জাতের ধানের উৎপাদন হয় কম। উৎপাদনে সময়ও বেশি লাগে। তাই এসব ধানের আবাদ করতে কেউ আগ্রহী হয় না। কেউ কেউ সামান্য ধান চাষ করেন নিজেদের খাওয়ার জন্য।’ 

তাহিরপুরের শনি হাওর পাড়ের  বীরনগর গ্রামের বাসিন্দা সাদেক আলী বলেন, ‘এবছর ১৬ কিয়ার জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ করেছি। ফলনও ভালো হয়েছে। এবার ৩০০ মন ধান পেয়েছি। দেশি ধান চাষ করলে এর অর্ধেক পেতাম। তিনি বলেন, ‘ফলন কম হওয়ায় ও বাজারে ভালো মানের বীজ না পাওয়ায় দেশি ধান হারিয়ে যাওয়ার পথে। বেশি লাভের আশায় সবাই হাইব্রিড ও উফশি জাতের ধানের চাষ করছেন। লাভ কম, ফলন কম হওয়ায়া  দেশি ধানের চাষে কেউ আগ্রহ দেখান না।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘দেশি ধানের ফলন কম। তাই  দশি জাতের ধানের চাষ কমে যাচ্ছে। কৃষকেরা হাওরে ধানের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উফশি ও হাইব্রিড ধানের চাষাবাদে মনোযোগী হচ্ছেন। ফলে হাওরে এখন হাইব্রিড ধানের চাষ বেশি হচ্ছে।’

বিমল চন্দ্র সোম আরও বলেন, ‘কয়েকজন কৃষক আছেন, যারা দেশি জাতের ধানের চাল ও সুগন্ধী চাল খেতে আগ্রহী। তারাই কেবল স্থানীয় জাতের ধান চাষ করছেন।’

ঢাকা বিজনেস/এনই/




আরো পড়ুন